গাজা থেকে খালি পায়ে দেশত্যাগ

হাজার হাজার ফিলিস্তিনিদের অনেকেই জুতা ছাড়া দক্ষিণ গাজায় পালিয়েছে। পর্দাছবিটি ৮ নভেম্বর , ২০২৩ তারিখে ১১ অ্যালাইভের একটি ভিডিও থেকে নেওয়া। ন্যায্য ব্যবহার।

একটি বিষয়বস্তু ভাগাভাগি চুক্তির অংশ হিসেবে মূলত ৩০ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে রাসিফ২২-এ প্রকাশিত দোয়া শাহিন লিখিত এই নিবন্ধটির একটি সম্পাদিত সংস্করণ গ্লোবাল ভয়েসেসে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

ইসরায়েলি দখলদার কর্মকর্তা পূর্ব গাজার সাবরায় একটি আবাসিক ভবনের বাসিন্দাদের বোমা ফেলার আগে খালি করার জন্যে সতর্কতা হিসেবে “মাত্র পাঁচ মিনিট” সময় দিয়েছিল।

বিমান হামলায় কারা মারা যাবে বা বেঁচে থাকবে তাদের জন্যে কোন উদ্বেগের অভাবে দৃশ্যটি শেষবিচারের দিনে পরিণত হয়। পালানোর সময় আমরা উপযুক্ত জুতা পরার কথা ভাবি না। ভারাক্রান্ত হৃদয় ও উদ্বেগে আমরা আমাদের জিনিসপত্র ও বাচ্চাদের বহনের কারণে আমাদের পায়ে হেঁটে কতো কিলোমিটার ভ্রমণ করতে হবে সে সম্পর্কে আমরা চিন্তা করি না। আমরা শুধু বেঁচে থাকার চিন্তা করি। তবে প্রথম কয়েক কিলোমিটার হাঁটার পরে আমাদের পায়ের ব্যথা আমাদের হৃদয়ের ব্যথাকে ছাপিয়ে যেতে শুরু করে।

পালানোর সময় জুতো ছিঁড়ে গেলেও লক্ষ্যবস্তু হওয়ার ভয়ে ঠিক করার জন্যে না থামা শিশু, বাস্তুচ্যুতির সময় পা ফোসকা পড়া সেই দুই বছরের মেয়ে, সন্তানদের নিয়ে যাওয়ার সময় জুতা পরতে ভুলে যাওয়া পিতামাতার প্রশ্ন একই: মৃত্যু থেকে পালানোর উপযুক্ত জুতা কী?

নীচের ভিডিওতে শিশুটি বর্ণনা করেছে জীবন বাঁচাতে দৌড়ানোর সময় কীভাবে তার জুতা ছিঁড়ে গেলে ঠিক করার জন্যে থামতে না পেরে খালি পায়ে দৌড়াতে গিয়ে তার পায়ের বেশ ক্ষতি হয়:

খালি করো, খালি করো, খালি করো

সবাই চিৎকার করছিল, ” খালি করো, খালি করো, সরে যাও।” লোকেরা হাতে কোন জিনিসপত্র না নিয়ে ঘরের পোশাকেই ছুটে আসে। নারীরা বিধ্বস্ত আর শিশুরা কাঁদছিল। আর পুরুষেরা তাদের সন্তানদের পিঠে নিয়ে তক্ষুণি পালিয়ে যায়।

ত্রিশে থাকা মোহাম্মদ রাদি ও তার তিনজনের পরিবার তাদের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে বোমা হামলা থেকে বেঁচে যায়। সময়মতো পালাতে না পারা অন্যান্য প্রতিবেশীরা বোমা হামলায় ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে। রাদি রাসিফ২২কে বলেন: 

আমি আমার একজন প্রতিবেশীর দ্রুত সরে যেতে বলা বোমা হামলার সতর্কবার্তা শুনতে পাই। সেই সময়ে আমি আমাদের দুপুরের অর্ধভূক্ত খাবার তেমনি রেখে তাড়াহুড়ো করে আমার বাচ্চাদের নিয়ে পালিয়ে যাই। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে লিফটটি কাজ না করায়, আমাদের পরিচয়পত্রের কাগজের ব্যাগসহ আমার স্ত্রী ও আমরা পায়ে হেঁটে নিচতলায় নামতে শুরু করি।

তবে সরে যাওয়ার পরপরই রাদি তার খালি পায়ে থাকা টের পায়।

চতুর্থ তলায় পৌঁছেই আমি বুঝলাম যে আমি জুতা পরিনি। দ্রুত ফিরে গিয়ে আমি বিদ্যুৎগতিতে আমার দ্রুতচলার হালকা ওজনের চামড়ার তৈরি বাথরুমের জুতাগুলি নিয়ে নিই। বিকল্প খোঁজার সময় না পেয়ে  আমার স্ত্রী তার ঘরের চপ্পল পরেই পালিয়ে আসে।

রাদি ও তার তরুণ পরিবার গন্তব্য নিশ্চিত না করে পিছনে না ফিরেই তাদের ভবন ছেড়ে চলে যায়। তাদের মাথার ওপরে বোমার বিস্ফোরণ আর পায়ের নীচে ছিন্নভিন্ন কাঁচ, পাথর ও পতনশীল বোমার আগুন ছিল।

বাস্তুচ্যুতির সময় তাদের জুতা ছিঁড়ে যায়

রাদির স্ত্রী কিছুক্ষণ থেমে চেষ্টা করেও ছিঁড়ে যাওয়া চপ্পল ঠিক করতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত তিনি একটি চপ্পল পরেই যাত্রা চালিয়ে যান। আশ্রয়ের জন্যে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে পৌঁছাতে গিয়ে তার স্ত্রীর মারাত্মকভাবে আহত পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা হলো। তিনি কোনো চিকিৎসা সহায়তা ছাড়াই কফি দিয়ে তার পায়ের চিকিৎসা করে কাপড়ের টুকরো দিয়ে এটি ব্যান্ডেজ করে নেন।

এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাওয়া গাজাবাসীদের কাছে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান ও বোমা হামলার মুখে জুতা অগ্রাধিকারযোগ্য নয়। তাদের অগ্রাধিকার টিকে থাকা। নিহত একজনের জুতা দিয়ে কি লাভ? এবং উপযুক্ত জুতা থাকলেও জনগণ হয়তো তার ধরন, রঙ বা আকৃতি বাছাই করতে নাও পারতে পারে। সেই জরুরি মুহুর্তে জীবন-মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়ে কোনো পুরুষ যদি কোনো নারীর জুতা পরে বা তার উল্টোটা ঘটলেও তা আসলে কোন ব্যাপার না। আর শিশুদের অধিকাংশই খালি পায়েই পালিয়ে যায়।

‘আমি আমার বাচ্চাদের জন্যে খেলার জুতা তৈরি রেখেছি’

দখলদারেরা উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণে উম্মে রামিকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে। তিনি তার পরিবারের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র প্রস্তুতের সময় মৃত্যু থেকে বাঁচতে তাদের যাত্রার জন্যে উপযুক্ত পাদুকা বেছে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

রাসিফ২২ এর সাথে ৪০ বছর বয়সী মা কথা বলেছেন। তিনি তার সন্তান রামি ও হায়দারের জন্যে ফিতাবিহীন জুতা বেছে নেওয়ার কথা বলেন। বিশেষ করে গাজায় উত্তর-দক্ষিণ চলাচলের জন্যে দখলদার নির্দিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ভূখণ্ডের সবচেয়ে মারাত্মক রুটের একটি হিসেবে পরিণত সালাহ আল-দিন সড়কে ফিতা বাঁধতে এক মুহুর্তের জন্যে থামলেও তাদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। উম্মে রামি ব্যাখ্যা করেন:

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের গাজার উত্তরে আল-ফালুজায় আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে। নারকীয় রাতটিতে ইসরায়েলি বাহিনী আমাদের চারপাশে পটকা বিস্ফোরণ করে। চরম আতঙ্ক ও ভয়ে আমরা আমাদের দোরগোড়ায় মৃত্যুকে অনুভব করেছি। ভোর হওয়ার পরে, আমরা কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে আমাদের ও বাচ্চাদের জুতা প্রস্তুত করি।

মা ধুলো মুছে গোড়ালি ছাড়া কালো চামড়ার বুট পরে নিলেন।

ক্লান্ত পরিবারটি উত্তরে তাদের বাড়ি থেকে গাজার কেন্দ্রে দেইর আল-বালাহ পর্যন্ত হেঁটেছিল। তিনি ভাগাভাগি করেছেন:

আমরা দখলদার ট্যাঙ্কগুলির সামনে দিয়ে প্রায় ছয় কিলোমিটার পায়ে হেঁটেছি। তারা কখনো কখনো আমাদের থামিয়ে হাত তুলে মাটিতে শুয়ে থাকার নির্দেশ দিতো। অন্যান্য পয়েন্টগুলিতে তারা আমাদের সাদা পতাকা ও পরিচয়পত্র তুলে ধরতে বলতো। প্রস্তুত ছিলাম বলে সতর্কতার সাথে আমরা উপযুক্ত জুতা পরেছিলাম।

ইসরায়েলি দখলদারদের সর্বশেষ চেকপয়েন্ট অতিক্রমের পর পরিবারটি তাদের মধ্য গাজার বাস্তুচ্যুত এলাকায় নিয়ে যেতে একটি পশু-টানা গাড়ি খুঁজে পায়। সেখানে তাদের ক্লান্ত পা আর হাঁটার ভার সহ্য করতে না পারায় একবার তারা মাটিতে ধসে পড়ে; আর দীর্ঘ যাত্রায় তাদের জুতো পাতলা হয়ে যায়।

আমি খালি পায়ে পালিয়ে এসেছি

যুদ্ধের মতো কষ্টও চলতে থাকে। পূর্ব গাজার শুজাইয়্যার ২০ বছর বয়সী নূর মোহসেন ১২ সদস্যের পরিবারের সাথে দক্ষিণে রাফাহতে পালাতে বাধ্য হয়। গাজায় যুদ্ধ শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মোহসেন একাধিকবার বাড়ি ছেড়ে প্রতিবার ইসরায়েলি দখলদার বোমা হামলায় মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে এসেছেন। মোহসেন রাসিফ২২-কে বলেছেন:

প্রথমে আমরা নাসর এলাকায় আমাদের আত্মীয়দের কাছে পালিয়ে যাই। তাড়াহুড়ো করে এবং ভয়ে পঙ্গু হয়ে আমি জুতাও পরিনি। গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার একটি বাহন খুঁজে পাওয়ার আগে আমাদের অর্ধেকটা পথ হেঁটে যেতে হলো। প্রথম রাতে আমাদের পাশের বাড়ি লক্ষ্য করে ইসরায়েলি বোমা হামলা হলে আমরা আবার পালিয়ে যাই। আমাকে আমার চাচাতো ভাই তার ব্যবহৃত এক জোড়া খেলাধুলার জুতা দিলেও সেগুলি আমার পায়ের জন্যে খুব ছোট ছিল। অনেক ব্যাথা দিলেও সেগুলি খালি পায়ে থাকার চেয়ে ভাল ছিল। মনে হচ্ছে মৃত্যু আমাদের অনুসরণ করছে। বাড়ি ছাড়ার তৃতীয় দিনে ইসরায়েলি বিমান আমাদের থাকা আবাসিক এলাকায় বোমাবর্ষণ করে। অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলে আমরা জুতো ছাড়াই আবার পালিয়ে গিয়েছিলাম।

উপসংহারে তিনি বলেন, “আমি জুতা পরার বিষয়ে চিন্তা করিনি। আমি মরে গেলে তারা কি কাজে লাগবে? তারা আমাদের উপর বর্ষিত রকেট থেকে আমাকে রক্ষা করবে না। আমি মারা গেলে জুতা ছাড়াই কবর দেওয়া হবে।“

যুদ্ধের আগে মহসেনের পছন্দের জুতা ছিল এক জোড়া সাদা উঁচু-গোড়ালীর বুট। তাদের জন্যেএগুলির আর কোন ব্যবহার নেই, তার বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং তার সমস্ত জিনিসপত্র আগুনে পুড়ে গেছে।

একবার মোহসেন ও তার পরিবার রাফাতে বসতি স্থাপন করলে তার মা তাকে শীতের জন্যে এক জোড়া রঙিন চামড়ার বুট দিয়ে অবাক করে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা সেগুলি বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর থেকে তার জিন্স ও একটি রঙিন সোয়েটারের সাথে ভালভাবে মাননসই এবং সহজে চলাফেরা করার জন্যে হালকা। তরুণীটি এই পোশাকে থাকতে পছন্দ করে কারণ এগুলি তাকে তার হারানো অবলম্বনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .