ইরানে বিক্ষোভকারীদের মৃত্যুদণ্ড দিতে ধর্মের বিতর্কিত ব্যবহার

প্রবাসী ইরানি নারীরা ইরানে বিক্ষোভকারীদের মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদ করছে। নারী, জীবন, স্বাধীনতার প্রতিবাদ – ১৭ ডিসেম্বর, ২০২২, অটোয়া, কানাডা। তায়মাজ ভ্যালির ছবি – সৃজনী সাধারণ অনুমতি ২.০

‘যথাযথ হিজাব’ না পরার কারণে পুলিশ হেফাজতে মারধর করায় ২১ বছর বয়সী মাহসা আমিনির মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে “নারী, জীবন, স্বাধীনতা” ব্যানারে দেশব্যাপী বিক্ষোভের পরে একটি কঠোর দমনাভিযানের মাধ্যমে সরকার প্রতিক্রিয়া জানায়। এই দমনাভিযানের ফলে সারা দেশে বিক্ষোভকারীদের দমন, অসংখ্য প্রাণহানি ও হাজার হাজার লোক গ্রেপ্তার হয়েছে।

ইরানে ২০২২ সালে দেশব্যাপী বিক্ষোভের সময় আটক বিক্ষোভকারীদের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে, অন্তত ২৫ জন বিক্ষোভকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে সাতজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে “ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” এবং “পৃথিবীতে দুর্নীতি” এর মতো অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। বিচার কার্যক্রম চলাকালীন তারা প্রায়শই একটি প্রতিরক্ষা অ্যাটর্নি নির্বাচন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এই বিক্ষোভের সময় শত শত বিক্ষোভকারী হতাহত হওয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে অনেকের বিরুদ্ধে ইরানের আইনে অত্যন্ত বিপজ্জনক “মুহারেব” (“যোদ্ধা”) হওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে, যে অপরাধে অভিযুক্ত হলে তারা মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকি বহন করে।

নিরাপত্তার কারণে ছদ্মনাম ব্যবহারকারী ইরানের একজন প্রাক্তন আইনজীবী ফারশিদ কেরমানি গ্লোবাল ভয়েসেসের সাথে একটি ফোনালাপে জোর দিয়ে বলেছেন ইরানের বিচার বিভাগ প্রায়শই “ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” এবং মুহারেব হিসেবে চিহ্নিত করার মতো অভিযোগের উপর নির্ভর করে। এই অভিযোগগুলি ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিসহ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের ইসলামি বিশ্বাসের বিষয়গত উপলব্ধি ও ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভূত।

কেরমানি জোর দিয়ে আরো বলেছেন এই অভিযোগগুলি প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড জারি ও কার্যকর করার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেন:

ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে অংশ নেয়া যেকোন দল বা সংগঠন, সকল সদস্য ও সমর্থকদের পাশাপাশি যারা এই গোষ্ঠীর অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞান রাখে ও এর উদ্দেশ্য এগিয়ে নিতে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখে তাদের মুহারেব বলে গণ্য করা হয়। এমনকি নিজেরা সরাসরি যুদ্ধ কার্যক্রমে জড়িত না থাকা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও এই শ্রেণীবিভাগ প্রযোজ্য।

তবে কেরমানি আরো উল্লেখ করেছেন শুধু কাউকে মুহারেব বিবেচনা করার ভিত্তিতে একজন বিচারক স্বয়ংক্রিয়ভাবে মৃত্যুদণ্ড আরোপ করতে বাধ্য নন:

স্বয়ংক্রিয়ভাবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত না হয়েও একজন ব্যক্তির পক্ষে মুহারেব হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ হওয়া সম্ভব। কোনো ব্যক্তি খুন করলে সে প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য হতে পারে। তবে তাদের কর্মকাণ্ড মুহারেবের দায় বহন করেও হুমকি ও ভয় দেখানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তার জন্যে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড আরো ন্যায়সঙ্গত নয়।

বিক্ষোভকারীদের মোকাবেলার জন্যে নিবর্তনমূলক পদ্ধতির পরামর্শ

বিক্ষোভের কারণে ইরানে ফাঁসি কার্যকর করা প্রথম প্রতিবাদকারী মোহসেন শেকারিকে ৮ ডিসেম্বর, ২০২২ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কুইন্ট ভিডিওর পর্দাছবি। ন্যায্য ব্যবহার।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রথম প্রতিবাদকারী মোহসেন শেকারির ফাঁসি কার্যকরের মাত্র দুই দিন আগে খামেনি রাস্তায় বাধা দেওয়া বিক্ষোভকারীদের “ক্ষত” বলে উল্লেখ করেন। তিনি অশুভভাবে পরামর্শ দেন এই ক্ষতগুলি নিরাময় না হলে তাদের “আগুনে উত্তপ্ত লাল-গরম লোহা” দিয়ে চিকিৎসা করা উচিত।

দুঃখজনকভাবে মোহসেন শেখারিকে রাস্তা অবরোধ ও ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোর বাহিনীর একজন সদস্যকে আহত করার কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

আয়াতুল্লাহ খোমেনির শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠিত কোমের শিশু শিক্ষক সমিতি বিক্ষোভকারীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিচার বিভাগের পদক্ষেপ সমর্থন করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তাদের বিবৃতিতে বিচারকদের প্রতি তারা অন্যান্য প্রতিবাদকারীদের জন্যে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করার জন্যে অতিরিক্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে আরো কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।

কয়েক মাস আগে ইরান জুড়ে বিভিন্ন শহরে রাস্তায় বিক্ষোভ চলাকালে সংসদের ২২৭ সদস্যের স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতিতে বিচার বিভাগকে প্রতিবাদকারীদের মুহারেব আখ্যা দিয়ে “ইসলামি স্টেট সদস্যদের” সাথে তুলনা করে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আহ্বান জানানো হয়। এই প্রদাহজনক বিবৃতিটি বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভের উদ্রেক করে শুধু পরিস্থিতিকে আরো উস্কে দেয়।

ইরানের বিচার বিভাগের সাথে সম্পৃক্ত মিজান সংবাদ এজেন্সির একটি প্রতিবেদন অনুসারে, সংস্থার প্রধান মোহসেনি-ইজে’ই বলেছেন:

আইনের ভিত্তিতে কর্ম ও অপরাধের জন্যে যাদের, মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা উচিত কোন আপস ছাড়াই এবং অবশ্যই ন্যায় ও ন্যায্যতার সাথে তদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে বা হবে।

ইসলামি প্রতিষ্ঠানের ভেতরের বিপরীত দৃষ্টিকোণ

কোম শহর ইরানের সপ্তম বৃহত্তম শহর। ছবি মোস্তাফামেরাজি – নিজের কাজ, সৃজনী সাধারণ অনুমতি একইরকম ব্যবহার ৩.০। ন্যায্য ব্যবহার।

সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে অন্যান্য আলেমরা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তাদের বিরোধিতা করে এগুলিকে ইসলামের নীতি ও ইসলামি শাস্তির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করেছে। এই কণ্ঠস্বরগুলির মধ্যে একটি হলেন নিরাপত্তার জন্যে ছদ্মনাম ব্যবহৃত একজন তরুণ ধর্মগুরু সাদেগ হোসেইনি। কোমে অধ্যয়নরত হোসেইনি বর্তমানে দক্ষিণ তেহরানের একটি মসজিদে খুতবা ও নামাজ পড়েন। সন্ধ্যার নামাজের পর তিনি মসজিদে গ্লোবাল ভয়েসেসের সাথে একটি সাক্ষাৎকারের সময় শান্তভাবে ও শ্রদ্ধার সাথে তার মতামত ভাগাভাগি করেন।

আমরা আশা করি আজকাল আলেমরা নিপীড়নের মুখে নীরব থাকবেন না। অন্ততপক্ষে আমাদের জানানো উচিত সংঘটিত কিছু আচরণ আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ রাস্তায় জড়ো হওয়া বা কারো বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ার কারণে বেশ কিছু যুবকের প্রাণহানি ঘটেছে।

হোসেইনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন জনগণ আলেমদেরকে ইসলামি সরকারের অবিচ্ছেদ্য সদস্য হিসেবে দেখে এবং এই ধরনের বিরোধী কর্মকাণ্ড এই গোষ্ঠীর প্রতি আরো বিদ্বেষ বাড়াতে পারে।

নিরাপত্তার কারণে ছদ্মনাম ব্যবহারকারী তেহরানের একজন আইনি পণ্ডিত আমিন আবেদিনি “বেপরোয়া মৃত্যুদণ্ড প্রদান যুক্তি ও আইন বিরোধী হতে পারে” এমন সমালোচনায় আইনি বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী ও বিচারবিভাগীয় পণ্ডিতদের সাথে কণ্ঠ মেলান। গ্লোবাল ভয়েসেসের সাথে একটি ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে আবেদিনি জনগণের জীবন নেওয়ার সাথে জড়িত গুরুতর ভুল ও অবহেলার উপর জোর দিয়ে বলেছেন এই কাজগুলি “ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাবে না।”

এদেশে জন্মগ্রহণকারী বিক্ষোভকারীদের প্রতি এই কঠোর আচরণ কোথাও প্রসংশিত হবে না। নিঃসন্দেহে অসার ও অনুৎপাদনশীল এই চক্র চলতেই থাকবে। এই ধরনের শাস্তি শুধু নাগরিকদের ক্ষোভ তীব্রতর করার কাজ করে। তবে মনে হয় সরকারের এই ধরনের কর্মকাণ্ডের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তার সমালোচকদের চুপ করানো।

ইরানের মানবাধিকার সংস্থার সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে শুধু ২০২৩ সালে ইরানে মোট ৩৩১ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে যাদের মধ্যে ছয়জন নারী। আশ্চর্যজনকভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্রটি ২০১০ সাল থেকে ৭,৩১৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। অনেক ক্ষেত্রে বিচারকরা ইসলামি আইন মেনে চলার দাবি করেছে।

ইরানের মানবাধিকার কর্মীদের যুক্তিতে মৃত্যুদণ্ড একটি “রাজনৈতিক হাতিয়ার” হিসেবে ব্যবহৃত। তার ওপর ২০২২ সালে “নারী, জীবন, স্বাধীনতা” আন্দোলনের প্রতিবাদ শুরুর পর সেই বছরের শেষ তিন মাসে ৫৮২ জন ইরানি নাগরিকের অর্ধেকেরও বেশি কার্যকর করা মৃত্যুদণ্ড ২০২১ সালের তুলনায়মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।

এই পর্যবেক্ষণগুলি ইঙ্গিত করে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সমর্থিত কর্তৃপক্ষ মাহসা আমিনির মর্মান্তিক মৃত্যু ও তৎপরবর্তী দেশব্যাপী বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করছে।

তবে এটি লক্ষণীয় ইসলামি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আবির্ভূত বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি এই আদালতের রায়গুলিকে ইসলামি নীতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে নিন্দা করে। এই ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর আইনি বিশেষজ্ঞদের সাথে মিলে কীভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থার মধ্যে রাজনীতিবিদরা তাদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায্যতা দিতে বা তাদের উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিতে ধর্মকে কাজে লাগায় তার উপর আলোকপাত করে। এধরনের উদ্বেগ সরকারের উদ্দেশ্য ও সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .