ইরানের নারী, ডিজিটাল অধিকার ও মানবিক স্বাধীনতা

প্রতিবাদে ইরান,’ অটোয়া, কানাডা, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২। ফ্লিকারে তাইমাজ ভ্যালির ছবি (সৃজনী সাধারণ অনুমতি ২.০)।

সর্বজনীন ডিজিটাল অধিকারের জোটের (অড্রি) বৈশ্বিক সমন্বয়কারী এমা গিবসন লিখিত এই অংশটি প্রথম ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে অড্রিতে প্রকাশিত হয়। এর একটি সম্পাদিত সংস্করণ অনুমতিসহ এখানে পুনরায় প্রকাশ করা হয়েছে।

ইরান সরকারের “নৈতিকতা” পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার ২২ বছর বয়সী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর থেকে একটি বছর পেরিয়েছে ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। বার্ষিকীর আগের সপ্তাহে মানবাধিকার সংস্থা এখনি_সমতা, ফেমেনামানবাধিকার সমর্থকদের কেন্দ্র (সিএসএইচআর) জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটির কাছে যৌথভাবে জমা দেওয়া একটি বিবৃতিতে “দেশে নারী যৌনাঙ্গচ্ছেদ (এফজিএম), বাল্যবিবাহ, ও দেশে যৌন-বৈষম্যমূলক ব্যক্তিগত অবস্থা আইনের প্রচলন অব্যাহত থাকায় ইরানে নারী ও মেয়েদের অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।”

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইরানের তথাকথিত “নৈতিকতা পুলিশ” অথবা বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়েছে। প্রায়শই অভিযোগের নেতৃত্ব দেওয়া নারীদের সাহসিকতাকে বাড়াবাড়ি বলা যায় না। তবে সরকারের ক্রমবর্ধমান অত্যাধুনিক ডিজিটাল নজরদারি সরঞ্জামের কারণে এই বিক্ষোভগুলি প্রায়শই গুরুতর পরিণতি বরণ করে।

বিতর্কিত নতুন হিজাব খসড়া আইনে নারীদের জন্যে কঠোর শাস্তির পাশাপাশি বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, ব্যবসা ও তাদের সমর্থনকারী পরিষেবা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞার নির্দেশ দেওয়া ৭০টি ধারা রয়েছে। খসড়া আইনে লিঙ্গ-ভিত্তিক নিপীড়নের একটি বিরক্তিকর প্রকাশকে প্রতিফলিত করা পোশাক-রীতি লঙ্ঘন নির্ণয়ের জন্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে।

আজকের ডিজিটাল যুগে ইরানের সরকার একটি দুই-ধারী তলোয়ার চালাচ্ছে: কণ্ঠস্বরকে ক্ষমতায়ন করার সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিকে তাদের বিশেষ করে লিঙ্গ সমতার আহ্বান জানানো কণ্ঠস্বরগুলিকে নীরব করার জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। উন্নত মুখ সনাক্তকরণ সফ্টওয়্যার ব্যবহার ও অনলাইন মিথস্ক্রিয়া অনুসরণ করে সরকার ভিন্নমত পোষণকারীদের চিহ্নিত ও হয়রানি করে।

এই প্রযুক্তিগত শক্তি অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তির জন্যে সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখা সমানাধিকারের দাবিরত নারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়।

এটি শুধু রাস্তার কোণে ক্যামেরা বা আকাশে ড্রোনের ব্যাপার নয়। আসল অরওয়েলীয় দুঃস্বপ্নটি রয়েছে ইন্টারনেটের ছায়ায়। প্রায়শই প্রতিবাদকারীদের সংগঠিত হতে সাহায্য করা জনপ্রিয় মঞ্চগুলি সেন্সর, বার্তা অ্যাপগুলি সংকেতায়িত এবং অবরোধ করা হয়। ব্লগার, প্রভাবক এবং এমনকি সাধারণ নাগরিকরা অনলাইনে তাদের মতামত প্রকাশের জন্যে ভয়ভীতি, গ্রেপ্তার বা আরো খারাপ পরিণতির শিকার হয়।

সম্ভবত নাগরিকদের ব্যক্তিগত গাড়ি ও হাঁটার পথের মতো ব্যক্তিগত স্থানগুলিতে রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক দৃষ্টি সবচেয়ে বিরক্তিকর।

এর একটি শীতল প্রমাণ হলো দেশের পুলিশ বাহিনী থেকে মাত্র তিন মাসের মধ্যে প্রায় দশ লক্ষ নারীকে সতর্কবার্তা পাঠানো। তাদের অপরাধ? হতাশাজনক বিশদ একটি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবেদন অনুসারে হিজাব ছাড়াই সদা-সতর্ক ক্যামেরা বন্দী হওয়া।

প্রতিবেদনটি অনুসারে, পুলিশ সারাদেশে “একটি নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী যানবাহন থামাতে ১,৩৩,১৭৪টি এসএমএস বার্তা জারি, ২,০০০টি গাড়ি বাজেয়াপ্ত করেছে, এবং ৪,০০০ টিরও বেশি ‘পুনরাবৃত্ত অপরাধীদের’ বিচার বিভাগে পাঠিয়েছে।”

ইরান থেকে বিশ্বে: পদক্ষেপের জন্যে একটি আন্তর্জাতিক আহ্বান

ডিজিটাল অধিকারগুলি মূলত মানবাধিকার। সমাজটিতে ব্যক্তিরা স্বাধীন, ব্যক্তিগত ও নিরাপদভাবে যোগাযোগ করতে পারে না এবং মৌলিক স্বাধীনতাগুলি আক্রান্ত।

নানাভাবে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকারের পাশাপাশি ডিজিটাল অধিকার বিদ্যমান। সংকেতায়িত যোগাযোগের সরঞ্জাম সরকারি বাধা বা প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই সক্রিয় কর্মী ও প্রতিবাদকারীদের যোগাযোগের একটি উপায় দিতে পারে। মূলধারার গণমাধ্যম সেন্সর বা নীরব করা হলে সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলি নির্দিষ্ট কোনো কারণের জন্যে সমর্থকদের সমাবেশের তথ্যের দ্রুত প্রচারের সুযোগ তৈরি করে। উপরন্তু, ডিজিটাল ক্ষেত্র শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কৌশল, অধিকার সচেতনতা ও আন্তর্জাতিক সংহতি প্রচেষ্টা সংক্রান্ত সম্পদের একটি বিস্তৃত সারি প্রদান করে।

ইরান ভিন্নমত দমন বা নজরদারির জন্যে প্রযুক্তি ব্যবহার বেছে নেওয়া ডিজিটাল স্বাধীনতা সীমাবদ্ধকারী একমাত্র শাসকগোষ্ঠী নয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে পুলিশ ব্যক্তিগতভাবে সংগৃহীত সিসিটিভি ফুটেজে প্রবেশের একটি অ্যাপ কাজে লাগাচ্ছে

চীনে এক ধরনের “ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পুলিশী” হিসেবে একক ব্যক্তির গতিবিধি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গণনজরদারি ব্যবহার করা হয়েছে। এই উদাহরণগুলিতে গোপনীয়তার অধিকারের উপর নজরদারি ও লঙ্ঘন অসমভাবে নারী বা সংখ্যালঘু বা যাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ ক্ষমতাসীনদের চ্যালেঞ্জকারী ঝুঁকিপূর্ণ পরিচয়ের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করার প্রমাণ রয়েছে।

তবে এখানে চ্যালেঞ্জটি হলো: এই ধরনের সরকারগুলি অনলাইন ভিন্নমতকে দমনে আরো দক্ষ হয়ে উঠলে সক্রিয় কর্মীদের এক ধাপ এগিয়ে থাকা।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে অবশ্যই ব্যবহারকারীর ডেটা সুরক্ষিত করতে চাপ এবং প্রান্ত-থেকে-প্রান্তে সংকেতায়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালিত ডিজিটাল নজরদারি ও সেন্সরের সৃষ্ট হুমকি এবং উৎপাদিত প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে ডিজিটাল অধিকার সংস্থা ও সুশীল সমাজের পরামর্শ করা উচিত।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারগুলিকে বিশ্ব যে দেখছে সেটা বুঝাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিয়মিত অপব্যবহার চিহ্নিত করা উচিত। আর মানবাধিকার নীতির পাশাপাশি ডিজিটাল স্থানের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে যেন এটি ইরানি নারী, বা অন্য কারো অপব্যবহার ও ক্ষতির জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ একটি নতুন পরিবেশে পরিণত না হয়।

ইরানি সরকারের কৌশলগুলি আরো তাৎপর্যপূর্ণ বৈশ্বিক সমস্যার প্রতীক বলে বিশ্বকে অবশ্যই ঋজু দাঁড়িয়ে থাকা ইরানের নারীদের অনন্য সাহসিকতার কথা মনে ও সমুন্নত রাখতে হবে। মাহসা আমিনি ও তার মতো অগণিত অন্যদের, আমাদের ডিজিটাল ও মানবাধিকারের জন্যে আমাদের যৌথ লড়াইয়ে অবিচল থাকতে হবে। তাদের সাহস এর চেয়ে কম কিছু দাবি করে না।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .