আসাদ-নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ায় সরকারি বয়ানে ‘কোন কোভিড-১৯ সংক্রমণ নেই’

উত্তর-পূর্ব দারা, ২০১৫। মূসা মোহাম্মদের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

নয় বছর মারাত্মক গৃহযুদ্ধের পরে সিরিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামান্যই কার্যকরী। রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলিতে কর্তৃপক্ষ কোভিড-১৯ এর উপস্থিতি অস্বীকার করেছে।

জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ১৫ জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে ৪৩৯টি আক্রমণের ঘটনা ও ২১ জন নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে সরেজমিন বর্ণনা থেকে বোঝা যায় রাষ্ট্র কীভাবে কোভিড-১৯ বাস্তবতাকে অস্বীকার ও গোপণ করেছে।

ওয়ালিদ আবদুল্লাহ (২৩) বলেছেন রাষ্ট্র সন্দেহজনক কোভিড-১৯ রোগীদের জীবন শেষ করে দেওয়ার পরামর্শ পর্যন্ত দিচ্ছে। গ্লোবাল ভয়েসেস তার পরিচয় সুরক্ষার জন্যে একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করছে। ফোনে গ্লোবাল ভয়েসেসের সাথে কথা বলতে গিয়ে আবদুল্লাহ ব্যাখ্যা করেছেন ১৩ মে তারিখে একটি সন্দেহজনক করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে জানানোর জন্যে তিনি দক্ষিণ সিরিয়ার দারা জাতীয় হাসপাতালে ফোন করেছিলেন। আবদুল্লাহ  জানিয়েছেন, কী পদক্ষেপ নিতে হবে তিনি জানতে চাইলে ফোনের উত্তরদাতা সরকারি হাসপাতালের কর্মচারী বলেছে: “ওকে গুলি কর – আমাদের কাছে ওর কোন চিকিৎসা নেই।”

তিনি দ্রুত ফোন কলটি শেষ করেন। স্পষ্টভাবেই সন্দেহভাজন একজন কোভিড-১৯ রোগীকে গুলি করার চিন্তা প্রশ্নাতীত। আবদুল্লাহ গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেন, “যেকোন সরকারি হাসপাতালে পা রাখার চেয়ে কোভিড-১৯ -এ মারা যাওয়া বেশি সম্মানজনক”।

মর্মন্তুদ এই সাক্ষ্যটি অন্যান্য উৎস থেকেও সমর্থিত। সিরিয়ার একটি স্বতন্ত্র পত্রিকা রাজধানীর কণ্ঠস্বরে প্রকাশিত ১০ মার্চের এক প্রতিবেদনে সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসা কর্মীরা দাবি করেছেন যে “রাজধানী দামেস্কের আল-মুজতাহিদ সরকারি হাসপাতালে ওষুধের [চেতনানাশক] অতিরিক্ত মাত্রা প্রয়োগের মাধ্যমে সন্দেহজনক ভাইরাস বহনকারীকে ইচ্ছাকৃত মেরে ফেলার শল্যচিকিৎসা চলছে।”

এই দাবিটি সামাজিক গণযোগাযোগ মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে:

সিরিয়াতে করোনাভাইরাস রোগীদের রোগ নির্ণয়ের কয়েক ঘন্টা পরে আল-মুজতাহিদ হাসপাতালে নিয়ে মেরে ফেলা হয় বলে তথ্য রয়েছে …

দামেস্কের আল-মুয়াসাত হাসপাতালের অপর এক ব্যক্তিও এই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেছে বলে একই নিবন্ধে উদ্ধৃত করা হয়েছে: “এই শেষ করে দেওয়াগুলি সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সাথে পরিচালনা করা হয় এবং সন্দেহজনক ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের দায়িত্বে থাকা ডাক্তাররা সেটা পরিচালনা করেন।”

আসাদের সরকারে যুদ্ধের নির্মম কৌশলগুলির মতোই কোভিড-১৯ মোকাবেলার ক্ষেত্রে সমান্তরাল বেপরোয়া দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করছে। এই যুদ্ধের ফলে ৫,৮৬,১০০ নিহত,  এক লক্ষ আটক ও জোরপূর্বক নিখোঁজ এবং সারা বিশ্ব জুড়ে ৫৬ লক্ষ শরণার্থী হয়েছে।

A now-deleted Facebook post by Firas al-Ahmad reads: “Now what do you think [of this idea]? Do we need to post snipers to force people to stay in their homes? Understand people, understand!”

আসাদপন্থী গণমাধ্যমের সংস্থাগুলি তাদের করোনা ভাইরাস কভারেজে একই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এই প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে সরকারি টিভি কেন্দ্র সিরীয় সংবাদ সংস্থা (আল-ইখবারিয়াহ সিরিয়া)-এর প্রতিবেদক ফিরাস আল-আহমাদ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পৃষ্ঠায় যারা কোয়ারেন্টাইন না মানতে চায় তাদের লক্ষ্যবস্তু করে হুমকি সম্বলিত একটি পোস্ট প্রকাশ করেছেন:

“وهلأ شو رأيكن بالحكي ضروري ننصب قناصات لتنضب الناس ببيوتا، لك افهمو يا ناس افهمو” في تهديد مباشر منه للناس للالتزام بمنازلهم بالقوة.”

“এখন আপনি [এই ধারণা সম্পর্কে] কী ভাবেন? লোকদের ঘরে থাকতে বাধ্য করার জন্যে আমাদের কী লক্ষ্যভেদী বন্দুকধারী নিয়োগ করা দরকার? মানুষকে বুঝুন, বুঝতে চেষ্টা করুন!”

পোস্টটি পরে মুছে ফেলা হলেও প্রমাণ হিসেবে একটি স্ক্রিনশট রয়ে গেছে।

ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং শাসকগোষ্ঠীর টিকে থাকা

আসাদ সরকার তার টিকে থাকার জন্যে ইরানসহ তার মূল মিত্রদের কাছে ঋণী। এই অঞ্চলের কয়েকটি মিত্রসহ ইরানও সিরিয়ার উপর ঝুঁকে পড়েছে।

ফেব্রুয়ারিতে ইরান বিশ্বের অন্যতম কোভিড-১৯ দুর্গত দেশ হয়ে ওঠে এবং সামরিক সহযোগিতাকারী ইরানি সেনাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগের মাধ্যমে লেবানন, ইরাক এবং সিরিয়ার সংক্রমণের একটি সম্ভাব্য উৎসে পরিণত হয়। উপরন্তু, ইরানের তীর্থযাত্রী ও ধর্মীয় পর্যটকরা মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দামেস্ক-ভিত্তিক মাজারগুলি জিয়ারত করেছে বলে জানিয়েছেন লন্ডন অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান স্কুল (এলএসই) প্রকাশিত মার্চ মাসের একটি সমীক্ষার সহ-লেখক জাকি মেহচি।

তবুও আসাদ সরকার কোভিড-১৯ হতাহতের সংখ্যা নিয়ে ভুল তথ্য, বাকচাতুরি এবং অস্বীকারের নীতি অনুসরণ করেছে।

১৩ মার্চ তারিখে সরকারি সিরীয় সংবাদ চ্যানেলের সাথে এক সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজার আল-ইয়াজিজি সিরিয়ায় কোন কোভিড-১৯ ঘটনা্র অস্তিত্ব অস্বীকার করার বিষয়ে জোর দিয়ে বলেছেন: “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে সিরীয় আরব সেনাবাহিনী অনেক জীবাণু থেকে সিরিয়ার মাটিকে পরিষ্কার করেছে:”

২২ মার্চ পর্যন্ত সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্তের ঘটনা ঘোষণা না করায় সিরীয়দের মধ্যে বিরক্তি ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল। তারা বলেছে আসাদ সরকার মিথ্যা বলছে এবং অস্বীকার করার নীতি অনুসরণ করছে। ইয়াজিজির দাবির প্রতিক্রিয়া হিসাবে স্বাধীন সিরিয়া ২৪ সাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এক নাগরিক কড়াভাবে জিজ্ঞাসা করেছে, “আপনি কি আপনার বক্তব্যে বলেননি যে সমস্ত জীবাণু নির্মূল করা হয়েছে?”

তবুও শাসকগোষ্ঠী যুক্তিহীনভাবে কম সংখ্যার প্রতিবেদন  অব্যাহত রেখেছে।

সিরিয়ার বিপ্লবী ও বিরোধী বাহিনীর জোট ১ এপ্রিল তারিখের একটি বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঘটনার যাচাইকৃত তথ্য প্রকাশের জন্যে সরকারকে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

বিপুল সংখ্যক ভুক্তভোগীর অস্তিত্বের উপর জোর দিয়ে জোটটি লিখেছে:

” إن المعلومات الميدانية التي تصلنا، تؤكد تفشي الفيروس بأعداد هائلة، بحيث بات من الصعب السيطرة على هذا الوباء”

সরেজমিন প্রাপ্ত তথ্য নিশ্চিত করে যে ভাইরাসটি প্রচুর সংখ্যায় ছড়িয়ে পড়ে মহামারীটিকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন করে ফেলছে।

একটি ভগ্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা

মহামারীটিকে স্বীকৃতি দেওয়া আসাদ সরকারের জন্যে বিব্রতকর কারণ এটি কর্তৃপক্ষকে স্বীকার করতে বাধ্য করে যে সেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অস্তিত্বহীন।

এলএসই সমীক্ষা অনুসারে সিরিয়ার মতো এক কোটি ৭৫ লক্ষ জনগোষ্ঠীর একটি দেশে এর স্বাস্থ্য খাত কেবলমাত্র সর্বাধিক কোভিড-১৯ সংক্রমিত ৬,৫০০ জনের চিকিৎসা করতে পারে বলে অনুমান করা যায়। ভুক্তভোগীর সংখ্যা এই ক্ষমতাকে অতিক্রম করলে ইতোমধ্যে যুদ্ধ জর্জরিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটি ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পুরো যুদ্ধজুড়ে সামরিক আক্রমণ স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে দেখা যায় যে দেশের ১১১টি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে কেবল ৫৮টি হাসপাতাল পুরোপুরি চালু রয়েছে।

তথ্যে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে শতকরা ৭০ ভাগ পর্যন্ত স্বাস্থ্যকর্মী অভিবাসী বা শরণার্থী হিসাবে দেশ ত্যাগ করেছে, বাকিরা প্রায়শই সামরিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ নান বিধিনিষেধের শিকার।

মানবাধিকার প্রতিবেদন: আসাদ সরকার ৬৯৯ জন চিকিৎসা কর্মীকে হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে ৮৩ জনই নির্যাতনের ফলে মারা গেছে।

চলমান মানবিক বিপর্যয়ের মাঝে কোভিড-১৯

সম্ভবত বেশিরভাগ সিরীয়র মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হলো একসাথে অনেকগুলি বিপর্যয়: যুদ্ধ, মহামারী এবং দুর্ভিক্ষ। ২৬ জুন তারিখে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে যে সিরিয়া এখন একটি “অভূতপূর্ব” ক্ষুধার সংকটের মুখোমুখি রয়েছে, কোভিড-১৯ -এর বিস্তার রোধে এখনো জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া বাকি।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসুচি অনুসারে, খাবারের দাম এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে ১১ শতাংশ বেড়েছে এবং ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১৩৩ শতাংশ। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় সংস্থা (ওসিএইচএ) ১২ জুন তারিখের একটি প্রতিবেদনে এই পরিস্থিতি নিশ্চিত করেছে:

ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাব। একটি অভূতপূর্ব ক্ষুধা সংকট। একটি নতুন প্রজন্ম ধ্বংস এবং বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই জানে না। তহবিলের ব্যাপক অভাব। সিরিয়ার মানবিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘের সংস্থা কী বলেছে তা পড়ুন

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায়, দারা শহরের ২৮ বছর বয়সী আলি আল-আহমেদ (তার পরিচয় সুরক্ষার জন্যে একটি ছদ্মনাম) একটি ফোন সাক্ষাৎকারে গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছেন, “আপনি যতই কাজ করেন না কেন পরিস্থিতি খারাপ, এমনকি দিনে ১০,০০০ সিরীয় পাউন্ড [বাংলাদেশী ৮৫ থেকে ৪২৫ টাকার মধ্যে] আয় করাটাও যথেষ্ট নয়।” আহমেদ বলেন, অত্যধিক ব্যয়ের কারণে বেশিরভাগ মানুষ অনেকগুলি মৌলিক জিনিসপত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।

বছরের পর বছর যুদ্ধের ফলে ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে অনেক সিরীয় দরিদ্র হয়ে পড়েছে। চলমান মহামারীটি দেশটিকে পরিসংখ্যানহীন ও বিপর্যয়কর অঞ্চলের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .