‘আমার চিত্রকর্মে আমার সংগ্রামের প্রকাশ': ইরানী শিল্পী জয়নব মোভাহেদের সাথে একটি সাক্ষাৎকার

পোশাকের দড়ি সিরিজ. ক্যানভাসে ড়েরক্রাইলিক। ১৩০ x১৫০ সেমি (৫১ x ৫৯ ইঞ্চি), ২০১১। জয়নব মোভাহেদের সৌজন্যে

ইরানে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মাহসা আমিনির মৃত্যু ২০০৯ সালের পর দেশব্যাপী সবচেয়ে বড় জনবিক্ষোভের জন্ম দেয়। “যথাযথ হিজাব” না পরার কারণে ২২ বছর বয়সী নারী আমিনি পুলিশ হেফাজতে জীবন হারালে তিনি অনেকের বিশেষ করে শিল্পের মাধ্যমে তাদের সংগ্রাম ও উদ্বেগ সম্পর্কে কথা বলার জন্যে মুহূর্তটি বেছে নেওয়া ইরানী নারী শিল্পীদের জন্যে একজন অনুকরণীয় প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

সেই শিল্পীদের একজন জয়নব মোভাহেদ (৪১) এর চিত্রকর্ম ইরানের একজন নারীর জীবনের জটিলতার জানালা খুলে দেয়। অনেকটা “লিঙ্গ-বর্ণবাদী” অথচ বিপুল সংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত নারীদের একটি দেশে সমঅধিকারের জন্যে চলমান লড়াইকে এগিয়ে নিতে তার কাজ ব্যাপকভাবে ভাগাভাগি করা হয়।

মোভাহেদ শৈশবে ছবি আঁকা শুরু করেন এবং ১৯৯৯ সালে ১৭ বছর বয়সে পাঠ নেওয়া শুরু করেন। তারপর থেকে চিত্রকর্ম তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠে। তিন বছর পরে তিনি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা ও স্থাপত্য স্কুলে প্রবেশ করে চিত্রকলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ইরানের চিত্রকলা স্কুলে যোগদানের সমস্ত ত্রুটি ও হতাশা সত্ত্বেও স্কুলটি নেতৃস্থানীয় শিল্পী, বই ও নতুন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে শেখাসহ একাধিক ইতিবাচক উন্নয়নের দিকে তার চোখ খুলে দেয়। এই শিক্ষা তাকে তার পেশাদার পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে।

স্নাতক হওয়ার পর থেকে তিনি ১১টি একক প্রদর্শনী এবং বিশ্বব্যাপী ৬০টিরও বেশি দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। তার কাজ তেহরান, কুয়েত, নিউ ইয়র্ক, লাহোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও গ্রীসে প্রদর্শিত হয়েছে।

সকলেই শিল্পের ভিন্ন ভিন্ন স্কুলের হওয়া সত্ত্বেও রবার্ট রাউসেনবার্গ, মার্ক রথকো, অ্যান্ড্রু হোয়াইটএডওয়ার্ড হপারকে তার প্রধান প্রভাব হিসেবে উল্লেখ করলেও তিনি বলেছেন, “এই মুহূর্তে আমি যা করি সে সম্পর্কে সমসাময়িক তরুণ ইরানি শিল্পীদের কাজ আমাকে অনুপ্রাণিত করে এবং আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।”

মোভাহেদ ২০১৬ সাল থেকে তেহরানে প্রতীকী চিত্রকলা শিখিয়েছেন এবং ১৫০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

সাক্ষাৎকারটির কিছু অংশ নীচে দেওয়া হলো: 

বদ্ধ বাগান সিরিজ। ক্যানভাসে তেল রঙ। ১২০ x১২০ সেমি (৪৭x ৪৭ ইঞ্চি), ২০১৭। জয়নব মোভাহেদের সৌজন্যে

ওমিদ মেমারিয়ান (ওএম): আপনার চিত্রকর্মে আপনার দৈনন্দিন জীবন কতোটা প্রতিফলিত হয়? আপনার প্রথম প্রদর্শনী থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে নিউ ইয়র্কে সর্বশেষ প্রদর্শনীগুলি কি বিভিন্ন সময়, বিশ্বাস বা উদ্বেগকে চিহ্নিত করে? 

জয়নব মোভাহেদ (জেডএম): আমি সেটাই বিশ্বাস করি। প্রথম সিরিজ থেকে সর্বশেষ পর্যন্ত আমার জীবনের নির্দিষ্ট সময় ও আমার জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার উল্লেখ রয়েছে। আসলে আমি যে সমাজে থাকি তা আমার দেশে একজন ইরানী নারী হিসেবে আমার বিভিন্ন সংগ্রামের কারণে সরাসরি আমার জীবনের বিশেষ করে আমার কাজের উপর প্রভাব ফেলেছে।

আমাদের মধ্যে নারীদের পোশাক সম্পর্কে ভয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে এই বিশ্বাসগুলি ম্লান হয়ে গেলে শুধু একজন চিত্রশিল্পী হিসেবেই নয় একজন নারী হিসেবে আমি আমার চিত্রকর্মগুলিতে আমার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমার যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত – নারীদের পোশাক ছাড়াও আমার নিজের ও অন্যান্য নারীদের জীবনের  অন্যান্য বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে – একটি মুক্ত ও আরো সাহসী উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছি। আমার চিত্রকর্মগুলিতে এই উদ্বেগ ও সংগ্রামগুলিকে প্রকাশ করা দরকার ছিল। সুতরাং আপনি আমার কাজ ও আমার জীবনের দিকে তাকালে আপনি এর ধারাবাহিকতা দেখতে পাবেন।

You are awake while we slumber.bOil and acrylic on canvas. 130*150cm.2015. Courtesy of Zeynab Movahed

‘আমরা যখন ঘুমে আপনি তখন জেগে আছেন।’ ক্যানভাসে তেল রঙ ও অ্যাক্রাইলিক। ১৩০ x ১৫০ সেমি (৫১ x ৫৯ ইঞ্চি), ২০১৫। জয়নব মোভাহেদের সৌজন্যে

ওএম: মোরগ ও কাক আপনার চিত্রকর্মের দুটি সিরিজের প্রধান বিষয়। এগুলো কিসের প্রতীক?

জেডএম: আমার সংগ্রহের “আমরা ঘুমাচ্ছি আর আপনি জেগে আছেন” এর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একজন পুরুষের প্রতীক মোরগটি পুরোপুরি সূক্ষ্ম ও নারীসুলভ পরিবেশে ভয় দেখানোর মতো সম্ভ্রমের সাথে তার শক্তি ও আগ্রাসনকে প্রদর্শন করছে। চিত্রকর্মগুলিতে আপনি তাকে একজন বশীভূত ও প্রচলিত নারীর সাথে সন্তুষ্ট দেখতে পাবেন, যেখান থেকে হুমকি নির্বিশেষে একজন নারী পালানোর পথ খোঁজে। সেই কোমল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মোরগটিকে কোনোভাবে উপহাস করা হয়।

পরবর্তী প্রতীক ভিন্ন চরিত্রের পাশাপাশি সমাজে বসবাস করার কারণে কাকের সাথে মানব সমাজের সাথে খুব মিল রয়েছে। এই সিরিজের কাজের মধ্যে ছবিতে ও নারীর চারপাশে কাকের আগমন আমাদের বর্তমান সমাজের একটি স্তরের প্রতীক। তারা নারীর উপর অনেক করণীয় ও নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিলেও নারী সেসব উপেক্ষা করে তার পছন্দের জীবনধারা নির্বাচন করে।

ওএম: আপনার চিত্রকর্মে আপনি এমন কোন স্থান অনুভব করতে পারেন কি যা আপনি একজন নারী হিসেবে অনুভব করতে পারেন না?

জেডএম: শুধু একজন নারী হিসেবেই নয় একজন চিত্রশিল্পী হিসেবেও (যিনি একজন পুরুষও হতে পারেন) চিত্রকলার ক্ষেত্রটি শিল্পীকে অনেক সম্ভাবনা প্রদান করে। ছবি আঁকা আমার ব্যক্তিগত এলাকা হওয়ায় আমি আমার ইচ্ছামত ছবি তৈরি করি। অনেক সময় আমি আমার সত্তার সমস্ত নারীত্ব – তা রাগ, বিদ্রোহ, তৃপ্তি, কষ্ট বা চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়ই হোক না কেন – প্রকাশ করেছি। বাস্তব জীবনে আমার আবেগ ও গুণাবলী অন্বেষণের কোন সুযোগ ছিল না।

সরকার ও সমাজ উভয়ের দিক থেকেই এখনো নারী-বিদ্বেষ থাকা ইরানের মতো একটি সমাজে নারীর বিষয়টি অপরিহার্য এবং আমরা এর প্রতি উদাসীন হতে পারি না।

এই প্রবণতার একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ হলো দেশব্যাপী বিক্ষোভ সৃষ্টি করা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সংঘটিত সম্ভ্রমের হত্যাকাণ্ড ও ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মাহসা আমিনির খুন। শুধু নারী হওয়ার জন্যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো কোনো না কোনোভাবে সচেতন শিল্পীর সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় তাদের পথ খুঁজে পায়।

অস্থির পরিস্থিতি সিরিজ. ক্যানভাসে তেল রঙ। ১৩০ x১৫০ সেমি (৫১ x ৫৯ ইঞ্চি), ২০১৮। জয়নব মোভাহেদের সৌজন্যে

ওএম: বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পটভূমিতে আপনার চিত্রকর্মে আপনি যে জগতগুলি তৈরি করেছেন তা দর্শকদের মধ্যে কেমনভাবে গৃহীত হয়েছে?

জেডএম: প্রতিটি দেশে দর্শক ভিন্ন। ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যে নারীরা আমার কাজের সাথে বেশি পরিচিত। পশ্চিমে আমার কাজ দর্শকদের কাছে আকর্ষণীয়। একজন ইরানী নারী হিসেবে আমি যা করি তাতে তারা সাহস দেখতে পায়। লোকেরা জানতে চায় ইরানে নারীদের সাথে কেমন আচরণ করা হয় এবং ইরানী নারীদের শিল্পকর্ম সেই বোঝাপড়ার সূচনা করে। অবস্থান যাই হোক না কেন ধারণা ছাড়াও আমার কৌশলের প্রশংসা করা হয়।

ওএম:  আপনার কাজ গত বছরের শিকাগো চিত্রকলা প্রদর্শনীতে সারা বিশ্বের প্রায় ২০০টি গ্যালারীর মধ্যে  প্রদর্শিত হয়েছে। ইরানেও শতাধিক গ্যালারি রয়েছে। ইরানের গ্যালারিগুলি কি এই ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়?

জেডএম: শিকাগো প্রদর্শনীতে বিদেশী গ্যালারির পক্ষ থেকে বেশ কিছু ইরানি শিল্পী অংশ নিলেও ইরান থেকে কেউ অংশ নেয়নি। বিশেষ করে ইরানি মুদ্রা গত কয়েক বছরে তার অনেক মূল্য হারানোতে ইরানি গ্যালারির জন্যে এসব অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া খুব ব্যয়বহুল। তবে ইরানের শীর্ষ কয়েকটি গ্যালারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুবাই থেকে ইস্তাম্বুল পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্প মেলায় উপস্থিত হয়। অবশ্যই এসব ইরানের দৃশ্যমান চিত্রকর্মের ক্ষেত্রে যা ঘটছে তার প্রতিনিধিত্ব না করলেও এসব ইরানের শিল্প সম্পর্কে গৎবাঁধা ধারণাকে পরিবর্তন করতে এক ধাপ এগিয়ে নেয়। আমি মনে করি বিদেশে কাজ উপস্থাপন করতে পারার মতো দেশে অনেক গুণী শিল্পী রয়েছে।

বদ্ধ বাগান সিরিজ. ক্যানভাসে তেল রঙ। ১৩০ x১৫০ সেমি (৫১ x ৫৯ ইঞ্চি), ২০১৬। জয়নব মোভাহেদের সৌজন্যে

ওএম: নিউইয়র্কে ২০২২ সালে আপনার একটি একক প্রদর্শনী হয়েছিল। সেসব কাজ ও আপনার আগের সংগ্রহগুলির মধ্যে মিল ও অমিল কী?

জেডএম: আমার আগের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহগুলির বিপরীতে আমার সাম্প্রতিক সংগ্রহে সরাসরি চিত্র এবং দৃশ্যমান উপাদানগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে৷ আমরা কাচের মধ্যে সমন্বিত ও প্রতিফলিত যে নতুন চিত্রগুলির মুখোমুখি হই তা তাদের আসল প্রকৃতি থেকে অনেক দূরবর্তী, বিভক্ত ও পুনরাবৃত্ত।

আমার আগের কাজে নারীরা ব্যক্তিগত ঘরোয়া স্থানে এবং কাজটি একটি সমতল একরঙা পটভূমিতে অবস্থান করলেও আমার নতুন কাজে দর্শক নিশ্চয়তাহীন স্তরযুক্ত স্থানের মুখোমুখি হয়। ঘটনাক্রমে সংগ্রহের ধারণাটি হলো: জীবনের স্থিতিশীল ও অস্থির সকল মুহূর্ত।

এসব কাজ ও আমার আগেরগুলির মধ্যে একটি মিল হলো ছবিতে নারীদের – বিশেষত আমার – উপস্থিতি। কিন্তু নতুন কাজে নারীরা আগের ঘরোয়া স্থানগুলো ছেড়ে সমাজে উপস্থিত হয়েছে।

অস্থির পরিস্থিতি সিরিজ। ক্যানভাসে তেল রঙ। ১৩০ x ১৫০ সেমি (৫১ x ৫৯ ইঞ্চি), ২০১৯। জয়নব মোভাহেদের সৌজন্যে

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .