ইরানে প্রতিরোধ অব্যাহত থাকায় শাসকগোষ্ঠী পাল্টা আঘাত করেছে

 

পেক্সেলের মুক্ত ছবির মাধ্যমে পাওয়া সিমা গাফফারজাদেহের ছবি। ন্যায্য ব্যবহার

নয় মাসেরও বেশি সময় ধরে ইরান বিক্ষোভে প্রকম্পিত যা এখন নারী, জীবন, স্বাধীনতা বিপ্লব নামে পরিচিত। গত ছয় মাসে প্রতিবাদ আন্দোলন হ্রাস পেলেও দেশটিতে ও প্রবাসী ইরানিরা ইরানের ভবিষ্যত নিয়ে একটি রাজনৈতিক সংগ্রামে আবদ্ধ।

পতনের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েও শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে তার টিকে থাকা নিশ্চিতের মরিয়া প্রচেষ্টায় দেশের ভেতর ও বাইরে রাজনৈতিক কর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর আক্রমণ করেছে

ইরানে ভিন্নমতের উপর দমনাভিযান বৃদ্ধি

পশ্চিম ইরানের কুর্দিস্তান প্রদেশে কুর্দিস্তানের মুক্ত জীবন দলের (পিজেএকে) সদস্যদের লক্ষ্যবস্তু করে তেহরান সরকার নতুন করে ইরানে কুর্দিদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন শুরু করেছে। কুর্দিস্তান মানবাধিকার নেটওয়ার্কের প্রতিবেদন অনু্সারে এই অঞ্চলে ইরানি শাসকদের পরিচালিত সামরিক মহড়ার পর এই হামলাগুলো ঘটেছে। অনেকে এই মহড়াগুলিকে শক্তি ও ভীতি প্রদর্শন হিসেবে বিবেচনা করে।

গত শরতে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্ম দেওয়া বিক্ষোভের কেন্দ্রস্থল হিসেবে কাজ করে ইরানের কুর্দি অঞ্চল। ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক কুর্দি গোষ্ঠী সক্রিয়ভাবে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত করে যা বিরোধী কার্যকলাপে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।

শাসকগোষ্ঠীর প্রতিরোধ থামানোর নিরলস প্রচেষ্টায় বন্দীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পন্থা অবলম্বন করায় সশস্ত্র দমন-পীড়নের বৃদ্ধি দেশের কারাগার ব্যবস্থার ভেতরে দমন-পীড়নের ঊর্ধ্বগতির সাথে যুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন এপ্রিল মাসে ইরানে মৃত্যুদণ্ডের পরিমাণ ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অনুমান অনুসারে ইরান ইতোমধ্যে ২০২৩ সালে আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে

গত এক দশকে ইরানের শাসকগোষ্ঠী মাথাপিছু মৃত্যুদণ্ডে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। অনেকে লক্ষ্য করেছে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিয়ে তার ক্ষমতা জাহির করতে একটি ইচ্ছাকৃত কৌশল হিসেবে মাঝে মাঝে জনসমক্ষে শাসকগোষ্ঠী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে

সাধারণভাবেই কুর্দি, বেলুচ ও আরবদের মতো জাতিগত সংখ্যালঘুরা শাসকগোষ্ঠীর এসব মৃত্যুদণ্ডের প্রাথমিক লক্ষ্য হয়ে চলেছে। ঐতিহাসিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক নিপীড়নের শিকার এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলিকে এসব ধারাবাহিক সহিংসতা ও দমন-পীড়নের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

এই বছরের মার্চ মাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি গভীর উদ্বেগজনক প্রবণতা তুলে ধরে বলেছে:

“… জাতিগত সংখ্যালঘুদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে কর্তৃপক্ষগুলি অন্তত একজন আহওয়াজি আরব, ১৪ কুর্দি এবং ১৩ বেলুচির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেছে এবং বছরের শুরু থেকে অন্য অন্তত এক ডজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে, যা মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহারে একটি শীতল বৃদ্ধি চিহ্নিত করেছে।”

ইরানের বিশিষ্ট মানবাধিকার সংস্থা আবদুররহমান বোরুমান্দ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক রোয়া বোরুমান্দ শাসকগোষ্ঠীর এই পদক্ষেপের নিন্দা করেছেন:

“[ইরানি কর্তৃপক্ষের] পদক্ষেপগুলি শুধু জীবনের অধিকারের উপর আক্রমণ ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের একটি নির্লজ্জ প্রচেষ্টা ছাড়াও ভিন্নমতকে রাস্তায় বা ফাঁসির মঞ্চে নৃশংস শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করা হবে এমন ভয় ছড়িয়ে দেওয়া”

ইরান ও পশ্চিমের মধ্যে গতিশীলতার পরিবর্তন

শাসকগোষ্ঠী প্রযুক্ত দমনমূলক কৌশল শুধু ইরানেই সীমাবদ্ধ নয়। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে ইরানের প্রভাব ইউরোপেও প্রসারিত হয়েছে। ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি ইরানের বিরোধী সংগঠন ইরানের জাতীয় প্রতিরোধ পর্ষদ (এনসিআরআই) আয়োজিত একটি পরিকল্পিত প্রতিবাদ বাতিল করেছে। কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদগুলি ইরানি শাসকগোষ্ঠী সংগঠিত সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতার লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে বলে উদ্বেগ দেখিয়েছে।

ফ্রান্সে ইরানি চরদের একই ধরনের ঘটনা লক্ষ্যবস্তু করে বোমা পরিকল্পনার দুই বছর পর এই বাতিলটি করা হয়। ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ১০ জুন ইরানের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসির সাথে ফোনে ৯০ মিনিট কথাবলার কয়েকদিন পরে এবং আলবেনিয়ায় ইরানি ভিন্নমতাবলম্বীদের একটি শিবিরে স্থানীয় পুলিশের অভিযানের ঠিক আগে এটি ঘটে।

আলবেনিয়ার অভিযানটিতে শিবিরের সদস্যদের ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে একজন প্রাণ হারায় ও কয়েক ডজন আহত হয়। অভিযানের পরে জানা যায় শিবির থেকে জব্দকৃত কম্পিউটার সরঞ্জা্মাদি ইরানি কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয় যা সম্ভাব্যভাবে দেশের অভ্যন্তরে ভিন্নমতাবলম্বী নেটওয়ার্কগুলির সম্পর্কে সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করে।

এনসিআরআই সফলভাবে ফরাসী কর্তৃপক্ষের প্রতিবাদ বাতিলের বিরুদ্ধে একটি আইনি চ্যালেঞ্জ করায় নির্ধারিত প্রতিবাদের মাত্র কয়েক দিন আগে প্যারিসের একটি আদালত নিষেধাজ্ঞাটি বাতিল করলেও ফরাসি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত নির্বাসিত ইরানি ভিন্নমতাবলম্বীদের উদ্বেগের একটি বৃহত্তর ক্ষেত্রের কথা বলে।

ইরানের শাসকগোষ্ঠী ও পশ্চিমাদের মধ্যে চলমান আলোচনার প্রেক্ষাপটে একটি পরিবর্তিত দৃশ্যপটে এই ঘটনাগুলি সংঘটিত হয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক চুক্তি ও ইরান সরকারের চাপে প্রভাবিত পশ্চিমা দেশগুলি ইরানি শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতাকারী নির্বাসিত গোষ্ঠীগুলির প্রতি তাদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করছে।

মে মাসে এনসিআরআইয়ের বিরুদ্ধে বোমা হামলার ষড়যন্ত্রে জড়িত এক ব্যক্তির বিনিময়ে ইরান একজন বেলজীয় সাহায্য কর্মীকে মুক্তি দিয়ে বন্দি বিনিময় করে। তাছাড়া, প্রতিবেদনগুলি ইঙ্গিত করে শাসকগোষ্ঠী তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের সাথে “গোপন আলোচনায়” নিযুক্ত। বিদেশে সন্ত্রাসবাদ ও আলোচনার মাধ্যমে ছাড় চাওয়ার পাশাপাশি ঘরে বসে দমন-পীড়নের এই কৌশলগত পন্থা কয়েক দশক ধরে শাসকগোষ্ঠীর টিকে থাকাকে দীর্ঘায়িত করেছে।

নরওয়ে ও হাঙ্গেরিতে ইরানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত আবদুল রেজা ফারাজিরাদের উদ্ধৃতিতে বাতিলকরণটি ইউরোপীয় শক্তিগুলির ইরানের প্রতি ছাড়ের একটি বৃহত্তর সিদ্ধান্তের অংশ যার মধ্যে অভিবাসী ভিন্নমতাবলম্বী সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে অভিযান রয়েছে:

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান একটি চুক্তি চূড়ান্ত করে ফেলায় ইউরোপ পিছিয়ে থাকতে চায় না। সুতরাং, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র যখন একটি চুক্তিতে পৌঁছাবে তখন তারা সহযোগিতার দৃশ্যপট প্রস্তুত করতে চায়।

মাত্র নয় মাস আগেও শাসকগোষ্ঠীর বৈধতার অভাব ও আপাত নিশ্চিত ব্যর্থতার কারণে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও ইরানের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সরাসরি আলোচনা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হতো।

তবে এখনকেউ কেউ এই আলোচনাগুলিকে কেবল শাসকগোষ্ঠীকে বৈধতা প্রদানের ধারনার পাশাপাশি ইরানের ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠস্বরকে দমন করার উপায় হিসাবেও দেখে। বিদ্যমান বর্ণনাটি সম্পূর্ণভাবে বের না হয়ে আসা পর্যন্ত দুর্ভাগ্যবশত পশ্চিম ও তেহরানের মধ্যে ব্যবসার স্বাভাবিক গতিপথ থেকে প্রায়শই মনে হয় ইরানে মানবাধিকারগণতান্ত্রিক পরিবর্তনের লড়াই একটি পাদটীকায় পর্যবসিত হয়েছে।

ইতোপূর্বে সমালোচকরা ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে ভীষণভাবে উপকৃত করা অর্থনৈতিক উদ্ধারের ধরনকে তুলে ধরেছেন। পারমাণবিক চুক্তিজনিত যেকোন নিষেধাজ্ঞার উপশম অসাবধানতাবশত শাসকগোষ্ঠীর জীবনকে দীর্ঘায়িত করার প্রমাণ হিসাবে দেখা যেতে পারে।

উন্মোচিত এসব ঘটনা সত্ত্বেও পরবর্তী অনুঘটকটি প্রতিবাদের পরবর্তী তরঙ্গ উন্মোচন করাটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র এমন বিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়ে দেশে-বিদেশে ইরানিরা সংগঠিত হওয়ার অবিরাম চেষ্টা করছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .