একই যুদ্ধে যখন ফিলিস্তিনিরা ‘মারা যায়’ আর ইসরায়েলিরা ‘হত্যা'র শিকার

ফেডারেল বিল্ডিং, সান ফ্রান্সিসকো, ২০ অক্টোবর, ২০২৩। সিনেটর ন্যান্সি পেলোসির অফিসের বাইরে রাস্তায় একটি বিশাল ম্যুরাল আঁকতে নানা স্তরের শত শত লোক একত্রিত হয়। যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে বার্তা দিয়েছে: বাইডেন, পেলোসি: যুদ্ধাপরাধে সহায়তা করবেন না এবং জড়িত হবেন না। বে এরিয়ার শান্তির জন্যে ইহুদি কণ্ঠস্বর, শান্তির কবিবৃন্দ, জলবায়ু ন্যায়বিচার সড়ক মুরাল অংকন প্রকল্প। ছবি: ফ্লিকারে পেগ হান্টার। (সৃজনী সাধারণ অবাণিজ্যিক ২.০ অনুমতি)।

গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিশৃঙ্খলার মধ্যে গাজায় উদ্ভূত সংকটের বাস্তবতাকে গ্রাস করে তথ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে ভুল তথ্য ও পক্ষপাতদুষ্ট বর্ণনার গোলকধাঁধায় জড়িয়ে সত্য আহত।

সংবাদ প্রতিবেদনে প্রতিটি শব্দার্থগত পছন্দ, সূক্ষ্ম বর্জন, অগ্রাধিকারপক্ষপাত পাঠকদের তথ্য ব্যাখ্যা ও গ্রহণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে। সার্বিক সমস্যা ও প্রান্তিক কণ্ঠগুলো শিরোনামের বাইরেই মিলিয়ে যায়। বিশেষ করে গাজায় পরিলক্ষিত “যুদ্ধের কুয়াশায়” বুদ্ধিবৃত্তিক ও অ্যালগরিদমের পক্ষপাত তথ্যে প্রবেশাধিকারকে স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার করে

ভুল তথ্য ছাড়াও মানহানিকর ও অমানবিক বিভিন্ন আখ্যান নির্মিত জটিল তথ্য দৃশ্যপটটি যেন মূলধারার গণমাধ্যমে ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী ও অশ্বতাঙ্গ জনগণের কভারেজের প্রতিচ্ছবি।

ফিলিস্তিনিরা শুধু মারা যায় না, তারা নিহত হয়

গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধে প্রাণহানির বর্ণনা দিতে “মৃত” ও “নিহত” ব্যবহারে একটি সূক্ষ্ম অথচ প্রভাবশালী শব্দার্থগত পার্থক্য প্রতিফলিত হয় কারণ এটি তথ্যটি কীভাবে উপলব্ধ হবে তা নির্ধারণ করে।

মেরিয়াম-ওয়েবস্টার অভিধানের সংজ্ঞায় “মৃত্যু” একটি অকর্মক ক্রিয়া হিসেবে একটি পরোক্ষ কাজকে বোঝায় – সম্ভাব্য মৃত্যুকে বার্ধক্যের মতো প্রাকৃতিক কারণের সাথে যুক্ত করে। বিপরীতভাবে, “নিহত” একটি সকর্মক ক্রিয়া, যা আরো সক্রিয় প্রায়শই হামলা বা আক্রমণের মতো অস্বাভাবিক বা হিংসাত্মকভাবে মৃত্যুর একটি দ্যোতনা সৃষ্টি করে।

ওয়াশিংটন পোস্টে ২০২২ সালে একটি মতামত নিবন্ধে লরা আলবাস্ট লিখেছেন, “ফিলিস্তিনের গণমাধ্যম কভারেজে আমরা প্যাটার্নটি বারবার দেখেছি। ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হয় না; আমরা কেবল মারা যাই।”

সম্প্রতি স্কাই সংবাদ উপস্থাপককে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সাংবাদিক ইয়ারা ইদ একই অনুভূতির প্রতিধ্বনি তুলেছেন, “আমি মনে করি ভাষা ব্যবহার করা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ কারণ সাংবাদিক হিসেবে যা ঘটছে তা জানানো আপনার নৈতিক দায়িত্ব। ফিলিস্তিনিরা শুধু মরে না, তারা নিহত হয়।”

গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধ নিয়ে কথা বলার সময় ভাষার ব্যবহারের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছেন সাংবাদিক ইয়ারা ইদইদ_ইয়ারা ইনস্টাগ্রাম ভিডিও থেকে নেওয়া পর্দাছবি। ন্যায্য ব্যবহার।

সংবাদ গণমাধ্যম সচেতনভাবে পরোক্ষ বা সক্রিয় ভাষার ব্যবহার বেছে নিয়ে মৃত্যু/ হত্যার অমিলের বাইরে পরিভাষায় একটি শ্রেণিভেদ প্রদর্শন করে। একটি সংবাদ টুকরোর ভাষা পরীক্ষা করে অন্তর্নিহিত পক্ষপাত বা দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ বোঝা যায়।

