
ছবি: আরজু গেবুলায়েভা
রাষ্ট্রনেতার সমালোচকদের প্রতি এরদোয়ান সমর্থক ও তুর্কি সরকারি কর্মকর্তাদের সাধারণভাবে ব্যবহৃত একটি অভিযোগ, “আপনি একজন ” ফেতো’ সদস্য!”
তুরস্কের স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী তার অনলাইন ট্রল ও সরকারি অভিজাতদের বাহিনীর মাধ্যমে প্রায় প্রতিটি সমালোচককে তাদের ফেতুল্লা গুলেন আন্দোলন পন্থী এবং/অথবা সদস্য — মূলত সন্ত্রাসী — আখ্যা দিয়ে চুপ করানোর একটি কৌশল আয়ত্ত করেছে। এই শব্দটি ফেতুল্লা গুলেনের নেতৃত্বে একটি অস্পষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বোঝায়, যারা ২০১৬ সালে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান সরকারকে উৎখাৎ প্রচেষ্টায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তুরস্কের নির্বাচিত নেতাকে জোরপূর্বক অপসারণের এই অগণতান্ত্রিক প্রচেষ্টার আগে গুলেন আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা “সেমাত” (সম্প্রদায়) হিসেবে উল্লেখিত হতো। সরকারপন্থী অন্ধ অনুসারীরা ২০১৮-এর পরে আন্দোলনটিকে “ফেতুল্লাচি তেরর অরগুতু” (এফইটিও) – “ফেতুল্লা গুলেন সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে নামকরণ করে।
ভয় দেখিয়ে সমালোচকদের চুপ করানো
আজ অবধি হাজার হাজার তুর্কি নাগরিককে ফেতো সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত করে তাদের চাকরি, সম্পত্তি, জীবিকা ও অনেক ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনতা পর্যন্ত হরণ করা হয়েছে। তুরস্কের কারাগারগুলি গুলেন-বিশ্বাসী সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত অসংখ্য এরদোয়ান বিরোধী ভিন্ন মতাবলম্বীতে পরিপূর্ণ। এরদোয়ান গুলেনবাদী অপরাধীদের আক্রমণ ছাড়াও সাংবাদিক, সক্রিয় কর্মী ও লেখকসহ এরদোয়ানের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করা অনেক ব্যক্তিকে নীরব করতে অভ্যুত্থান ব্যবহার করেছেন।
তুর্কি নাগরিকদের ফেতো সদস্য চিহ্নিত করা ছাড়াও প্রায়শই কূটনীতিক, প্রসিকিউটর ও এমনকি খ্রিস্টান যাজকসহ বিদেশী নাগরিকদের “ক্রিপ্টো” – গুলেন-বিশ্বাসের গোপন সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। ব্যক্তিদের এরদোয়ানের বিপক্ষে দাঁড়ানোর ইচ্ছা নিবৃত্ত করার মতো ভয় জাগিয়ে তোলার মধ্যেই সরকারের সাফল্য নিহিত। বিচারের সম্মুখীন, চাকরি হারানো এবং সম্ভবত জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা ফেতো সদস্য চিহ্নিত হতে নাগরিকদের আতঙ্কের অন্যতম কারণ।
এই কলঙ্কারোপ ২০২৩ সালে হাজার হাজার নাগরিকের মৃত্যু ঘটা বিপর্যয়কর ভূমিকম্প মোকাবেলায় ফুটে ওঠা সরকারের বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক নীতি ও অব্যবস্থাপনার ধাক্কা সত্ত্বেও এরদোয়ানের বিরুদ্ধে বৃহত্তর জনবিক্ষোভের উদ্যোগকে সফলভাবে ম্লান করেছে।
ফলাফলটি ভয়াবহ: কেউ হয়তো তাদের টুইট বা পোস্টগুলি দেখে ফেলবে, প্রতিবাদে অংশ নেওয়া তো দূরের কথা জনগণ সামাজিক গণমাধ্যমের চ্যানেলগুলিতেও কথা বলতে ভয় পায়।
এরদোয়ান-গুলেন দ্বন্দ্ব
পরিহাস হলো, এরদোয়ান ও তার তত্ত্বাবধানে থাকা অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি অভিজাতরা চূড়ান্ত গুলেনবাদী। ২০০৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর এরদোয়ান গুলেন আন্দোলনের সাথে একটি খুব শক্তিশালী জোট গঠন করেন, যা ২০১০-২০১৬ সালের মধ্যে ভেঙ্গে যায়। এরদোয়ান-গুলেন জোটের জনসাধারণের স্মৃতি মুছে ফেলার ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত সফল হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে সামরিক, রাষ্ট্রীয় আমলা ও আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের কিছু সদস্যের সাথে ষড়যন্ত্র করায়গুলেন আন্দোলনকে প্রধান অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও প্রকৃত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা প্রকাশের কয়েক ঘন্টার মধ্যে ব্যর্থ আশ্চর্যজনকভাবে সহিংস বিদ্রোহীরা অভ্যুত্থান-বিরোধী ৩০০-রও বেশি বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে। কয়েকদিন পর এরদোয়ান শাসকগোষ্ঠী গুলেন আন্দোলনটিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন চিহ্নিত করে মতাদর্শটির জ্যেষ্ঠ্য সদস্যদের, বিশেষ করে এর নেতা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী চির-নির্বাসিত ফেতুল্লা গুলেনকে ধরতে বিশ্বব্যাপী অভিযান শুরু করে। এছাড়াও, এরদোয়ান তার স্থিতিশীলতার নতুন জাতীয় কল্পকাহিনীকে সমর্থন করতে অভ্যুত্থানকে ব্যবহার করেন। অভ্যুত্থানটির ব্যর্থতার বার্ষিক স্মরণে আতাতুর্ক বসফরাস সেতুর মতো পুরো স্মৃতিস্তম্ভের নাম পরিবর্তন করে “১৫ জুলাই শহীদ সেতু” রাখা হয়।
প্রকৃত অর্থে এরদোয়ান বলকান, সাব-সাহারা আফ্রিকা, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা গুলেন আন্দোলনকে দমন করতে বিপুল পরিমাণ জাতীয় সম্পদ ব্যয় করেন।
তুরস্কে গুলেন আন্দোলনের আদর্শিক লক্ষ্য সবসময়ই তুলনামূলকভাবে অস্বচ্ছ। সংক্ষেপে এটি দেশের অর্থনৈতিক আধুনিকীকরণকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছে, যেখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছে অগ্রগতি কেবল ইসলাম ও রক্ষণশীল মূল্যবোধ গ্রহণের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব।
এরদোয়ান শুধু সংগঠনটির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দমনাভিযানে আগ্রহী ঘোষণা করে গুলেনের অনুসারীদের সংশ্লিষ্টতা ত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষত বৈশ্বিক দক্ষিণে তুরস্কের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্যে যাদের বেশিরভাগ শেষ পর্যন্ত আঙ্কারার অনুগ্রহে থাকতে চায় এমন প্রধানত দরিদ্র দেশগুলিতে তুর্কি কর্তৃপক্ষের সরাসরি চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা থাকায় গুলেনের বেশিরভাগ ব্যবসা, দাতব্য সংস্থা ও স্কুলগুলির বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তুরস্কের অভ্যন্তরে, আন্দোলন সম্পূর্ণ অকার্যকর। এমনকি ২০১৬ সালের অভ্যুত্থানের আগে এরদোয়ান তার সরকারকে ব্যবসা, ব্যাংক ও সংবাদমাধ্যমসহ গুলেনের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্রের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তবে যেটা বাকি আছে তা হলো সমালোচক, ভিন্নমতাবলম্বী ও বিভিন্ন ধরনের বিরোধীদের চুপ করানোর উপায় হিসেবে গুলেনের উপর এরদোয়ানের বর্তমান নির্ভরতা।
এরদোয়ান-গুলেন জোটের কথা স্মরণ
তবে তুর্কি সমাজ কীভাবে গুলেনের সঙ্গে এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভুলে যাবে? আহমেত সিকের মতো অভিজ্ঞ অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা অসংখ্য প্রকাশনায় খুব সুনির্দিষ্টভাবে সুবিধার জন্যে ফেতুল্লা গুলেন ও এরদোয়ানের একটি জোট তৈরি নথিভুক্ত করেছেন। ক্ষমতায় আসার পর ২০০৩ সালে এরদোয়ান গুলেন ও তার অনুসারীদের বিপুল পরিমাণ ক্ষমতার সুবিধা দিয়েছিলেন। গুলেনবাদীদের আইন প্রয়োগকারী, সামরিক, প্রসিকিউটর এবং বিচারক হিসেবে বিচার বিভাগীয় নিয়োগ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কূটনীতিক ছাড়াও উচ্চ-প্রোফাইল ও চাহিদা-সম্পন্ন সরকারি বিশিষ্ট পদ দেওয়া হয়েছিল। কেন? কারণ দেশে গুলেন যাতে তার বিপুল অনুসারীদের থেকে এরদোয়ানের পক্ষে ভোট দিতে পারেন। তার ওপর এরদোয়ান গুলেনের বিদ্যমান বৈশ্বিক সম্পর্ক ও নেটওয়ার্ক কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, কংগ্রেসের সদস্যদের সাথে গুলেনের প্রতিষ্ঠিত সম্পর্কের কারণে ২০০০-এর শেষের দিকে এরদোয়ান যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে প্রচুর প্রভাব অর্জন করেন।
বিনিময়ে গুলেন দীর্ঘ প্রত্যাশিত একটি সংস্কৃতি আন্দোলনের স্বপ্ন: কামাল আতাতুর্ক প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিপর্যয় বাস্তবায়নে সক্ষম হন। কয়েক দশক ধরে ফেতুল্লা গুলেন তুরস্ককে নতুন পরিচয় দিয়ে এর পশ্চিমাপন্থী অভিমুখিতা দূর করতে চেয়েছেন।
অনুসারীরা ১৯৬০-এর দশক থেকে গোপনে সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক পদে অবস্থান অর্জনে সফল হলেও তাদের সংখ্যা গুলেনের আরো ধার্মিক ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে উদ্দেশ্যে শেষ পর্যন্ত সমাজ পরিবর্তন করার জন্যে সম্ভবত খুব কম ছিল।
এরদোয়ানের সাথে জোট পরিস্থিতি পরিবর্তন করেছিল। আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গুলেনবাদী বিচারক ও অভিসংশকরা সক্রিয়ভাবে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ দুর্গগুলিকে আক্রমণ করতে শুরু করে। এর মধ্যে রয়েছে ২০১০ সালে গণভোটের মাধ্যমে বিচার মন্ত্রণালয়ের রাজনীতিকরণকে সহজতর করতে সাহায্য ও লক্ষ্যবস্তু করা বিচার ও গণমাধ্যম প্রচারণার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ অভিজাতদের আরো কোণঠাসা করতে আয়গেনেকন ও স্লেজহ্যামারের মতো বিচারে উচ্চ-পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের বিচার করে জেলে পাঠিয়ে এরদোয়ান মূলত অকথিত অনুপাতে একটি দানবকে ক্ষমতায়ন করেছিলেন যা শেষ পর্যন্ত তার উপরেই আঘাত হেনেছিল।
গুরুতর নীতিগত পার্থক্যের কারণে গুলেনের সাথে এরদোয়ানের জোটের অবনতি শুরুর ফলে ২০১৬ সালে গুলেন এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেন। গুলেনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল সরকারি নীতি নির্ধারণে তার এরদোয়ানের সমান কণ্ঠস্বর রয়েছে মনে করা, যা মৌলিকভাবে গুলেনের বিরোধিতা স্বত্বেও এরদোয়ানের ২০১০ সালে তুরস্কের কুর্দিদের সাথে একটি শান্তি মীমাংসার আলোচনার চেষ্টার সময় স্পষ্ট হয়।
দুজনের ফাটল এতোটাই বেড়ে যায় যে গুলেন আলোচনার নেতৃত্ব দেওয়া তুরস্কের গোয়েন্দা প্রধান (বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হাকান ফিদানকে গ্রেপ্তার করতে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের পাঠিয়ে শান্তি আলোচনাকে নষ্টের চেষ্টা করেন। তখন থেকেই দুই জোটের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। সেখান থেকে গুলেনের বিরুদ্ধে এরদোয়ানের ক্ষোভ এতোটাই বেড়ে যায় যে তিনি প্রশ্ন করেন “তারা [অর্থাৎ গুলেন] কখন কী চেয়েছিল যা আমরা তাদের দেইনি?” এরদোয়ান তার প্রাক্তন মিত্রের বিশ্বাসঘাতকতা অনুভব করেছিলেন। বিরোধ প্রকাশ্যে ছড়িয়ে পড়ার সময় এরদোয়ান তার গুলেনের প্রাক্তন পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে সমালোচনা ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করেছিলেন কেবল এই বলে যে “[গুলেনের কারণে আমাদের মিত্র মনে করে] আমারা বিভ্রান্ত ও বোকা হয়েছিলাম।“
এরদোয়ান-গুলেন অংশীদারিত্ব তুরস্কে অবর্ণনীয় ক্ষতি ডেকে এনেছে। ইসলামপন্থী দুই নেতা ও তাদের নিজ নিজ অনুসারীরা আইনের শাসনের গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন নষ্ট করতে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ব্যবহার করেছে। এক দশকের বেশি দ্বন্দ্ব সময় ধরে এরদোয়ান ও গুলেন একে অপরকে নির্মূল করতে তাদের সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছে। আপাত বিজয়ী এরদোয়ান আরো ভালভাবে ২০১৩ সালে পার্কে বিক্ষোভের সময় থেকে ভিন্নমত দমনে সাহায্যকারী কলংক ফেতোবাদীর মাধ্যমে —সাধারণ নাগরিক বা বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হোক না কেন — যেকোনো নতুন প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার ক্ষমতা আয়ত্ত করেছেন।
নাগরিকদের ফেতুল্লা গুলেনের সাথে তার গভীর সংযোগের কথা ভোলাতে আপেক্ষিক সাফল্য সত্ত্বেও গুলেনের ক্ষমতায়নকারী যে এরদোয়ান স্বয়ং এমন জনসচেতনতা বাড়াতে পর্যবেক্ষকরা কাজ করছে।