কয়েক মাস অনিশ্চয়তার পর অবশেষে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান লাভের একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত চুক্তি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সবুজ সংকেত পেয়েছে। ২৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র মোট ২,৩০০ কোটি ডলার (২.৫২ লক্ষ কোটি টাকা) মূল্যে ৪০টি নতুন এফ-১৬ বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। চুক্তিতে তুরস্কের বিদ্যমান ৭৯টি এফ-১৬-এর আধুনিকীকরণের সরঞ্জামও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তুরস্কের সংসদ অবশেষে সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের চেষ্টা অনুমোদনের জন্যে ভোট দেওয়ার একদিন পরে এই চুক্তির খবর আসে।
A day after Erdogan signed off on Sweden’s NATO accession, the State Department approves the sale of F-16 fighter jets to Turkey (and F-35s to Greece) pic.twitter.com/C9uRSk0H5V
— Piotr Zalewski (@p_zalewski) January 27, 2024
এরদোয়ান সুইডেনের ন্যাটো যোগদানে স্বাক্ষরের একদিন পর পররাষ্ট্র বিভাগ তুরস্কের কাছে এফ-১৬ (এবং গ্রিসের কাছে এফ-৩৫) যুদ্ধবিমান বিক্রির অনুমোদন দেয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমস অনুসারে গত বছরে তুরস্কের সাথে তীব্র আলোচনার সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন কমপক্ষে তিনবার বলেছেন সুইডেনের চেষ্টা অনুমোদন না করলে তুরস্ক চুক্তিটি পাবে না।
সুইডেন কুর্দিপন্থীদের বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী হিসেবে তুরস্কের চিহ্নিত বিভিন্ন ব্যক্তিকে হস্তান্তরের দাবি পূরণ না করা পর্যন্ত তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ও তার ক্ষমতাসীন ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন পার্টি (একেপি) দেশটির জোটে যোগদানের চেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করে।
গত বছর সুইডেনে একজন উগ্র ডানপন্থী রাজনীতিবিদের প্রকাশ্যে পবিত্র গ্রন্থ একটি কোরআন পোড়ানোর ঘটনা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আরো উত্তেজিত করেছিল মাত্র।
সুইডেনের যোগদান প্রচেষ্টার ২০ মাসের বিলম্ব তুরস্কের জন্যে ফলাফল বয়ে এনেছে। রয়টার্সের মতে, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের চুক্তি ছাড়াও তুরস্ক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আঙ্কারার সরকারিভাবে চিহ্নিত কুর্দিস্তান লেবার পার্টি (পিকেকে) ও গুলেন আন্দোলন (এফইটিও) উভয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে (ফিনল্যান্ড ২০২৩ সালের এপ্রিলে জোটে যোগদান করে একই সময়ে ন্যাটো সদস্য হওয়ার জন্যে আবেদন করায়) ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে পেয়েছে।
তবে এই চুক্তিগুলির কোনোটিই রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের কাছে এফ-১৬-এর চুক্তি অর্জনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। পাকা সাংবাদিক আমবেরিন জামান যেমনটি বলেছেন: “সুইডেন সম্পর্কে তুরস্কের অভিযোগগুলি তার আসল লক্ষ্য এফ-১৬ অর্জনের তুলনায় এক রকম ব্যর্থই বলা যেতে পারে।”
সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এরদোয়ান যুদ্ধবিমানগুলিকে আরো গুরুত্বপূর্ণ বলেও ইঙ্গিত করেছিলেন: “আমরা [মার্কিন] এফ-১৬ ও কানাডার [অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার] প্রতিশ্রুতি – উভয় বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি আশা করি, যা সুইডেনের প্রতি আমাদের সংসদের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হতে সাহায্য করবে৷… সব কিছুই পরস্পর সংযুক্ত।”
ন্যাটো সদস্য কানাডা ২০২৩ সালের জুলাই মাসে “অপটিক্যাল সরঞ্জামসহ ড্রোন যন্ত্রাংশের উপর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার বিষয়ে তুরস্কের সাথে আলোচনা পুনরায় চালু করতে সম্মত হয়েছে।”
একটি হতাশাজনক সাফল্য
এরদোয়ানের দাবি সত্ত্বেও যুদ্ধবিমান অর্জনটি কর্মকর্তাদের আশানুরূপ কোনো বড় চুক্তি প্রমাণিত হয়নি। মূলত আরো নতুন ও সক্ষম এফ-৩৫-এর কাছে এফ-১৬ জঙ্গি যুদ্ধবিমানগুলি তাদের জায়গা হারিয়েছে। তুরস্ক ২০১৯ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক এফ-৩৫ যৌথ আক্রমণের যুদ্ধবিমান অংশীদারিত্বের অংশ থাকলেও একই বছর রুশ এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পেন্টাগন তাকে সরিয়ে দেয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস বিবৃতি অনুসারে, পরের বছর, যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের (এসএসবি) সভাপতিত্বের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার মধ্যে “এসএসবি’র সকল মার্কিন রপ্তানি লাইসেন্স ও অনুমোদনের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং এসএসবি’র সভাপতি ড. ইসমাইল ডেমির ও অন্যান্য এসএসবি কর্মকর্তাদের উপর সম্পদ জব্দ ও ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।”
লেখক, শিক্ষাবিদ ও গণতন্ত্র নিরাপত্তা ফাউন্ডেশনের তুরস্ক বিষয়ক অনাবাসিক জ্যেষ্ঠ্য ফেলো সিনান সিদ্দি মনে করেন ন্যাটো জোটের ভেতরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ককে তিক্ত করা ছাড়া তুরস্ক “যোগদান থেকে সুইডেনকে আটকে রেখে কিছুই লাভ করেনি। এরদোয়ান সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানের প্রথম আবেদনের সময় অনুমোদন দিলে এখন অনুমোদিত এফ-১৬ বিক্রয়টি ২০ মাস আগেই অর্জন করা যেতো।”
অথবা অবসরপ্রাপ্ত তুর্কি কূটনীতিক সেলিম কুনেরালপের ভাষায় ঘোড়ায় চড়ার পর তুরস্ক একটি গাধা কেনা স্থির করেছে: “গ্রিসের কাছে অত্যাধুনিক এফ-৩৫ থাকবে, আর আমাদের কাছে ৪০ বছরের পুরনো ‘চেহারা বদলানো’ মডেলের এফ-১৬ থাকবে। আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্যে এফ-১৬ প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত অস্বাভাবিক বিচক্ষণতা দেখানো উপকারী হবে,” একটি উপ-সম্পাদকীয়তে লিখেছেন কুনেরালপ।
তুরস্কের কাছে এফ-১৬ জেট বিক্রির অনুমোদনের সময় তুরস্কের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিসের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ২০টি এফ-৩৫ বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান ২০২২ সালে এথেন্সকে ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকি দেওয়ার সময়ের তুলনায় উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক গত বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কগুলি নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ “তুরস্কের কাছ থেকে এজিয়ান সাগরে গ্রীক সামরিক বাহিনীর সাথে যেকোনো উত্তেজনা হ্রাস” দেখতে আগ্রহী,” লিখেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। তবে এই আশ্বাসগুলো বহাল থাকে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
প্রাক্তন তুর্কি কূটনীতিক ও কার্নেগি ইউরোপ চিন্তাবি্দের একজন জ্যেষ্ঠ্য ফেলো সিনান উলগেন টুইট করেছেন চুক্তিটি নিয়ে “খুশি হওয়া ভুল” হবে। “এই ফলাফল এফ-৩৫ কর্মসূচি থেকে তুরস্ককে বাদ দেওয়ার ক্ষতিপূরণ করতে পারে না।” দেশটির এস-৪০০ কেনার সিদ্ধান্ত “সম্ভবত একে পার্টির পররাষ্ট্র নীতির সবচেয়ে ব্যয়বহুল ভুলের একটি।”
উপেক্ষিত উদ্বেগ
অন্যান্যরা তুরস্কের মানবাধিকার ইতিহাস ও হামাসের প্রতি আঙ্কারার সমর্থন ও রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কসহ অন্যান্য উদ্বেগের তালিকার আলোকে চুক্তির অনুমোদনের সমালোচনা করেছে।
#তুরস্কেরজন্যেযুদ্ধবিমাননয়-এর অধীনে টুইটারে একটি হ্যাশট্যাগ প্রচারাভিযান “যুদ্ধবিমান ব্যবহারের উপায় বেছে নেওয়ার জন্যে আঙ্কারাকে দায়বদ্ধ করার একটি ব্যবস্থা” ছাড়া আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের জন্যে নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে মার্কিন প্রশাসনকে যুদ্ধবিমান বিক্রি করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
তবে তুরস্কের এফ-৩৫ ক্লাবে ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকতে পারে বলে এসবও নিস্ফল হয়ে যেতে পারে। মার্কিন ভারপ্রাপ্ত উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড চলতি সপ্তাহে তুরস্ক সফরে গিয়ে সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন। “আমাদের ইচ্ছে আমরা এই এস-৪০০ সমস্যাটির সমাদ্গান করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এফ-৩৫ পরিবারে ফিরে আসতে স্বাগত জানাতে পেরে আনন্দিত হবে,” ২৯ জানুয়ারি সিএনএনতুর্কি টেলিভিশনে নুল্যান্ড বলেছেন বলে কথিত।<