বিশেষভাবে বিভ্রান্তিকর একটি উদাহরণে সিএনএনের একজন নিউজ অ্যাঙ্কর অস্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে বলেছেন: “গাজার একটি হাসপাতাল তীব্র বোমাবর্ষণের রাতে শত শত আহতসহ ২২টি মৃতদেহ পাওয়ার কথা বলেছে।” সেগুলো মারা যাওয়া মৃতদেহ কিনা, কে দায়ী এবং কার কাছ থেকে সেগুলো গ্রহণ করা হয়েছে সে বিষয়ে আর কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।

আল মাগাজি শরণার্থী শিবিরে ৫ নভেম্বর ইসরায়েলি বিমান হামলার ক্ষেত্রে নিউইয়র্ক টাইমসের শিরোনামটি পরোক্ষ ভাষা ব্যবহার করে বলেছে, “গাজাবাসীদের বর্ণিত বিমান হামলার বিস্ফোরণে ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় হতাহত অনেক।” “শরণার্থী শিবির” উল্লেখের পরিবর্তে “অনেক হতাহত” এবং “ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা”র মতো বাক্যাংশগুলি অস্পষ্ট।

এছাড়াও বিমান হামলার জন্যে স্পষ্টভাবে ইসরায়েলিদের দায়ী না করে ভাষায় “গাজাবাসীদের বর্ণিত” ব্যবহার তথ্যের উৎস সম্পর্কে সন্দেহ জাগায়। গাজায় ইসরায়েলের মাসব্যাপী বোমাবর্ষণের প্রেক্ষাপটে এই ধরনের অস্পষ্টতা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। উল্লেখ্য এই হামলাটি ২৬ ঘন্টার মধ্যে গাজার শরণার্থী শিবিরে আঘাত করা বিমান হামলা তিনটির একটি

সিবিএস সংবাদের একটি নিবন্ধে লেখকরা ইসরায়েলিদের উপর হামাসের আক্রমণকে “হত্যামূলক তাণ্ডব” হিসেবে বর্ণনা করার জন্যে তীব্র ভাষা ব্যবহার করলেও যুদ্ধের প্রথম নয় দিনে ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানির কথা উল্লেখের সময় তারা “নিহত” ও “মৃত্যুর সংখ্যা”র মতো তুলনামূলকভাবে মৃদু শব্দ ব্যবহার করে।

উল্লেখযোগ্য শ্রেণিবিভেদ তৈরি করা সহিংসতার এই চিত্রায়নে হয়তো ফিলিস্তিনিদের কষ্টের প্রভাব বা তীব্রতা হ্রাস পেয়েছে। ভাষার এই অসঙ্গতি পাঠকদের মনোভাবকে প্রভাবিত করে সহিংসতা বোঝার ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে।

সংবাদকক্ষগুলির পদ্ধতিগত সমস্যার উন্মোচন

২০১৪ সালে ইসরাইল-গাজা যুদ্ধের পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদনের বিষয়ে হোয়াইটলেডিস রোডে বিবিসি ব্রিস্টলের সদরদপ্তরের সামনের বাগানে গাজার ব্রিস্টল বন্ধুদের প্রতিবাদ। ছবি: রয়েন্ডল্যান্ড, ২৩ জুলাই, ২০১৪। উইকিমিডিয়া সাধারণ (সৃজনী সাধারণ একইরকম ভাগাভাগি ৪.০ অনুমতি)।

সংবাদকক্ষগুলির একটি পদ্ধতিগত সমস্যা প্রকাশিত পরিভাষার এই শ্রেণিবিভেদ ও আখ্যান গঠন ফিলিস্তিনিদের জন্যে নতুন নয়। বিশেষ করে ব্রেওনা টেলর হত্যাকাণ্ডের মতো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের বিরুদ্ধে পুলিশের সহিংসতার কভারেজের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ গণমাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে বর্ণবাদের জন্যে সমালোচিত

লেখক ও সম্পাদক এডেশিনা ইমানুয়েল উল্লেখ করেছেন, “সংবাদকক্ষগুলি প্রায়শই পুলিশি সহিংসতার শিকারদের চরিত্রগুলিকে হত্যা করে পুলিশের বর্ণনার উপর প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়ে মৃত্যুর মুহূর্তকে স্থির করে।” এটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের পরিবর্তে তাৎক্ষণিক ও প্রায়শই নাটকীয় ঘটনাবলীর মতো একটি সংকীর্ণ ফোকাস বোঝায়।

ইউক্রেনের যুদ্ধের গণমাধ্যম কভারেজও বর্ণবাদী উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পণ্ডিত এইচ.এ. হেলিয়ার অ-শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে অসুরায়ন এবং তাদের মর্যাদায় বেঁচে থাকার অধিকারের উপর এর প্রভাবের উপর জোর দিয়ে সাংবাদিকদের ব্যবহৃত বর্ণবাদী ভাষাটি তুলে ধরেছেন। স্পষ্ট বর্ণবাদী কভারেজ ছাড়াও সুদানের যুদ্ধের মতো অন্যান্য বড় বড় মানবিক বিপর্যয় মূলধারার গণমাধ্যমের  খুব কমই মনোযোগ পায়।

সংবাদকক্ষের উপর রাজনৈতিক প্রভাব ও চাপ গণমাধ্যমের বর্ণনার -আকৃতিকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। স্বাভাবিকভাবেই ২০২৩ সালের মে মাসে বেশিরভাগ মার্কিন সাংবাদিক সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ফিলিস্তিনপন্থী মন্তব্য প্রকাশের জন্যে অসংখ্য সাংবাদিকের বরখাস্তের প্রবণতা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে তীব্র হওয়ার উদাহরণ এসব উদ্বেগকে সমর্থন করে।

গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধের মধ্যেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টনি ব্লিঙ্কেন কাতারের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছে গাজায় ইসরায়েলের পদক্ষেপের বিষয়ে “আল জাজিরার বক্তব্য নমনীয় করতে।” অন্যান্য সংবাদকক্ষে এই অনুভূতিটিই প্রতিফলিত হয়েছে যেমন ইন্টারসেপ্ট জানিয়েছে: “জার্মানি ভিত্তিক প্রকাশনা দানব অ্যাক্সেল স্প্রিংগারের একটি সহায়ক সংস্থা আপডেতে নেতারা কভারেজের ক্ষেত্রে ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মৃত্যু কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে বলে কর্মচারীরা জানিয়েছে।”

একদল ইহুদি লেখক ইসরায়েলের সমালোচনা সহজাতভাবে ইহুদি-বিরোধী এই ধারণার নিন্দা এবং ফিলিস্তিনপন্থীদের দমনের উল্লেখ করে একটি খোলা চিঠি তৈরি করেছে: 

“বর্তমানে গাজায় ইসরায়েলের চলমান সামরিক বোমাবর্ষণকে ন্যায্যতা দিতে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা থামাতে বাকস্বাধীনতার এই জঘন্য কণ্ঠরোধকে ব্যবহার করা হচ্ছে। […] ইসরায়েলি সাংবাদিকরা তাদের সরকারের সমালোচনার পরিণতিকে ভয় পায়। […] আমরা ইহুদি নিরাপত্তা ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা এবং ইহুদি পরিচয় ও ফিলিস্তিনিদের নিপীড়নের অবসানের মধ্যে মিথ্যা পছন্দ প্রত্যাখ্যান করি। আসলে, আমরা মনে করি ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের অধিকার একসূত্রে গাঁথা।”

বৈশ্বিক সংহতির আহ্বান

ফিলিস্তিনের সমর্থনে ও ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতি তাদের জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশ করেছে। ১৫ অক্টোবর, ২০২৩। ছবি: ম্যাট হরকাক, উইকিমিডিয়া সাধারণ (সৃজনী সাধারণ একইরকম ভাগাভাগি ৪.০ অনুমতি)।

মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট কভারেজ সত্ত্বেও জনগণ গাজার বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যার সম্বন্ধে সচেতন হয়েছে মূলত মাঠে থাকা সাংবাদিকদের সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চে ইংরেজি কভারেজের কারণে। মোতাজ আজাইজা, প্লেস্তিয়া আলাকাদবিসান আওদার মতো সাংবাদিকরা তথ্য প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সাও পাওলো, কেপটাউনকুয়ালালামপুরসহ প্রধান শহর জুড়ে লক্ষ লক্ষ বিক্ষোভকারী ফিলিস্তিনিদের সাথে নিয়মিত একাত্মতা প্রকাশ করেছে। তারা ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ এবং ফিলিস্তিনিদের উপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ আক্রমণ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের ব্যর্থতা সমাধানে এগিয়ে এসেছে।

বৈশ্বিক দক্ষিণ থেকে পশ্চিমের প্রতি ভন্ডামির অভিযোগের একটি মিলিত কণ্ঠের এই বিক্ষোভগুলি বৈশ্বিক উত্তর ও পশ্চিমের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ফাটলের পরিচায়ক। এই সমালোচনা পশ্চিমের ইউক্রেনে অবৈধ দখলের নিন্দার বিপরীতে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন তুলে ধরে পরস্পরবিরোধী নীতি ও গণমাধ্যম প্রতিক্রিয়ার উপর জোর দেয়।

গণমাধ্যমের পক্ষপাতিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে থাকায় সারাবিশ্বের জনগণ তথ্য যাচাই-বাছাই করছে এবং নানা দৃষ্টিভঙ্গির আরো ন্যায়সঙ্গত উপস্থাপন দাবি করছে। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় যেখানে সত্যের প্রাধান্য ও প্রান্তিক কণ্ঠস্বর অনুরণিত স্থানের সমর্থক সচেতন জনসাধারণ সক্রিয়ভাবে পক্ষপাতকে চ্যালেঞ্জ করে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .