আফগানিরা কেন এখনো বিশ্বের ‘দুর্বলতম’ পাসপোর্টটি চায়?

কাবুল পাসপোর্ট অফিসের বাইরে ২০২১ সালের অক্টোবরে ভিড়। ভয়েস অব আমেরিকার ইউটিউব চ্যানেলের পর্দাছবি। ন্যায্য ব্যবহার।

গণমাধ্যম অংশীদারিত্ব চুক্তির অধীনে হাশ্ত-ই-সুবাহ দৈনিকের জন্যে শাহাব লিখিত এই নিবন্ধটির একটি সম্পাদিত সংস্করণ গ্লোবাল ভয়েসসে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

তালেবান সরকার ১০ ​​জানুয়ারি থেকে কাগজের পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ করা শুরু করবে ঘোষণা করার পর  থেকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের পাসপোর্ট অফিসে হাজার হাজার মানুষ আবেদনপত্র নিয়ে ভিড় করেছে। পূর্বে আবেদনকারীদের অনলাইনে নিবন্ধন করে কখন তাদের পালা আসবে তার জন্যে অনিশ্চিত অপেক্ষা করতে হতো। কেউ কেউ এক বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষা করেছে এবং প্রক্রিয়াটি দ্রুত করার জন্যে ঘুষ দেওয়া রীতিতে পরিণত হয়েছে।

ভিডিওগুলি প্রায় ৩০,০০০ লোক পাসপোর্ট অফিসে পৌঁছানোর চেষ্টা করার বিশৃঙ্খল দৃশ্য প্রকাশ করে। প্রতিক্রিয়ায় তালেবান কর্তৃপক্ষ ভিড় সামলাতে যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন ও প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে। কিছু ব্যক্তি তাদের পালা দ্রুত করার আশায় লাইনে সারারাত অপেক্ষা করেছে। কর্তৃপক্ষ ২১ জানুয়ারি সুবিধার অভাব, ভিড় ও বিশৃঙ্খলার অভিযোগের কারণে ব্যক্তিগত আবেদন স্থগিত করবে বলে ঘোষণা করে। অসুস্থ ও পাসপোর্টের জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত অনলাইন আবেদনগুলিও সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।

এখানে কাবুলের পাসপোর্ট অফিসের বাইরে ভিড় চিত্রিত করা একটি ইউটিউব ভিডিও রয়েছে৷

কিছু সুচক অনুসারে এটি বিশ্বের দুর্বলতম আফগানি পাসপোর্ট অর্জনের আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতাগুলি বিচরণের জন্যে যথেষ্ট ধৈর্য ও দক্ষতার দরকার। পাসপোর্ট অফিসের কাছে মারাত্মক ভীড় নাগরিকরা পাসপোর্ট খোঁজা ও দেশ ছেড়ে যাওয়ার উপায় অন্বেষণের চেষ্টার ইঙ্গিত দেয়। বিদেশে আফগানি অভিবাসীদের সাথে কঠোর ও অমানবিক আচরণের এবং ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের ঝুঁকি থাকলেও কোনো কিছুই আফগানিদের চলে যাওয়া থেকে আটকাতে পারবে বলে মনে হয় না। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার সৃষ্ট মানবিক সংকট ও ব্যাপক বিধিনিষেধ চলমান দেশত্যাগের ব্যাখ্যা দেয়।

বেসামাল বেকারত্ব

অর্থনৈতিক কারণ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক প্রেরণা। কখনোই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী না থাকা আফগানিস্তানে বেকারত্ব দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হলেও ২০২১ সালের আগস্টে তালেবানরা ক্ষমতায় এলে দেশের অর্থনীতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে অসংখ্য কাজের সুযোগ নষ্ট হয়। পাসপোর্ট নিয়ে ব্যক্তিরা তাদের পরিবারকে আর্থিকভাবে সমর্থনের জন্যে ইরান, পাকিস্তানতুরস্কের মতো দেশে চাকরি খোঁজার চেষ্টা করে। বর্তমানে এসব দেশে বসবাসরত লক্ষাধিক আফগানি অভিবাসী স্বদেশে ফেলে আসা পরিবারের অর্থনৈতিক বোঝার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বহন করে।

এখানে আফগানিস্তানে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও দারিদ্র্য সম্পর্কে একটি ইউটিউব ভিডিও রয়েছে৷

নারীদের শিক্ষাকর্মসংস্থানের উপর তালেবানদের আরোপিত সীমাবদ্ধতাগুলি পরিবারের আয়ের ধারাকে দুর্বল করার পাশাপাশি যুবকদের আফগানিস্তানে তাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার জন্যে বিদেশে চাকুরী করতে বাধ্য করেছে। ঐতিহাসিকভাবে, আফগানিস্তানে নারীরা সক্রিয়ভাবে পুরুষদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সুস্থতার জন্যে অবদান রাখলেও তালেবানদের আরোপিত বিধিনিষেধ তাদের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

জাতীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি তালেবানের নিপীড়নমূলক আচরণের সাথে বর্তমান হতাশার অনুভূতি দেশে উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি নিতে ও যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত করে। শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে মন্দার কারণে কর্মসংস্থানের অভাব দেখা দিয়েছে, বেকার যুবকদের বিদেশে যেতে বাধ্য করছে।

উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা

তালেবানদের পুনরুত্থানের পর থেকে মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষায় নিষিদ্ধ এবং নারীদের কাজ, ভ্রমণ ও স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশাধিকার অস্বীকার করার মতো নারী ও মেয়েদের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাগুলি তাদেরকে তাদের বাড়ি ফিরে গিয়ে মধ্যযুগীয় জীবনধারা গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে। তালেবানরা সুস্পষ্টভাবে ষষ্ঠ শ্রেণির পরে মেয়েদের শিক্ষায় প্রবেশে নিষেধ করে। আফগানি মেয়েরা এখনো শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের স্বপ্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করলেও তালেবানদের দমনমূলক সীমাবদ্ধতাগুলি ভয়ঙ্কর বাধা তৈরি করেছে, যা তালেবান-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলিতে এসব আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন প্রায় অবাস্তব করে তুলেছে। ছেলেদের শিক্ষার পরিবেশও প্রতিকূল হয়ে উঠেছে।

ফলে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সংস্থানসম্পন্ন পরিবারগুলি তাদের সন্তানদের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন  ও আধুনিক শিক্ষায় প্রবেশ নিশ্চিত করতে দেশত্যাগ করতে চাইছে। এই ধরনের আকাঙ্ক্ষার জন্যে ছেলে-মেয়েদের আধুনিক শিক্ষা নিশ্চিতের জন্যে যথেষ্ট খরচ বহন করতে প্রস্তুত কিছু পরিবারের পছন্দের গন্তব্য ইরান ও পাকিস্তান।

পাসপোর্টের আবেদনকারী কিছু ব্যক্তির হয় যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন মামলা মুলতুবি রয়েছে, নয়তো তাদের পরিবারের সদস্যরা পশ্চিমে বসবাস করছে। তারা আশা করে তাদের আশ্রয়ের আবেদনগুলি অবশেষে অনুকূল ফলাফল দেবে; ফলে একটি পাসপোর্ট থাকা তাদের জন্যে শেষ কর্মজীবনের অগ্রগতির জন্যে অপরিহার্য। যুক্তরাষ্ট্র যোগ্য ব্যক্তিদের স্থানান্তরের মাধ্যমে তার আশ্রয় প্রদান প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আগস্ট ২০২১ সালে আফগানি প্রজাতন্ত্রের পতনের পর থেকে, লক্ষ লক্ষ মানুষ সফলভাবে পশ্চিমে চলে গেছে।

এই চলমান প্রবণতা আফগানিস্তানে থেকে যাওয়া ও অশান্তি থেকে বাঁচার উপায় অন্বেষণকারীদের তাদের মধ্যে আশা জাগিয়ে তুলেছে। তারা এখনো আশাবাদ করে তাদের প্রচেষ্টা হয়তো একদিন তালেবানি শাসন থেকে তাদের মুক্তির দিকে নিয়ে যাবে। এই মরিয়া ব্যক্তিরা যে কাউকে এই প্রচেষ্টায় সাহায্য করার আবেদন করে, আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার যেকোন সুযোগকে সাগ্রহে ব্যবহার করে, এমনকি গুজবে বিশ্বাস করে গত বছরে দৃশ্যমান আফগানিদের তুরস্কে নিয়ে যাওয়া বিমানের গুজব কাবুলের বিমানবন্দরে ভিড় পর্যন্ত করে।

তরুণদের জন্যে একটি নির্জলা, সম্ভাবনাহীন স্থান

পাসপোর্ট পাওয়ার চেষ্টারত জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে চরম কষ্ট সহ্য করতে ইচ্ছুক তরুণ সম্প্রদায়।এর মূল কারণ হলো তালেবান শাসন যুবসমাজের মধ্যে নিরাশা ও হতাশা সৃষ্টির পাশাপাশি কোনো ইতিবাচক ফলাফল দেয়নি। তালেবান-নিয়ন্ত্রিত এলাকায়, সঙ্গীত ও বিনোদন নিষিদ্ধ, ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ও জমায়েত নিষিদ্ধ, দাড়ি ছাঁটা বা কামানো নিষিদ্ধ, তালেবান-অনুমোদিত ধারার বিপরীতে চুল রাখা নিষিদ্ধ এবং মেয়েদের শিক্ষা নিষিদ্ধ। পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গ ছাড়া বা একাকী নারীদের চলাচলও সীমাবদ্ধ।

স্বাভাবিকভাবেই, কোন সুস্থ ও উদ্যমী যুবক স্বেচ্ছায় এই নিপীড়নমূলক পরিবেশে বাস করতে পছন্দ করে না। তারুণ্য মূলত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও বড় স্বপ্ন দেখার সাথে জড়িত; তারা বিশ্বাস করে যে আফগানিস্তান ত্যাগ করে তারা ভবিষ্যতকে তাদের ইচ্ছামতো গঠন করতে পারবে। যুব সমাজের হতাশার প্রধান কারণ হলো সবকিছুকে নিজের নিপীড়ক আদর্শের সংকীর্ণ লেন্স দিয়ে দেখা একটি শাসকগোষ্ঠী। তালেবানরা জনগণকে দেশে থাকতে বলা হাস্যকর, কারণকিন্তু বাস্তবে, তারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে যেখানে অবশিষ্ট জনগণের জন্যে পালানোই একমাত্র বিকল্প বলে মনে হয়।

অসম্ভাব্য হলেও মনে হয় টিকে থাকলে তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে তালেবানরা শাসন প্রণালী থেকে শিখতে পারে। তবে মাত্র কয়েক বছরের তালেবান শাসন দেশটিকে এক শতাব্দী পিছিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট, কারণ তারা অবকাঠামো ধ্বংস করায় বেশ কয়েকটি প্রজন্ম বঞ্চনা ও নিরক্ষরতায় ভুগছে। নিঃসন্দেহে, এই ধরনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও বঞ্চনার কোনো ক্ষতিপূরণ কখনোই সম্ভব হবে না, হারানো সুযোগ আর ফিরে আসবে না।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .