আজারবাইজানীয় রাষ্ট্র গ্লোবাল ভয়েসেসের বিষয়বস্তু অংশীদার স্বাধীন সংবাদ সংস্থা আবজাস মিডিয়াকে ২০২৩ সালের নভেম্বরে লক্ষ্যবস্তু করেছে। আবজাস মিডিয়ার অসংখ্য সাংবাদিক ও সম্পাদককে ভুয়া দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে যাদের অনেকে এখনো বাকুতে বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের মধ্যে আবজাস মিডিয়ার পরিচালক উলভি হাসানলিকে ২০ নভেম্বর আটক করা হয়েছে। পুলিশ হাসানলির বাড়ি ও আবজাস মিডিয়া অফিস দুটো তল্লাশি করে নগদ ৪০,০০০ ইউরো খুঁজে পাওয়ার দাবি করেছে। তবে হাসানলি টাকার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন। মঞ্চটি ফেসবুক পৃষ্ঠায় এক বিবৃতিতে বলেছে, “আবাজাস মিডিয়া হিসেবে আমরা আপনাদের জানাচ্ছি হাসানলির আটক, তার বাড়ি ও অফিস প্রাঙ্গণে তল্লাশি বেআইনি। যা ঘটছে তা সরাসরি [হাসানলির] সাংবাদিকতার সাথে সম্পর্কিত। আমরা অবিলম্বে হাসানলির মুক্তি দাবি করছি।”
আবসাজ মিডিয়া ২০১৬ সাল থেকে সাইটে জনসাধারণের প্রবেশ অবরোধ করা অসংখ্য পরিষেবা অস্বীকৃতি (ডিডোস) আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত। ওয়েবসাইটটি ২০১৭ সালে অভ্যন্তরীণভাবে অবরুদ্ধ করে ওয়েবসাইট ব্যবস্থাপকদের ওয়েবসাইটের সংযুক্তি পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। আরেকটি সাইবার আক্রমণে ২০২০ সালের এপ্রিলে ওয়েবসাইটটি হ্যাক করার ফলে এটি প্রকাশিত নিবন্ধগুলির এক মাসের মূল্য হারায় এবং কিছু নিবন্ধের শিরোনাম পরিবর্তন করা হয়। মঞ্চটি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
হাসানলিকে ২১ নভেম্বর, ২০২৩ “বিদেশী মুদ্রা পাচারের” অভিযোগে চার মাসের প্রাক-বিচার আটকাদেশ দেওয়া হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তার আট বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
হাসানলি ২৮ ফেব্রুয়ারি তার মেয়ে সুয়াদের কাছে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন। গ্লোবাল ভয়েসেস মূল লেখাটি অনুবাদ করে এখানে প্রকাশ করেছে।
আমার প্রিয় মেয়ের কাছে একটি খোলা চিঠি
আমার সুন্দরী মামণি সুয়াদ! তোমাকে মনে পড়ছে. ৯০ দিন ধরে তোমার হাসি দেখা, জড়িয়ে ধরা, কথা শোনা থেকে বঞ্চিত। আমি ও আমার বন্ধু — সেভিঙ্ক ভ্যাগিফগিজি, নার্গিজ আবসালামোভা, এলনারা গাসিমোভা, মহম্মদ কেকালভ ও হাফিজ বাবালি — আমাদের সাংবাদিকতার জন্যে গ্রেপ্তার হয়েছি।
আমার প্রিয় কন্যা, এখন তোমার বয়স মাত্র এক বছর ছয় মাস। আমাদের গ্রেপ্তারের সময় তখনো তুমি হাঁটতে শুরু করোনি। তবে এক মাস আগে শুনানির এক সময় আমার আইনজীবী জিবেদ আমাকে বলেছে তুমি এখন হাঁটছো। সম্ভবত এটাই আপনার সবচেয়ে সুন্দর ও আদরের সময়। আমি তোমাকে শেষ দেখার সময় তুমি নতুন অনুকরণ ও নতুন আচরণ তৈরি করছিলে। আমি এই মুহূর্তগুলি দেখতে ও অনুভব করতে চেয়েছিলাম। আমি বলি “আমার মনে হতো” কারণ এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন মনে হয়নি আজারবাইজানের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চুরি করে নেওয়া দুর্নীতির তদন্ত ও প্রকাশের জন্যে আমরা যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারি। এবং ঠিক তাই ঘটেছে। আমরা গ্রেপ্তার হয়েছি। কারণ আজারবাইজান বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়নকারী দেশে পরিণত হয়েছে। এবং সাংবাদিকদের এই বিপজ্জনক ও ভীতিকর সময়ে কাজ করতে হবে।
প্রিয় কন্যা আমার, আজ আমি যা লিখছি তোমার তা পড়ার বয়স না হলেও তোমার পাশে না থাকতে পারার জন্যে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমি এই চিঠিটি লিখছি কারণ, ভবিষ্যতে তুমি যখন বুঝতে পারবে আমাকে দোষ দেবে না।
সুয়াদ সোনামণি, তিন মাস আগে গ্রেপ্তারের পর থেকে আবজাস মিডিয়ার সব সাংবাদিককে কঠোরভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমাদের প্রিয়জনদের দেখা, ফোনে তাদের কণ্ঠ শোনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারা হিংস্রভাবে আমাকে এমনকি মাত্র পাঁচ থেকে দশ সেকেন্ডের জন্যে তোমার মতো একটি ১৮-মাস বয়সী শিশুকে জড়িয়ে ধরতে বাধা দিয়েছে। আমি এখনো তোমাকে দেখতে বা আলিঙ্গন করতে পারি না। সোভিয়েত মানসিকতা দেশকে শাসন করায় আজারবাইজানে সর্বগ্রাসী সোভিয়েত শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজকে বাবা-মায়েরা কারণে ছেলেমেয়েরা, আর সন্তানদের কারণে বাবা-মায়েরা শাস্তি পাচ্ছে। আমাদের মায়েদের কার্ড অবরুদ্ধ করে তাদের একমাত্র আয় – পেনশন – তুলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এদিকে আমাদের বন্ধুদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হিমায়িত এবং তাদের দেশত্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
আজারবাইজানের স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সমালোচনামূলক কাজ ও তদন্তের কারণে একটি মিডিয়া সংস্থা পরিপূর্ণ নিপীড়নের সম্মুখীন। যেন আমাদের গ্রেপ্তার করাটাও যথেষ্ট নয়, তারা আমাদের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের যখন তখন ভয় দেখিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। এমনকি গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তরাও এতোটা নিষেধাজ্ঞার মখে পড়ে না। আমরা প্রায়শই মিডিয়া থেকে শুনতে পাই যে অমুক অমুক আসামী তাদের আত্মীয়দের সাথে দেখা করেছে বা তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে ফোনে কথা বলেছে। অথচ আমাদের সাথে নির্বাসন বা বন্দি-শিবিরে পাঠানোর মতো আচরণ করে আমাদের পরিবারের সদস্যদের আমাদের কারণে শাস্তি দেওয়া ও ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে।
প্রিয় কন্যা, আমি তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে এই চিঠি লিখতে পারলেও আমার মনে হয়েছে এটি সবার সামনে প্রকাশ করা বর্তমান ও ঐতিহাসিক রেকর্ডের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে এই চিঠিটি পড়ার সময় তুমি আর ভালভাবে বুঝতে পারবে আজারবাইজান কী অন্ধকার সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে।
মামণি, আজকে এই পর্যন্ত
ভালবাসাসহ,
উলভি
ফেব্রুয়ারি ২০২৪
রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ ২৮ ফেব্রুয়ারি জর্মন পূর্বাঞ্চলীয় ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাহী পরিচালক মাইকেল হার্মসের সাথে সাক্ষাতের সময় জর্মন গণমাধ্যমে আজারবাইজানকে কীভাবে “অনিশ্চিত স্বাধীনতা, মত প্রকাশের জন্যে কারাবন্দি জনগণ এবং স্বৈরাচার শাসিত একটি স্বৈরাচারী দেশ” চিত্রিত করায় আক্ষেপ করে বলেছেন, এগুলি সব বানোয়াট অভিযোগ।
তবে গ্রেপ্তারের ঢেউ ভিন্ন চিত্র এঁকেছে। এই বছরের স্বাধীনতা সদনের বার্ষিক “বিশ্বের স্বাধীনতা” প্রতিবেদনে আজারবাইজানকে “মুক্ত নয়” হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে বার্ষিক সূচকে সীমান্তবিহীন প্রতিবেদক দেশটিকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম স্থানে রেখে উল্লেখ করেছে, “রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ বহুত্ববাদের সকল চিহ্ন মুছে ফেলে ২০১৪ সাল থেকে অবশিষ্ট সমালোচকদের নীরব করার নির্মমভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।”
অন্যান্য মানবাধিকার পর্যবেক্ষক ও সরকার আটকের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্রেপ্তারের বিষয়ে “যথেষ্ট উদ্বেগ” থাকার কথা বলেছে এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদ গোষ্ঠীগুলি বেআইনিভাবে কারাবন্ধিদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে।