ভাগ্যবান গাজাবাসীর একটি রোজনামচা?

তরমুজের টুকরো ফিলিস্তিনি আদর্শের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এর লাল মাংস, সবুজ-সাদা এবং কালো বীজ ফিলিস্তিনের পতাকার সকল রঙকে ঘিরে রেখেছে। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ইসরায়েল ফিলিস্তিনি পতাকা প্রদর্শন নিষিদ্ধ করলে ফিলিস্তিনিরা বুদ্ধিমত্তার সাথে তরমুজটিকে প্রতীকী সমাধান হিসেবে গ্রহণ করে। র‍্যান্ট ৭৩ – ডিজিটাল জাদুঘর এর শিল্পকর্ম, ফ্লিকার। ১০ নভেম্বর, ২০২৩-এ আপলোড করা হয়েছে। প্রকাশ্য ডোমেন

গাজায় ইসরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণের একটি ব্যক্তিগত বর্ণনা হিসেবে নাওয়ার দিয়াবের লেখা এই গল্পটি প্রথম ১৬ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে আমরা সংখ্যা নই-এ প্রকাশিত হয়। যুদ্ধের একজন সাক্ষীর প্রকাশ্য সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপিত অসম্পাদিত গল্পটি একটি বিষয়বস্তু ভাগাভাগি চুক্তির অংশ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে।

কাচ ভাঙার বিপদ এড়াতে জানালা সবসময় খোলা। প্রতিদিন সকালে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় ঘরের চারপাশে একটি মাছির অস্বস্তিকর গুঞ্জনে। এটি আমার কানের কাছাকাছি এলে ক্রমেই জোরে বাজে। খুব কম হয় বলে ঘুম আমার কাছে খুব মূল্যবান। তাই একটি পোকার জন্যে এর থেকে বঞ্চনা বিরক্তিকর।

দাদার ব্যাটারি চালিত রেডিওসহ নাওয়ার। আমরা সংখ্যা নই’কে দেওয়া নাওয়ার দিয়াবের ছবি, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

আমি উঠে বিরক্ত বোধ করি। অবাক হচ্ছি কীভাবে আমি আমার দাদার বিরক্তিকর রেডিওর শব্দের মধ্যেই ঘুমাতে পেরেছি। গাজার প্রতিটি পরিবারের একই ব্যাটারি চালিত রেডিও আছে। বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট না থাকলেও এটি আমাদের তথ্যের উৎস।  প্রতিনিধিত্বের কারণে সত্যিই আমি রেডিওটা ঘৃণা করি। আমরা শুধু আক্রমণের শিকার ও আমাদের ভালোবাসার মানুষদের মৃত্যুর সময়ে ব্যবহার করি বলে এটি আমাকে খুব উত্তেজিত করে।

বাথরুমে গিয়ে আমি কোকাকোলার এক বোতলে ভরা জল ব্যবহার করে আমার মুখ ধুয়ে ফেলি। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে বোতলের অবশিষ্ট অল্প জল দিয়ে কফি বানাতে যাই। আমি একা রান্নাঘরে বসে অপরাধবোধ নিয়ে সেটা পান করি — কারণ জল খুবই দুষ্প্রাপ্য এবং কিছু লোক কিছু পান না করে দিন কাটাচ্ছে।

তারপরেই আমার দৈনন্দিন রুটিনের সবচেয়ে কঠিন অংশ। এখনো বেঁচে আছে কিনা জানতে আমি একে একে আমার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করি। তাদের বার্তা পাঠানো শুরু করার আগে আমার নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হয়। বৃথা জানলেও আমাকে অভ্যাসের বাইরেই এটা করতে হয়। কখনো প্রতিক্রিয়া পাব কিনা ভেবে আমি খুব উদ্বিগ্ন বোধ করছি।

আমি আমার সেরা বন্ধু মায়মানাকে ফোন করতে থাকি কারণ আমি শুনেছি তার বসবাসের এলাকায় বোমা হামলা হয়েছে। ত্রিশবার চেষ্টা করার পরেও তার ফোন বাজছে না। তার কোন সংযোগ নেই। তার নিরাপত্তা শঙ্কায় আমার হৃৎকম্প শুরু হয়েছে। আমি বারবার নিজেকে বলতে থাকি এটা ঠিক হয়ে, সংযোগ পেলেই সে আমাকে আবার কল করবে।

অবশেষে, আমার পরিবারের বাকিরা জেগে ওঠে। আমি আর একা নই। আমরা একসাথে বসে আমাদের প্রতিদিনের কথা বলি যে গতরাতে ইসরায়েল বোমাবর্ষণ করেছে। সেই মূল্যবান তিন ঘণ্টার ঘুমের সময় কী ঘটেছে তা বোঝাই আমাদের সকালের কাজ।

আমরা ১৪ জন এক আত্মীয়ের বাড়িতে একসাথে থাকি। আমাদের প্রত্যেকের সকালে করার একটি করে কাজ আছে। পুরুষরা বেকারিতে গিয়ে কিছু রুটি খোঁজার চেষ্টা করে। তারপরে তারা জল ভরতে খালি বোতল ও পাত্রগুলি কূপের কাছে নিয়ে যায়। এদিকে নারীরা থালাবাসন, মেঝে পরিষ্কার ও দুপুরের খাবার তৈরি করতে শুরু করে।

দুপুরের খাবার নির্ভর করে রুটির প্রাপ্যতার উপর। বেশিরভাগই থাকে না। সীমিত হলেও অন্তত আমাদের বিকল্প আছে। কেউ কেউ এতো ভাগ্যবান নয়, আমরা অপুষ্টির শিকার লোকদের কথা শুনি।

ফোনকলে আমার মাকে কান্নার মতো শোনায়। ঠিক আছেন কিনা আমি জানতে চাইলে তিনি আমাকে ঠিক থাকার কথা বলেন। আমি জানি তিনি আমাকে মিথ্যে বলছেন। মামা ফোনটা নিয়ে অন্য ঘরে নিয়ে গেলে আমি তখনই বুঝতে পারি কিছু একটা ভুল আছে। দিনের বাকিটা সময় আমার মন ভারি বোধ করে। আমি বুঝতে পারছি আমার পরিবার অদ্ভুত আচরণ করছে এবং আমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে রেখেছে।

আমরা সারাদিনে সীমিত সময়ের জন্যে ইন্টারনেট সংযোগ পাই। প্রতিবার পুনঃসংযোগ করে আমি আমার বন্ধুদের টেক্সট করতে, অনলাইনে খবর চেক এবং আমাদের সাথে কী ঘটছে সে সম্পর্কে সামাজিক মিডিয়াতে পোস্ট করতে ছুটে যাই। আমাদের উপর হামাস ও ৭ অক্টোবর সম্পর্কে একই প্রশ্ন  বর্ষিত হচ্ছে। এটি আমাদের সাথে কী ঘটছে সে সম্পর্কে পশ্চিমা মিডিয়ার বোঝার সম্পূর্ণ অভাব প্রদর্শন করে।

ইন্টারনেট সংযোগ আবার বিচ্ছিন্ন। তাই এই সংগ্রামের মধ্যে কী ঘটছে বোকা রেডিও সংবাদ প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমাদের জানানোর সময় বসবাসকারী অন্যান্য সাধারণ ফিলিস্তিনি পরিবারের মতো আমরাও তাস খেলি।

আমি আমার পরিবারকে তাদের জানা কোনো কিছু আমারো জানা দরকার কিনা জিজ্ঞাসা করার কথা ভেবেও পিছিয়ে যাই,পাছে খবরটি হয়তো আমার হৃদয় ভেঙে দেবে। পরিবর্তে বারান্দায় গিয়ে আমি আমার প্রিয় ফারাজ সুলেমানের পুনর্গঠনের গান শুনি। মনে হয় এই গানটা এমন একজনের সাথে কথা বলে যে আমার কষ্ট বোঝে।

এক বন্ধুর ফোন কলে আমার নির্জনতা ভেঙ্গে যায়। ফোন তুলে সংযোগ না পেয়ে আমি ছেড়ে দিই। গানটি শুনতে শুনতে আমি নিজেকে বলি সবকিছু ঠিক আছে। আমি জানি এটা মিথ্যা। আমার পেটে অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে।

নাওয়ার (বামে) সর্বশেষ ইসরায়েলি যুদ্ধে গাজায় নিহত তার সেরা বন্ধু মায়মানার সাথে। আমরা সংখ্যা নই’কে দেওয়া নাওয়ার দিয়াবের ছবি, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

আমার ফোন আবার বেজে উঠলে ধরে সংযুক্ত হয়ে দেখি এটা সেই বন্ধু। “মায়মনা ও তার পরিবারকে কি সত্যিই হত্যা করা হয়েছে?” আমার হৃদয় চুপসে গিয়ে শতধা হয়ে যায়। “না না. কে বলেছে এটা?” আমি জবাব দিলেও আমার চোখ জলে ভরে যায়। “সবাই,” তিনি আমাকে উত্তর দেন। আমি চিৎকার করি, আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে শুরু করে।

সে আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল। আমি কাউকে তার মতো ভালোবাসিনি। সেই মুহুর্তে আমার মনে হলো আমি সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। পরের দিন নিহত হতে যাওয়া কারো সাথে আপনি কিভাবে কথা বলতে পারেন, এটা কষ্ট দেয়। আমাদের ভাগাভাগি করা স্মৃতি আমার মনে আবার জেগে ওঠে। আমি তার হাসি শুনতে পাই। আমার তার মায়ের সাথে গাড়িতে গান গাওয়ার কথা মনে হয়। এতোটা মানার মতো নয়, আমি ভেঙ্গে পড়ি।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই দ্বিতীয়বার আমি প্রিয়জন হারানোর খবর পাই। প্রথমবার ছিল আমার প্রিয় বন্ধু আব্রাহাম। সে অন্য কারো থেকে আলাদা: মজার, চতুর ও বড় মনের। এই ধরনের খবর পাওয়ার আমি আমার অনুভূতি বর্ণনা করতে পারবো না। ফেলে দেওয়া থালার মতো এটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

রাতে এটি সবসময় খারাপ হয়। তখনই শুরু হয় ভয়াবহতা। নিরাপদ বোধ করায় আমরা সবাই একই ঘরে একসাথে ঘুমাই। প্রচণ্ড বোমা হামলা ও রেডিওতে সংবাদ প্রতিবেদনের শব্দে আমি ঘুমানোর চেষ্টা করি। আমার চোখ  ক্রমেই ভারী হয়ে আসায় আমার মন শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিলে আমি ঘুমাতে যাই।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘরের চারপাশে কোনো বিরক্তিকর গুঞ্জন নেই। রাতভর বোমা বিস্ফোরণে মাছিটি ভয় পেয়ে গেছে। দাদার রেডিও শুনে হৃদয়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট আরেকটিদিনের মুখোমুখি হতে আমি আবার জেগে উঠি।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .