নেপালের পশ্চিম তেরাই অঞ্চলের ‘পাথরকাটা‘ এমন একটি বিপন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে যাদের পূর্বপুরুষের পাথর কাটার পেশা রয়েছে। নেপালে তারা ‘অস্পৃশ্য’ বিবেচিত এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও বৈষম্যের শিকার। প্রজন্ম ধরে পাথরকাটারা নেপালি পরিবারের জন্যে পাথরের হাতিয়ার তৈরি করে এলেও সংখ্যালঘু অচ্ছুৎ হওয়ায় তারা বছরের পর বছর প্রান্তিকতার শিকার এবং স্বীকৃতির জন্যে অবিরাম সংগ্রাম করে আসছে। এমনকি নেপালে তাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার জরিপ পর্যন্ত প্রায়শই অগ্রাধিকার পায় না।
দলিত পরিচয়
নেপালে তারা বর্ণ শ্রেণিবিন্যাসের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরের দলিত সম্প্রদায়ের অংশ। তারা ঐতিহ্যগতভাবে প্রায়শই ছোটখাটো কর্মের জাতি-ভিত্তিক পেশা গ্রহণের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন।
নেপালে আজ জীবিকার প্রবৃদ্ধি বা স্থায়িত্বের কোনো সুযোগ ছাড়াই প্রায় ৩,৩৪৩ জন পাথরকাটা তাদের মৃতপ্রায় পেশা নিয়ে লড়াই করছে। সরকার পাথরকাটা সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘু সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা প্রদান করলেও তা তাদের পরিবারের খরচ পর্যাপ্তভাবে মেটানোর জন্যে যথেষ্ট নয়। উদাহরণস্বরূপ, সরকার সরকারি কর্মের ৯ শতাংশ পদ দলিতদের জন্যে সংরক্ষিত রাখলেও কোনো পাথরকাটা নেপালে সরকারি কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ অশিক্ষা- তাদের মধ্যে দেশীয় গড়ের তুলনায় সাক্ষরতার হার কম বলে দলিতদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করার সরকারি উদ্যোগের সুবিধা পেতে তাদের লড়াই করতে হয়।
জওয়াহিরের গল্প
এটি নেপালের নাওয়ালপারাসি (পশ্চিম) জেলায় অবস্থিত সাওয়াতিকার গ্রামের ৩৮ বছর বয়সী পাথর খোদাইকারী জওয়াহির পাথারকাটার গল্প, যিনি ১২ বছর বয়সে পাথর কাটতে শুরু করেছিলেন। জওয়াহির পাথর নিয়েই দিন কাটায়। প্রখর রোদে হোক বা জমে থাকা ঠান্ডায় তিনি তার ছোট এক কক্ষের একতলা বাড়ির বাইরে পাথরে হাতুড়ি মেরে মেরে প্রায়শই পাথরের ধুলোয় ঢেকে থাকেন। গত নভেম্বরে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে জওয়াহির বলেছিলেন, “আমার পূর্বপুরুষরা একটি তাঁবুর নীচে থাকলেও, ক্রমাগত কঠোর পরিশ্রম করে আমি আমার পরিবারকে রোদ ও বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে এই বাড়িটি তৈরি করেছি।”
তিনি বিভিন্ন স্থানীয় কমিটিকে চাঁদা দিয়ে আশেপাশের নদী থেকে বড় বড় পাথর খুঁজে নিয়ে আসেন। তারপরে তিনি সেগুলি কেটে শিল, পাটা, জাঁতা এবং উদূখলের মতো রান্না ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সরঞ্জাম বানান। তারা মূলত ঐতিহ্যগত পাথর ক্রিয়াজাতকারক। উৎসবের মরসুমে তিনি দেবদেবীর মূর্তিও খোদাই করেন। সারাবছরের ৩৬৫ দিনই তিনি পাথর খোদাই করে থাকেন।
জওয়াহির তার পরিবারের দরিদ্র অর্থনীতির জন্যে তার নিরক্ষরতাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, “আমি কখনোই পড়াশোনা করার সুযোগ পাইনি বলে আমাকে একটি কম বেতনের পেশা বেছে নিতে হয়েছে। তবে আমি আমার মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যাতে তারা ভবিষ্যতে ক্ষমতাবান কর্মকর্তা হতে পারে।” জওয়াহির বলেন, “আমার তিনটি মেয়ে আছে। আমাদের সমাজ কন্যাদের চেয়ে পুত্রদের অগ্রাধিকার দিলেও আমি কখনোই একটি পুত্রের প্রয়োজন অনুভব করিনি কারণ আমি মনে করি কন্যারা ছেলেদের মতোই বা তার চেয়েও ভালো অর্জন করতে পারে।” পাথরের তৈরি এসব যন্ত্রপাতি তৈরির আয়ের মাধ্যমেই তিনি তার মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পেরেছেন।
দক্ষ হাতে কাজে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেও পাথর-খোদাই পেশা থেকে তিনি শুধ তার মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারেন, যা তার বেঁচে থাকা কঠিন করে তোলে। বর্ণ-ভিত্তিক পাথর-খোদাইয়ের মতো পেশা নেপালি সমাজে নিম্ন-মর্যাদা হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় প্রায়শই বৈষম্যের শিকার হয়। ঐতিহ্যগত পেশার কারণে জাতিগত বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার অতিরিক্ত বোঝা বস্তুগত ও অ-বস্তুগত উভয় ধরনের বিভিন্ন সম্পদ প্রাপ্তির সুবিধা সীমাবদ্ধ হওয়ার ফলে তাদের জন্যে কম কার্যকর বিকল্প অবশিষ্ট থাকাও একটি উদ্বেগের বিষয়।
দ্রুত আধুনিকায়নের ফলে ঐতিহ্যবাহী পাথরের তৈরি যন্ত্রপাতির চাহিদা কমে যাওয়ায় জওয়াহিরের পেশার ভবিষ্যতকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। লোকেরা দক্ষতা ও সহজ ব্যবহারের কারণে বৈদ্যুতিক মিশ্রণকারী ও গুড়া করার যন্ত্রের মতো আধুনিক যন্ত্রপাতির দিকে ঝুঁকছে। জওয়াহির বলেন, “শিল, নোড়া, জাঁতা ইত্যাদির বিক্রি গত পাঁচ বছরে ব্যাপকভাবে কমেছে। গ্রামে গ্রামে ঘুরেও এসব জিনিস বিক্রি করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।” দৃষ্টিতে স্পষ্ট বেদনা নিয়ে তিনি বলেছেন, “আমি পাথর থেকে এই সামান্য উপার্জনে আমি হয়তো কখনোই আমার মেয়েদের উন্নত জীবন ও উচ্চ শিক্ষা দিতে পারবো না।”
দলিত কর্মসংস্থান কোটা সম্পর্কে জওয়াহির বলেছেন,
সরকারের কাছ থেকে আমাদের কোনো অর্থ বা কোটা লাগবে না। আমাদের পাথরের তৈরি পণ্যের জন্যে একটি উপযুক্ত বাজার থাকলে আমরা বেশি খুশি হবো, কারণ পাথর খোদাই আমাদের পরিচয় ও আমাদের একমাত্র দক্ষতা। সরকারের ঐতিহ্যগত পেশার উপর নির্ভর করে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্যে তাদের পূর্বপুরুষের পরিচয় সংরক্ষণকারী আদিবাসী সম্প্রদায়ের দক্ষ কাজের জন্যে একটি ন্যায্য বাজার নিশ্চিত করা উচিত।