বার্তাও যখন বন্ধ হয়ে যায়

প্রশিক্ষণের জন্যে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি সভায় ১৮তম আমরা সংখ্যা নই (ডাব্লিউএএনএন) দলে গাজা-ভিত্তিক অংশগ্রহণকারীরা। বেইত লাহিয়া শহরে পারিবারিক বাড়িতে ১৪ অক্টোবর, ২০২৩-এ ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত ইউসেফ দাওয়াস ছবিটি তুলেছিলেন। ডাব্লিউএএনএন-এর ছবি, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

আমার ফোন ক্রমাগত ৭ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত বেজেছে, গাজা ভূখণ্ড থেকে বেঁচে থাকা ও শীঘ্রই মারা যাওয়ার আশঙ্কা করা মানুষের কান্নার টুকরো টুকরো বার্তা ও ভিডিও এসেছে। রাস্তাগুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত এবং যানবাহনের জন্যে জ্বালানী প্রায় নিঃশেষের পর দক্ষিণে (কোথায়?) সরানোর ইসরায়েলি নির্দেশনা স্বত্ত্বেও চিকিৎসা সহকর্মীরা উত্তরে তাদের হাসপাতালে কাজ করতে থাকে। অন্যরা কেবল দক্ষিণে গিয়ে বোমা হামলার শিকারে পরিণত হতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন (এখন গাজার ভেতরে আটকে গিয়ে অথবা প্রবাসে থাকায়) কিছু সহকর্মী উদ্বেগে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিশুদ্ধ পানি ছিল না, এমনকি রুটি পাওয়াও কঠিন ছিল।

বার্তাগুলি ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমার স্বেচ্ছাসেবী পরামর্শদান কর্মসূচি আমরা শুধু সংখ্যা নই এর তরুণ লেখকরা এক মুহুর্তের জন্যে ইন্টারনেট সংযোগ পেয়ে হতাশাজনক, হৃদয়বিদারক বার্তা পাঠিয়েছে। এই ষষ্ঠ যুদ্ধে অতীতের আঘাতগুলি পুণরায় উঠে এসে তাদের তারুণ্যের আশা-উদ্দীপনাকে ইতোমধ্যে যুদ্ধাহত অস্তিত্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতালব্ধ ভয় ও ভীতিতে স্তরীভূত করে রাখছে।

ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণে আমাদের প্রকল্প তিনজন লেখককে তাদের বহু প্রজন্মান্তরের পরিবারসহ হারিয়েছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে অন্তত একজনকে জীবিত উদ্ধার এবং একজন কবিকে গ্রেপ্তার ও মারধর করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে আমরা আমাদের নৈতিক মানদণ্ড ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান হারিয়ে ফেলেছি। হামাসের ভয়াবহ হামলার ক্ষোভ ও শোকে অনেকেই ভুলে গেছে গাজাবাসী ৫,৫০০টিরও বেশি শিশু হত্যা করে একটি ইসরায়েলি শিশুরও জীবন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ইসরায়েলি কর্মকর্তা ও আমাদের কংগ্রেসের কিছু লোকের গোঁড়া মন্তব্য স্বত্ত্বেও আমরা ভুলে গেছি এই শিশুরা সকলেই মূল্যবান ও তারাও মানুষ আর আসলে তারা সবাই নির্দোষ।

হঠাৎ ২৮ অক্টোবর মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর ইনস্টাগ্রাম ভিডিও ছাড়া গাজা থেকে বার্তাগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। তীব্র বিমান হামলায় যোগাযোগের সকল পদ্ধতি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ায় ল্যান্ডলাইন, মুঠোফোন বা ইন্টারনেট নেই। এখন চুঁইয়ে চুঁইয়ে বার্তা আসে।

“দুর্ভাগ্যবশত, আমি এখনো শ্বাস নিচ্ছি।”

“আমি কিছু লেখার চেষ্টা করবো।”

“… ভয়ঙ্কর কিছু দিন।“

বেসামরিক জীবন বিবেচনায় যোগাযোগের এই সীমাবদ্ধতা ভীতিকর কিছু বোঝায়: কেউ অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে বা কোনো আত্মীয়কে দেখতে, প্রসবোন্মূখ নারীরা কোথাও যেতে; উদ্ধারকর্মীরা যোগাযোগ, হাসপাতাল জরুরি সহায়তায় ফোন করতে পারে না, মানবিক সংস্থাগুলি দ্রুত স্থবির হয়ে পড়ে। স্থানীয় সাংবাদিকরা নৃশংসতার নথিও পাঠাতে পারেনি।

আমি জানতে পারছি না আমার সাথে কাজ করা যেসব স্বাস্থ্যকর্মী বা তরুণ লেখকের জন্যে কষ্ট পেয়েছি, আশান্বিত হয়েছি তারা এখনো বেঁচে আছে, বা জল, রুটি, আশ্রয়, প্রিয়জনদের সন্ধানে, নাকি ধ্বংসস্তূপে ছুঁড়ে ফেলা কবরে সমাহিত। হাসপাতালগুলিতে ফুরিয়ে গেছে মরফিন, রোগীরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো জ্বালানি নেই। কোনো শয্যা না থাকায় করিডোরের মেঝেতে রোগীদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। যাওয়ার জন্যে নিরাপদ কোনো জায়গা বা তাদের নেওয়ার মতো কোনো চিকিৎসা সুবিধা এবং তাদের পরিবহনের কোনো জ্বালানি বা অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত না থাকা স্বত্ত্বেও ইসরায়েল হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্সগুলিতে বোমা ফেলছে, রোগী ও কর্মীদের চলে যেতে বলছে। হাসপাতালগুলিতে “হামাস সন্ত্রাসবাদী ও সুড়ঙ্গ” থাকার দাবি বা আশ্রয়দানের “প্রমাণ” হাসপাতালের কর্মীরা তুচ্ছ করেছে। হাসপাতালের নিচে সুড়ঙ্গ থাকলেও সেখানে বোমা হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

আমাদের সরকার তেমন উদ্বিগ্ন বলে মনে হয় না। ৪৪তম দিনে ১৩,০০০রও বেশি নিহত হলে কমিয়ে বলার নির্মম চেষ্টায় মৃত্যুর সংখ্যার যথার্থতাকে বাইডেন প্রশ্নবিদ্ধ করেন। প্রতিক্রিয়ায় প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার জন্যে নাম, বয়স, লিঙ্গ ও পরিচয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশ করে। এখন এই সংখ্যার একেকটি জীবন একটি পরিবার, প্রিয়জন, শোকে মোড়ানো মৃতদেহসহ একজন ব্যক্তি।

অনেকের সন্দেহ “হামাসকে ধ্বংস করার” জন্যে ইসরায়েলের ব্যাপক বোমাবর্ষণ আসলে গাজাকে জনশূন্য করে এর জনগণকে সিনাইতে স্থানান্তরিত করার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আশীর্বাদপুষ্ট একটি পরিকল্পনা হতে পারে। একে বলা হয় জাতিগত নিধন। গাজার উপকূলে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ নিয়ন্ত্রণে ইসরায়েলের আগ্রহের খবরও রয়েছে। সামরিক-শিল্প-জীবাশ্ম-জ্বালানির যৌথ অভিযান।

মার্কিন কংগ্রেসের নৈতিক স্খল্নের কারণে আইন অমান্য ও রাস্তায় বিক্ষোভ হচ্ছে। নিউইয়র্কের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন ও পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত শহরগুলি থেকে হাজার হাজার জনগণ এসে দেশটির রাজধানীতে প্রায় ৩ লক্ষ জড়ো হয়। আমাদের শান্তির জন্যে ইহুদিকণ্ঠের একটি দল সিয়াটলে ফেডারেল বিল্ডিং বন্ধ করে দিয়েছে; দুই সপ্তাহ পরে আমরাও স্পেস নিড্‌ল বন্ধ করে দিয়েছি। কিছু জরিপ অনুসারে বেশিরভাগ মার্কিন নাগরিক যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন করে। ফোন কল ও ইমেলগুলি কংগ্রেসে “এখনই যুদ্ধবিরতি” বার্তা দিয়ে আসছে। একটি দেশ হিসেবে সম্ভবত আমরা ৯/১১-এর প্রতি আমাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়কর প্রতিক্রিয়া থেকে কিছু শিখলেও সম্ভবত আমাদের নির্বাচিত নেতারা তা করেনি।

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামাসকে ধ্বংস করার আহ্বান বাস্তবতাকে অস্পষ্ট করে তোলে যে হামাস কেবল যুদ্ধাপরাধকারী একটি জঙ্গি বিদ্রোহ নয়, বরং কয়েক দশকের ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, অবরোধবর্ণবাদী নীতি থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিরোধের আদর্শ। ইসরাইল এর আগেও গুহায় বোমা ফেলেছে, এর আগেও “হামাসকে ধ্বংস” করার শপথ নিলেও জঙ্গি প্রতিরোধের যোদ্ধারা আরো শক্তিশালী, ভালোভাবে অর্থায়িত ও চৌকস  হয়ে ফিরে এসেছে। মতাদর্শের শেকড়ের সমাধান না হলে আদর্শকে পরাজিত করা যায় না। অবরোধ ও দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে, বর্ণবাদী ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে, ফিলিস্তিনি জনগণের জন্যে একটি কার্যকর ও ন্যায্য ভবিষ্যতের আলোচনার জন্যে এবং এই অঞ্চলে অস্ত্রের অবিরাম প্রবাহ বন্ধ করতে ইসরায়েলকে চাপ দেওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব।

অনেকেই অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবস্থা করার আহ্বান জানাচ্ছে। তারা শুধু আমাদের দেওয়া অর্থে কেনা অস্ত্র দিয়ে আবার বোমা হামলার সুযোগের জন্যে বেসামরিক জনগণের সংক্ষিপ্ত পুনরুদ্ধারে একটি “মানবিক বিরতির” আহ্বান করছে না। একটি যুদ্ধবিরতি বেসামরিক জিম্মিদের মুক্তির সুযোগ দেবে, তা নাহলে ইসরায়েলি বোমায় হামাসের টানেলে তাদের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গাজার ২৩ লক্ষ জনগণ ও হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বন্দী সবাই ইসরায়েলের যুদ্ধযন্ত্রের কাছে জিম্মি। একটি পূর্ণ যুদ্ধবিরতি ইসরায়েলি সৈন্যদের বন্দী বিনিময়ের আলোচনার, গুরুতর মানবিক সহায়তা শুরুর এবং এই ট্র্যাজেডির মূল কারণগুলিকে সম্মানের সাথে মোকাবেলায় মনোনিবেশ করার সুযোগ দিতে পারে। সমাধানগুলিকে অবশ্যই ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ ও ফিলিস্তিনিদের পরাধীনতা বজায় রাখতে এখনকার আলোচ্য বসতি স্থাপনকারী ঔপনিবেশিক প্রস্তাবের ধারাবাহিকতার বাইরে বেরুতে হবে।

এমনকি নেতানিয়াহু “শক্ত প্রতিশোধের” কথা বলেছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সরকারগুলি তোতাপাখির মতো ইসরায়েলি সরকারের দাবি “ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে” আওড়াচ্ছে। এর ফল হলো আন্তর্জাতিক আইনের একাধিক লঙ্ঘনসহ লাঞ্ছনা, আঘাত ও শোক সৃষ্ট একটি ক্রোধপূর্ণ প্রতিশোধ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মানসিক আঘাত, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও বর্জনের মধ্যে জন্ম নেওয়া ফিলিস্তিনিদের একটি নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি। স্থল আক্রমণ চলতে থাকায় আরো হাজার হাজার ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলি আহত ও নিহত হবে এবং লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, মিশর ও সম্ভবত ইরান তাদের ফিলিস্তিনি ভাইবোনদের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে আরো বেশি কিছু করতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।

গাজায় অনেকের আত্মীয় থাকা ইসরায়েল ও অঞ্চলগুলির ফিলিস্তিনিরা সম্ভবত আরেকটি ঐকবদ্ধ ইন্তিফাদা শুরু করতে অনুপ্রাণিত হবে। ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে তাড়ানো ও যেকোনো বিক্ষোভ দমনের অব্যাহত প্রচেষ্টায় গাজার দিকে দৃষ্টি রেখে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা তাদের আক্রমণ বাড়ানোর ফলে ২১৫ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ২,৭৫০ জন আহত হয়েছে।

ইসরায়েল বোমাবর্ষণ করে গাজাকে আবার অন্ধকার যুগে ঠেলে দিয়ে শত শত গ্রেপ্তার ও হত্যা করার পর কী হবে? ইসরায়েলি সৈন্যরা কি ভূখণ্ড দখল করবে? তারা কি চিরতরে অবরোধ আরোপ করবে, নাকি তাদের কথা অনুসারে বারবার “উঠোনের ঘাস কাটবে?” তারা কি ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশ উদ্বাস্তু গাজাবাসীদের সিনাই ও তাঁবুর শহরগুলিতে ঠেলে দিয়ে আরেকটি নাকবা তৈরি করবে? ইসরায়েলি কর্মকর্তা পরিপূর্ণ গণমাধ্যম কথা বলছে ” হামাসের হাত থেকে গাজাবাসীকে বাঁচানো,” হাজার হাজার মানুষ ও পুরো অবকাঠামো ধ্বংস যেন এক ধরনের উপহার। আমরা শুধু ফিলিস্তিনিদের ঘাড় ছেড়ে দিয়ে দখলের বুট তুলে নিলেই তারা নিজেদের সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করতে সক্ষম। নিপীড়িত জনগণই প্রতিরোধ করবে। আমরা শুধু ইউক্রেনীয় ও কালো দক্ষিণ আফ্রিকীয় কৃষ্ণাঙ্গদের সমর্থন করলে, ফিলিস্তিনিরা কেন বাদ থাকবে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .