আয়, বয়স ও স্থুলতা বিচারে কোভিড -১৯ মহামারীতে সুবিধা পাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া

পিক্সবের লাইসেন্সের আওতায় সৌমেন৮২হাজরার ছবি

কোভিড -১৯ মহামারীর শুরু থেকেই সমস্ত বড় বড় মিডিয়া – বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলির – দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়ের কথা বলেছে। ধরে নেওয়া হয়েছিল দারিদ্র্য, সরকারি চিকিৎসা সুবিধার অভাব, প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার নিম্নহার এবং চিকিৎসা দক্ষতার স্বল্পতা কোভিড -১৯ ঝড় মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করবে। গ্লোবাল ভয়েসেসে আমার আগের বেশ কয়েকটি কলাম যে যুক্তিগুলি দিয়েছিল বাস্তবতা আসলে তেমন নয়।

প্রথম সপ্তাহ থেকেই মনে হয়েছে যে দক্ষিণ এশিয়া ইতোমধ্যেই মূল উপার্জন ও বয়স বন্টন বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে উপকার পেতে শুরু করেছে। নীচের সারণি ১-এর খ, গ ও ঘ-তে দক্ষিণ এশিয়ার আয় এবং বয়সের কাঠামো সম্পর্কিত তথ্যগুলি স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে এবং এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ উচ্চ-কোভিড মাত্রার দু’টি পশ্চিমা দেশ, ডেটা যাচাইয়ের জন্যে বড় ও উল্লেখযোগ্য মধ্য আয়ের ইরান ও তুরস্কের আয় ব্যবস্থা এবং সামগ্রিকভাবে বিশ্বের হিসেব।

স্তম্ভ ক-এ নিরূপিত প্রতি দশ লাখে সংক্রমণ ও প্রতি দশ লাখে মৃত্যু থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় কোভিডের অতি-নিম্ন মাত্রা খুব স্পষ্ট এবং সেটা বিশ্ব গড়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে – এমনকি ইরান ও তুরস্কের মতো মধ্য আয়ের দেশগুলির তুলনায় অনেক এবং উচ্চ-আয় দেখানো যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন থেকে এক বিশ্ব – কম। ভারতের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণের হার ১০ গুণ, মৃত্যুর হার ১৫ গুণ বেশি। এখানে এখনো অপ্রকাশিত ব্যাখ্যা থাক্লেও সারণি ১-এ আপাতদৃষ্টে একতরফা হলো আয় ও বয়স বিতরণের (খ-ঘ) সংমিশ্রণ। জীবনযাত্রার ব্যয়ের পার্থক্যগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে সত্যিকারের ব্যয় শক্তির সবচেয়ে সঠিক ধারণা প্রদান করা ক্রয়ক্ষমতার তুলনামূলক অনুমা্নের মাধ্যমে পরিমিত মাথাপিছু প্রকৃত আয়ের নিন্ম্তর অবস্থান অনেক কম মাত্রার কোভিডের জন্ম দেয়।

দারিদ্র্য থেকে সুবিধা পাওয়া খুবই বিরল ঘটনা

পারস্পরিক এই সম্পর্কের মূল কারণ নিন্ম আয়ের অর্থ হলো তরুণ জনসংখ্যার উচ্চ অনুপাত (বয়সের নিম্ন মধ্যক) এবং ৬৫ এর বেশি বয়সের জনসংখ্যার একটি ছোট অনুপাত। সুতরাং সারণিতে থাকা সর্বনিম্ন কোভিড -১৯ সংক্রমণের ঘটনা এবং খুব কম মৃত্যুর হার আফগানিস্তানের মতো নিষ্ঠুরভাবে কম মাথাপিছু আয়ের সাথে যুক্ত। এখানে মধ্যক বয়স অত্যন্ত কম (বিশাল সংখ্যক যুবক) এবং খুব কম বয়স্ক লোকের সংখ্যা। আজ পর্যন্ত সমস্ত ভ্যারিয়েন্টসহ কোভিড -১৯ এর বৈশিষ্ট্য হলো এরা সাধারণত গুরুতর অসুস্থতা ছাড়াই অল্প বয়সীদের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করলেও বয়স্কদের চেপে ধরে প্রায়শই শ্বাসকষ্টের গুরুতর সমস্যাসহ সাধারণত মৃত্যুর কারণ ঘটায়।

আর কিছু না জেনেও বোধগম্যভাবে আমরা যে যুক্তিটা দিতে পারি সেটা হলো আয় ও বয়সের পার্থক্য কোভিড স্তরের পার্থক্য নির্ধারণ করছে। ইরান ও তুরস্ক নিশ্চিত করেছে যে তাদের উচ্চ আয়ের কিছুটা বয়স্ক জনগোষ্ঠী উচ্চমাত্রায় কোভিডে সংক্রমিত হলেও ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক লোকের একটা ছোট্ট অংশ থেকেই যাচ্ছে। তারা একটা মধ্যবর্তী অবস্থানে রয়েছে। তবে ধনী দেশগুলি চরম উচ্চহার: ব্যতিক্রমভাবে উচ্চতর কোভিড -১৯ স্তর, উচ্চ আয়, অল্প তরুণ, বেশি বয়স্ক জনসংখ্যা প্রদর্শন করছে।

এর ভিত্তিতে আমরা আশা করতে পারি মহামারীটির প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার অনেক শহর ও গ্রামে যেমনই ভয়াবহ আকার ধারণ ক্রুক না কেন চূড়ান্ত হিসেবে মহামারীটি দক্ষিণ এশিয়াকে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে আগের ঝুঁকির চেয়ে অনেক কম ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি বরং পূর্ব এশিয়ার দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কিছুটা সুবিধাও দিয়ে যাবে।

ধনী পশ্চিমা দেশগুলির তুলনায় বৃহৎ দরিদ্র দেশগুলি ভালভাবে মহামারী মোকাবেলা করছে – কথাটিকে এক দেখায় স্ববিরোধী মনে হলেও সেটাকে ব্যাখ্যা করার মতো কার্যকর কোন অন্তর্নিহিত শক্তি এখনো নেই। নীতিমালা বা বায়ু দূষণের মাত্রা, জনাকীর্ণ অথবা নিয়ন্ত্রণহীন সীমান্ত আয় এবং বয়সের মতো “বস্তুগত” নিয়ামকগুলি একইভাবে কাজ করার সম্ভাবনা থাকলেও কোন গবেষণায় এগুলি এখনো স্পষ্ট নয়।

দক্ষিণ এশিয়া এবং অন্যান্য স্থানে আমার নিজের আগের অনুসন্ধানগুলি হলো বিভিন্নরকম কোভিড নীতিমালা প্যাকেজগুলি একইরকম ব্যবসার ক্ষেত্রে পার্থক্য তৈরি করেছে; অর্থাৎ, জাপান বা জার্মানিতে উচ্চতর নীতিগুলি যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের নীতিগুলির তুলনায় কোভিডকে ভালই হ্রাস করেছে বা দক্ষিণ এশিয়ার কোথাও কিছু নীতিমালা ভাল কাজ করলেও অন্য জায়গায় সেটা সেরকম করেনি। যতক্ষণ না আমরা জানি যে জনসংখ্যার ঘনত্ব, বায়ু দূষণ, জলবায়ু বা এই জাতীয় কারণগুলি আয় ও বয়সের মতো এই মহামারীটিতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাজ করে ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধরনের সম্ভাবনাগুলি অনুমানমূলকই থেকে যায়।

তবে বিশেষভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে দেখতে হবে অন্য কোন চলক বয়স ও আয়ের সাথে পরিবর্তিত হয় এবং সামগ্রিক কোভিড পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে কিনা। এটা হলো জাতিসমূহের স্থূলতার স্তরের এবং অনেকটা প্রতিদিনের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সংস্কৃতির মধ্যেকার ভিন্নতা। সুতরাং, সারণি ১-এর ঙ স্তম্ভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইরান ও তুরস্কের মতো ধনী দেশগুলিতে স্থূলতার চূড়ান্ত মাত্রা প্রদর্শন করে। উচ্চ আয়ের অর্থ উচ্চমাত্রার কোভিড এবং উচ্চমাত্রার স্থূলতা।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রধান জার্নাল “বিপাক”-এ প্রকাশিত পূর্ব এশীয় একাডেমিকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে উচ্চমাত্রার স্থূলতা উচ্চমাত্রার কোভিড সংক্রমণ, গুরুতর অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সাথে দৃঢ়়ভাবে সম্পর্কিত। প্রচুর পরিমাণে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও গুরুত্বপূর্ণ জরিপে ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রটিকে অনুসরণ করা হয়েছে।

আদর্শ দেহ-ভর সূচকের সাথে তুলনা করে দেহাভ্যন্তরে জমা হওয়া মেদকলার পরিমাণকে স্থূলতার মাপকাঠি বিবেচনায় নিয়ে ৩৩ টি গবেষণার প্রায় ৪৫,৬৫০ জন অংশগ্রহণকারীকে পরীক্ষা করে প্রাপ্ত ফলাফলগুলির সারসংক্ষেপ থেকে মনে হয় উচ্চমাত্রার স্থূলতা এবং গুরুতর কোভিড সংক্রমণের জন্যে হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি, আইএমভি চিকিৎসাজনিত মৃত্যুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক রয়েছে। ক্রমবর্ধমানভাবে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে স্থূলতা নিউমোনিয়া এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারার মতো গুরুতর অবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া অনেক কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। এর থেকে বোঝা যায় যে এটা সংক্রমণের সংখ্যার চেয়ে মৃত্যুর হারকেই প্রভাবিত করার সম্ভাবনা বেশি।  তবে এর প্রায়োগিক প্রমাণ এখনো অস্পষ্ট।

স্পষ্টতই দক্ষিণ এশিয়া আবারী সুবিধা পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লুএইচও) অনুমান করেছে যে বিশ্বব্যাপী স্থূলত্বতা গড়ে প্রায় ১৩ শতাংশ এবং স্তম্ভ ঙ-তে দেখা যাচ্ছে যে সেটা দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত প্রধান দেশের স্থূলতা স্তরের অনেক উপরে অবস্থান করছে। মজার ব্যাপার, ইরান ও তুরস্কের উচ্চ আয়ের দিকে যাত্রার তুলনায় যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশগুলির পর্যায়ে তাদের স্থূলতার বৃদ্ধি আনুপাতিকভাবে বেশি। মহামারীটির বিস্তার ভাইরাসের নতুন জাতগুলির বিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত থাকায় কম স্থূলতার স্তরটি হয়তো গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুহার হ্রাস করার মাধ্যমে মহামারীজনিত গুরুতর অসুস্থতা থেকে ভবিষ্যত সুরক্ষায় সাহায্য করতে পারে।

শেষ পর্যন্ত ইরান ও তুরস্কের জন্যে বর্তমান প্রজন্মের সময়কালে আয়ের বৃদ্ধি (২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছর জিডিপি প্রায় ৫ শতাংশ বাড়ছে) উচ্চহারের কোভিডের সাথে সম্পর্কিত হলেও স্থূলতার মাত্রার উপর আপাতদৃষ্টে ব্যাপক প্রভাবের মাধ্যমে বয়সের বিতরণকে সামান্যই পরিবর্তন করেছে বলে মনে হতে পারে। কিছু কিছু জাতীয় পরিস্থিতিতে আয়ের উপর স্থূলতার প্রভাব কোভিড স্তরের প্রজন্মে আয়ের বয়স বন্টনের প্রভাবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।

এর কোনটিই দক্ষিণ এশিয়ার মহামারীটির বিপর্যয়কর প্রভাবকে অস্বীকার করার জন্যে বলা না হলেও আয়, বয়স, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা দিয়ে পরিমাপের প্রক্রিয়াটি দারিদ্র্য ও সরকারি চিকিৎসা সুবিধার অভাবের স্পষ্ট, কপট ও ক্ষমাহীন প্রভাবগুলিকে হ্রাস করতে থাকবে বলে আশা করা যায়।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .