আন্ডারটোনসঃ ইসরায়েলের সমালোচনামূলক কণ্ঠস্বর আর প্যালেস্টাইন থেকে বাধাপ্রাপ্ত কণ্ঠস্বর

ক্ষতিগ্রস্ত গাজা। ফিলিস্তিনের সংবাদ ও তথ্য সংস্থা (ওয়াফা)/ উইকিমিডিয়া সাধারণ থেকে নেওয়া ছবি, গ্লোবাল ভয়েসেস রিমিক্স করেছে। সৃজনী সাধারণ একইরকম ব্যবহার ৩.০ অনুমতি

এই গল্পটি গ্লোবাল ভয়েসের সিভিক মিডিয়া অবজারভেটরির নিউজলেটারের আন্ডারটোনস এর অংশ। আন্ডারটোনস এর গ্রাহক হোন

আমাদের সারা বিশ্ব জুড়ে প্রকাশিত গণমাধ্যমে প্রচলিত মতামত/আখ্যান সন্ধানের মুখপত্র আন্ডারটোনসে আবারো স্বাগতম। আমি মেলিসা ভিদা এই নিউজলেটারের সম্পাদক। এই সপ্তাহে আমরা গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান করে আমাদের গবেষণা এবং যুদ্ধকে কভার করার অসুবিধাগুলি সম্পর্কে পর্দার অন্তরালের প্রতিফলন প্রদান করব।

সিভিক মিডিয়া অবজারভেটরি (নাগরিক গণমাধ্যম মানমন্দির) এর গবেষণা সাধারণত স্থানীয় দক্ষতার উপর নির্ভরশীল। আমাদের ইরান সংক্রান্ত ন্যারেটিভ (প্রচলিত মত) নিয়ে গবেষণার সময় একজন ইরানি গবেষক এই প্রক্রিয়াটির নেপথ্যে ছিলেন। জিম্বাবুয়ের মত নিয়ে অনুসন্ধানের সময় একজন জিম্বাবুয়ের গবেষক এইসব মত সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যখ্যা করেন। তাই ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের যুদ্ধ নিয়ে গবেষণার সময় আমাদের সাথে যথাক্রমে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি গবেষক কাজ করেছে। গণমাধ্যম বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট বা সূক্ষ্ম মতামতগুলি অধ্যয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাদের যুদ্ধ ও শান্তির মতামতগুলো দুবার করে গবেষণার লক্ষ্য ছিল।

যুদ্ধ, একমুখি দৃষ্টি ও বেদনার প্রেক্ষাপটে এই কাজটি কঠিন ছিল। সম্পাদকীয় দল হিসেবে আমরা দীর্ঘ দ্বিধা ও ব্যাপক চিন্তাভাবনা করে দেখেছি কীভাবে গবেষকদের নির্দেশনা দেওয়া যায়, কোন দৃষ্টিকোণটি নিতে হবে এবং অন্যান্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আমরা কী অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারি। আমরা বাইরের বিশেষজ্ঞদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। আমাদের ভুল তথ্য, শান্তির আখ্যান, বা যুদ্ধের শব্দার্থবিদ্যার উপর নজর দেওয়া উচিত কিনা?

তবে গবেষণার অগ্রগতির সাথে সাথে এখন বিদেশে বসবাসরত আমাদের গবেষককে গাজার ট্র্যাজেডি আঘাত করেছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে বিমান হামলায় তার পরিবারের আরো সদস্য নিহত হয়েছে। ভয়াবহতা সত্ত্বেও তিনি গবেষণা চালিয়ে যেতে চাইলেও গত সপ্তাহে আরো একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও গাজার বিশিষ্ট কণ্ঠকে হারানোর পরে ব্যথায় আবিষ্ট হয়ে আর কাজ করতে পারেননি; আমরা তার জন্যে ব্যথিত। আমরা অন্যদের সাথে এর আগেও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে কাজ করেছি – তবে এমন পরিস্থিতি নজিরবিহীন। রক্তপাতের ফলে সংবেদনশীল আঘাত ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করে দেওয়ায় গাজা থেকে তথ্য আরো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আপাতত আমরা শুধু আমাদের ইসরায়েলি গবেষকের বিশ্লেষণ প্রদর্শন করতে সক্ষম।

শুরু থেকে ঘনিষ্ঠভাবে যুদ্ধ অনুসরণকারী আমাদের একজন সমন্বয়কারী সম্পাদক অ্যাস্টেরিস মাসুরাস বলেছেন: “৭ অক্টোবরে হামাসের মর্মান্তিক হামলার পর সম্মিলিতভাবে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ অনুসরণ, গবেষণা ও প্রতিবেদন করা খুবই কষ্টকর।”

“বিদ্বেষমূলক, ভয়ঙ্কর সামরিক সহিংসতার প্রতিবেদন ও গাজার বন্দী জনগোষ্ঠীর উপর একটি নৃশংস অবরোধে সৃষ্ট ক্ষতি বিশ্বব্যাপী ইহুদি-বিদ্বেষ ও ইসলামভীতি তীব্রতর করার আখ্যানের সাথে মিশ্রিত। গাজায় মানবাধিকারের নিয়ম ও আইন অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে,” তিনি আরো বলেন।

মানুষের জীবনহানির হারের প্রেক্ষিতে ইসরায়েলের বাহিনী ৭ অক্টোবর, ২০২৩ সাল থেকে গাজায় ১৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। জাতিসংঘের জানানো সংখ্যা অনুসারে, সর্বশেষ ইসরায়েলি প্রতিবেদনে ১৫,০০০জন হত্যার শিকার – যার মধ্যে ৫,০০০ জন হামাসের সদস্য। অক্টোবরে জঙ্গি ইসলামি গোষ্ঠী হামাস তাদের হামলায় ইসরায়েলে ১,২০০ জনেরও বেশি হত্যা করেছে।

গ্লোবাল ভয়েসেসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা সম্পাদক মরিয়ম এ’র মতে, গাজার যুদ্ধের প্রভাব আবেগিক ও মানসিক আঘাতের বাইরেও বিস্তৃত।

গাজার বেসামরিক জীবনের অসহনীয় ক্ষতি ও বসবাসের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর সম্পূর্ণ ধ্বংসের পাশাপাশি “যুদ্ধের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাব বিশেষ করে জর্ডান, মিশর ও লেবাননের মতো প্রতিবেশী দেশগুলির জন্যে অনেক,” তিনি বলেছেন। আরো বিপজ্জনক হলো এটি অব্যাহত থাকলে সমগ্র অঞ্চল এবং সম্ভাব্যভাবে বিশ্বকে দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের দিকে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

ইসরায়েলের ভেতরকার সমালোচনামূলক আখ্যান

অক্টোবরের গোড়ার দিকে, আমরা প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রধান আখ্যান সম্পর্কে আনার গবেষণা প্রকাশ করেছি, যা ইসরায়েলি ইহুদি সমাজে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আন্দোলনের মধ্যে বিভাজনের উপর আলোকপাত করেছে। ‘আনা’ বেনামী থাকতে চাওয়া আমাদের গবেষকের একটি কাল্পনিক নাম।

তিনি গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নেতানিয়াহু বিরোধী মনোভাব অধ্যয়ন করতে নভেম্বরে নাগরিক গণমাধ্যম মানমন্দিরে ফিরে আসেন। তার খুঁজে পাওয়া ও বিশ্লেষিত বর্ণনাটি হলো: “নেতানিয়াহুর সরকার ৭ অক্টোবরের গণহত্যার জন্যে আংশিকভাবে দায়ী।”

অজনপ্রিয় বিচার বিভাগীয় সংস্কার, কট্টর ধর্মীয় সরকার এবং ২০২৩ জুড়ে বিক্ষোভকারীদের কথা শুনতে না চাওয়ার কারণে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা অক্টোবর থেকে ইতোমধ্যে আরো হ্রাস পেয়েছে।

ইসরায়েলি কোম্পানি সংলাপ_কেন্দ্রের মতে, সমীক্ষার উত্তরদাতাদের ৭৫ শতাংশেরও বেশি সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব দেখিয়ে হামাসের হামলার জন্যে নেতানিয়াহুর সরকারকে দায়ী করেছে। এছাড়াও প্রায় ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতারা মনে করে যুদ্ধের শেষে নেতানিয়াহুর পদত্যাগ করা উচিত। অনেকগুলির মধ্যে এই ফেসবুক পোস্টটি সেই দিকেই যাচ্ছে।

ইসরায়েলি গণমাধ্যম ধারাবাহিকভাবে জানিয়েছে নেতানিয়াহু হামাসকে অর্থায়নের জন্যে কাতারি তহবিল সমর্থন করে হামাসের প্রশাসনকে সমর্থন করেছেন, এক দশকে যার পরিমাণ শত শত কোটি ডলারটাইমস অব ইসরায়েলের মতে, “ধারণাটি হলো আব্বাস – বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পশ্চিম তীর সরকারের অন্য কাউকে – ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হতে বাধা দেওয়া।” নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে এই অর্থ মানবিক কারণের জন্যে, হামাসকে শক্তিশালী করার জন্যে নয়।

অক্টোবরের ৭ তারিখের গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া একজনসহ ইসরায়েলি সাংবাদিক ক্সেনিয়া সভেতলোভাঅন্যান্য নাগরিকরা বছরের পর বছর ধরে নেতানিয়াহুর হামাস পরিচালনার সমালোচনা করেছে৷

নেতানিয়াহুর দোষ খুঁজে পাওয়াদের একাংশের দাবি “শুধু সামরিক পদক্ষেপ ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিরোধের সমাধান করবে না।” এসব কণ্ঠস্বরের মধ্যে প্রচলিত বাম (হামাস থেকে বেঁচে যাওয়াসহ) ও সাবেক নেতানিয়াহু সমর্থকরা রয়েছে।

“এই আখ্যানটি থেকে দেখা যায় যে ইসরায়েলি সমাজ ও ইসরায়েলি সরকার একটি অভিন্ন সত্তা হিসেবে বোঝা যায় না,” আনা লিখেছেন৷ সবাই না হলেও অনেকেই খোলাখুলিভাবে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে। শিক্ষাবিদ ও সামাজিক কর্মী টোমার পারসিকো নিন্দা করেছেন উপনিবেশবাদ ও ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের।

তবুও সাম্প্রতিক জরিপ অনুসারে এই শিবিরে কণ্ঠস্বর হয়তো কম। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্টোবরের একটি জরিপে ৫৭.৫ শতাংশ প্রধানত ইহুদি উত্তরদাতারা গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সামরিক শক্তি ব্যবহারকে মূল্যায়ন করে এটিকে “খুব কম” মনে করেছে, আর ১.৮ শতাংশ এটিকে “অতিরিক্ত” হিসেবে দেখেছে৷ অনুসারে অন্যান্য জরিপে অনুরূপ ফলাফল এসেছে বলে এল পাইসের প্রতিবেদন করেছে৷

তবে লক্ষ্য করা দরকার ইসরায়েলে বাকস্বাধীনতা হয়তো ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের সাথে শান্তি ও সহাবস্থানের পক্ষ সমর্থকদের অনেকেই প্রায়শই ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সক্রিয় হয়রানিগ্রেপ্তারের শিকার হয় বলে দাবি করা হয়। তাদের মধ্যে সাংবাদিকরাও রয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুতে একজন ইসরায়েলি ব্যক্তি হামাসের জিম্মিদের পরিবারের একটি তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসব পরিবারের অনেকে গণমাধ্যম প্রতিবেদনে নেতানিয়াহু সমর্থক বলে ইঙ্গিত দেওয়া এই ব্যক্তি প্রবল সমালোচনা করেছে।

গ্লোবাল ভয়েসেসের বিশেষ কভারেজ: “গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ

গ্লোবাল ভয়েসেসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা সম্পাদক মারিয়াম এ পেশাদারিত্ব ও সহানুভূতি নিয়ে আমাদের যুদ্ধের কভারেজ দক্ষতার সাথে সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন। আমাদের নিবন্ধের অধিকাংশই পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রায়শই উপেক্ষিত ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরে। আমরা আপনাকে আমাদের কভারেজ: “গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ” অন্বেষণে উৎসাহিত করছি।

যুদ্ধ সম্পর্কে গ্লোবাল ভয়েসেসের বিবৃতি

  • গ্লোবাল ভয়েসেস অবিলম্বে গাজা ও ইসরায়েলে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে ১৪০+ নাগরিক সমাজ সংস্থা ও সক্রিয় কর্মীর সাথে যোগ দিয়েছে। বিবৃতিটি পড়ুন
  • গ্লোবাল ভয়েসেস ২৯টি মানবাধিকার সংস্থার পাশে দাঁড়িয়ে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের পদ্ধতিগতভাবে লক্ষ্যবস্তু করার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিবৃতিটি পড়ুন

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .