আজারবাইজানে আগাম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন

রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ। ছবি: আরজু গেবুলায়েভা

আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ ৭ ডিসেম্বর দেশটির ২০২৫ সালের মূল তফসিলের পরিবর্তে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি আগাম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠনের ঘোষণা সম্বলিত একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেন। আলিয়েভ গত ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন। শেষবার দেশটিতে একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৮ সালে যেখানে আলিয়েভ সাত বছরের মেয়াদের জন্যে (একটি বিতর্কিত গণভোটে ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পাঁচ থেকে সাত বছর করা হয়) পুনরায় নির্বাচিত হন। সকল প্রধান বিরোধী দল ২০১৮ সালে নির্বাচন বর্জন করলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা দেখেছে নির্বাচনগুলি অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না। আজারবাইজান ২০০৯ সালে একটি সাংবিধানিক গণভোটে বর্তমান কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনের মেয়াদের সীমা অপসারণ করে। সুশীল সমাজের বেশিরভাগ অংশ বুড়ো আঙুলের নীচে থাকায় আলিয়েভের পরের বছর নতুন মেয়াদে জয়ী হওয়া প্রায় নিশ্চিত। সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে অনেক পর্যবেক্ষক আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণ জানতে চায়। সর্বোপরি, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় কারাবাখ যুদ্ধ ও নাগর্নো কারাবাখে আজারবাইজানের সর্বশেষ আক্রমণে বিজয় অর্জনের পর আলিয়েভ সমর্থনের তরঙ্গে উচ্চতায় উঠে এসেছেন, যা কারাবাখের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও জাতিগত আর্মেনীয়দের ব্যাপক দেশত্যাগের দিকে পরিচালিত করে।

কূটনৈতিক বিরতি

আজারবাইজানীয় শিক্ষাবিদ ও প্রাক্তন রাজবন্দী আরিফ ইউনুস ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় ও ইউরেশীয় বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী জেমস ও'ব্রায়েনের সফর এই সিদ্ধান্তের সূত্রপাত করে। আজাদ সোজ ইউটিউব চ্যানেলের জন্যে প্রাক্তন কূটনীতিক আরিফ শাহমারলির সাথে একটি সাক্ষাৎকারে ইউনুস বলেন ও'ব্রায়েন ও আলিয়েভের মধ্যে বৈঠকের কয়েক ঘন্টা পরে উভয় পক্ষ ডিসেম্বরে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ওয়াশিংটন ডিসিতে পাঠাতে সম্মত হয়।

বাকুতে ইতিবাচক ও গঠনমূলক বৈঠক হয়েছে। রাষ্ট্রপতি আলিয়েভকে যেমনটি আমি বলেছিলাম যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও জ্বালানি মন্ত্রীর সফরকে স্বাগত জানাবে এবং মন্ত্রী ব্লিঙ্কেন শান্তি আলোচনার জন্যে শীঘ্রই ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বায়রামভ ও মিরজোয়ানকে আমন্ত্রণ জানাতে আগ্রহী।

ওয়াশিংটনে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান ও আজারবাইজানের আলিয়েভের মধ্যে একটি বৈঠকের আয়োজন আলোচ্যসূচিতে থাকলেও সম্মত হওয়ার পরিবর্তে “আজারবাইজান একটি বিরতি নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে আগাম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এর থেকে বোঝা যায় ডিসেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে আসন্ন বৈঠকটি কেবল আনুষ্ঠানিকতা এবং কোন উল্লেখযোগ্য ফলাফল আনবে না,” বলেন ইউনুস। এর মানে হলো একটি আগাম নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে বাকু আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর এড়িয়ে যাচ্ছে বা এতে বাধা দিচ্ছে, যোগ করেন ইউনূস।

শান্তি চুক্তির বিশদ বিবরণ প্রকাশ্যে এলেই আলিয়েভের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। নভেম্বরে ও'ব্রিয়ানের আগের বিবৃতিতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আর আগের মতো চলতে পারে না বলার পর আজারবাইজানকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলি হস্তান্তরের সম্ভাবনার কারণে আলিয়েভ বুঝতে পারেন আগামী বছর যা ঘটবে তাতে পরবর্তীতে তার পক্ষে একটি নির্বাচনী বিজয় সাজানো কঠিন হয়ে পড়বে।

মার্কিন সংসদে ১৫ নভেম্বর “নাগর্নো-কারাবাখের ভবিষ্যৎ” শীর্ষক পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির শুনানিতে ও'ব্রায়েন বলেন:

আমরা স্পষ্ট করেছি ১৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর আমরা শান্তির পথে অগ্রগতি দেখা পর্যন্ত আজারবাইজানের সাথে কিছু স্বাভাবিক হবে না। তাই আমরা বেশ কয়েকটি উচ্চ-স্তরের পরিদর্শন বাতিল করেছি, কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছি… একটি বাস্তব উন্নতি দেখতে না পাওয়া পর্যন্ত আমরা ৯০৭ ধারায় কোনো মওকুফ জমা দেওয়ার আশা করি না।

৯০৭ ধারা ও সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা

আজারবাইজান ১৯ সেপ্টেম্বর পূর্বের বিতর্কিত নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলে একটি সামরিক আক্রমণ শুরু করলে দুই মার্কিন সিনেটর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে একটি চিঠি লিখে বাইডেন প্রশাসনকে “অবিলম্বে নাগোর্নো কারাবাখে আজারবাইজান সরকারের পদক্ষেপের নিন্দা জানানোর অনুরোধ করে এবং ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বাধীনতা সমর্থন আইনের ৯০৭ ধারা মওকুফের মেয়াদ বাড়াবে না।” ১৯৯২ এর ৯০৭ ধারা একটি দীর্ঘস্থায়ী কর্মসূচি যা যুক্তরাষ্ট্রকে আজারবাইজানকে সহায়তা প্রদানে বাধা দিলেও যুক্তরাষ্ট্রকে “আফগানিস্তানে সেনা আনার একটি স্থল সেতু হিসেবে দেশটির ভূখণ্ড ব্যবহার করার” অনুমতি দিলে পরবর্তীতে ২০০২ সাল থেকে প্রতি বছর হোয়াইট হাউস আজারবাইজানকে সাহায্য প্রদানের জন্যে একটি মওকুফ জারি করে। এটি দেশ দুটির মধ্যে বিস্তৃত সামরিক ও নিরাপত্তা অংশীদারিত্বের দরজা খুলে দেয়। এবছর লাচিন করিডোরের নয় মাস দীর্ঘ অবরোধ ও আজারবাইজানের সামরিক আক্রমণের ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে বাকুকে প্রথমে “আর্মেনিয়া ও নাগোর্নো-কারাবাখের বিরুদ্ধে সকল অবরোধ ও শক্তির অন্যান্য আক্রমণাত্মক ব্যবহার বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা” মওকুফটি জারি করার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করেছে।

নভেম্বরে সংসদে “নাগর্নো-কারাবাখের ভবিষ্যৎ” শীর্ষক পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির শুনানিতে ও'ব্রায়েন আরো বলেন ১৯ সেপ্টেম্বরের সামরিক হস্তক্ষেপের আগে এবং পরে “যা ঘটেছিল তার রেকর্ড তৈরি করতে” মার্কিন “স্বাধীন তদন্তকারীদের নিযুক্ত করে।” তিনি আরো বলেন তার দেশ “নাগোর্নো-কারাবাখে বাড়িতে ফিরে যেতে বা এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক স্থানগুলিতে যেতে ইচ্ছুক আর্মেনীয়দের প্রত্যাবর্তনের সুবিধার্থে” আজারবাইজানের সাথে উচ্চ-স্তরের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও সম্পৃক্ততাও বাতিল করেছে। এছাড়াও তিনি বলেন, ” একটি বাস্তব উন্নতি দেখতে না পাওয়া পর্যন্ত আমরা ৯০৭ ধারার একটি মওকুফ জমা দেওয়ার আশা করি না।”

ও'ব্রায়েনের বিবৃতিটি ভালভাবে খাপ খায়নি বলে আজারবাইজান ২০ নভেম্বর নির্ধারিত আর্মেনিয়ার সাথে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বৈঠক থেকে তার পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়

পলিটিকোর সাথে ২০২৩ সালের আগস্টে একটি সাক্ষাৎকারে, আজারবাইজানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ও বুশ প্রশাসনের কর্মকর্তা ম্যাথিউ ব্রাইজা বলেন, “এই বিশেষ মুহুর্তে ৯০৭ ছাড় নিয়ে এগিয়ে যাওয়া বাইডেনের জন্যে একটি রাজনৈতিক ঝঞ্ঝা তৈরি করলেও এই সূক্ষ্ম কূটনৈতিক সন্ধিক্ষণে ৯০৭ মওকুফ ত্যাগ আগের চেয়ে কাছাকাছি একটি শান্তি চুক্তিকে মারাত্মকভাবে লাইনচ্যুত করার ঝুঁকি তৈরি করবে।”

রেডিও লিবার্টি ও ইউরেশিয়ানেটের জন্যে ১৫ নভেম্বর আর্মেনীয় পরিষেবার একটি প্রতিবেদন অনুসারে, “মার্কিন সিনেট “২০২৩ সালের আর্মেনীয় সুরক্ষা আইন” শিরোনামে একটি খসড়া আইন গ্রহণ করেছে৷ আইনে পরিণত হলে এটি প্রশাসনের স্বাধীনতা সমর্থন আইনের ৯০৭ ধারা মওকুফে ২০২৪ ও ২০২৫ সালের জন্যে আজারবাইজানকে সহায়তার বিষয়ে ক্ষমতা বাতিল করে আজারবাইজানের সকল সামরিক সহায়তা স্থগিত করবে৷”

আজারবাইজানের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউরোপীয় সংসদে সদস্যরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ২০২৩ সালের অক্টোবর তাদের সংসদকে বাকুর সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে লক্ষিত নিষেধাজ্ঞা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এছাড়াও সংসদ সদস্যরা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি বাকুর সঙ্গে সকল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থগিত করার আহ্বান জানায়

কিছু প্রতিনিধি ও সিনেট আইনপ্রণেতারাও ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্র বিভাগকে আজারবাইজানের সরকারি কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানায়

এই নিবন্ধটি লেখার সময় পর্যন্ত কোনোটিই গৃহীত হয়নি।

উদ্দেশ্য কি মহৎ?

বাকু ও ইয়েরেভান ৭ ডিসেম্বর একটি বিরল শুভেচ্ছা হিসেবে বন্দী বিনিময়ে সম্মত হয়। দুজন আজারবাইজানীয় সেনার সাথে ৩২ আর্মেনীয় সৈন্যের বিনিময় করা হয়। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী আগামী বছরের সম্মেলনের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের কাঠামোগত কনভেনশন (কপ২৯) আয়োজনের প্রতিযোগিতা থেকে প্রত্যাহারে রাজি হন

দেশে নতুন করে শুরু দমনাভিযানের সময়ে আজারবাইজানের মহৎ উদ্দেশ্যগুলি হাজির হয়েছে। নভেম্বরে স্বাধীন সাংবাদিক উলভি হাসানলি, সেভিঙ্ক ভ্যাগিফগিজি ও প্রতিবন্ধী অধিকার কর্মী মোহাম্মাদ কেকাক্লভের গ্রেপ্তার আজারবাইজানের সাংবাদিকতা ও সুশীল সমাজ সম্প্রদায়ের মধ্যে শোকের তরঙ্গ পাঠিয়েছে। একটি সংগঠিত গোষ্ঠীর চোরাচালানের কথিত অপরাধের চলমান তদন্তের অংশের — যে অভিযোগে হাসানলি, ভ্যাগিফগিজি এবং কেকালভ অভিযুক্ত —  সাক্ষী হিসেবে আরো বেশ কিছু স্বাধীন সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ডাকা হয়। এই সাংবাদিকদের একজন, নার্গিজ আবসালামোভাকে ১ ডিসেম্বর একই অভিযোগে গ্রেপ্তার করে তিন মাসের প্রাক-বিচার আটকাদেশ দেওয়া হয়। একটি পৃথক তদন্তে, আজারবাইজানীয় কর্তৃপক্ষ অবৈধ নির্মাণের অভিযোগে কানাল ১৩-এর প্রতিষ্ঠাতা আজিজ ওরুজভকে আটক ও অভিযুক্ত করেছে, যা তিনি অস্বীকার করেছেন। এর ফলে মাত্র দশ দিনে গ্রেপ্তার হওয়া সাংবাদিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .