নীরব ‘অভ্যুত্থান’ তুরস্কের রাজনৈতিক ও বিচারিক সংকটকে গভীরতর করেছে

ছবি: আরজু গেবুলায়েভা

তুরস্কে প্রথমবারের মতো দেশের দুটি শীর্ষ আদালত — দেওয়ানী, ফৌজদারি ও প্রশাসনিক মামলার জন্যে তুরস্কের শীর্ষ আপিল আদালত সর্বোচ্চ বাতিল আদালত (তুর্কি ভাষায় ইয়ার্গিতে) এবং সাংবিধানিক আদালত (এওয়াইএম) — সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে৷ সংঘর্ষের কারণ সাংবিধানিক আদালতের কারাগার থেকে তুর্কি ওয়ার্কার্স পার্টি (টিআইপি) সদস্য ক্যান আতালেকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো ২৫ অক্টোবরের রায়। আতালে এই বছরের ১৪ মে সাধারণ নির্বাচনে তুরস্কের সংসদের বৃহত্তর জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন। “সরকারকে উৎখাতে সহায়তা করার অভিযোগে” গেজি পার্কের বিক্ষোভের জন্যে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে তাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল।

নির্বাচনের পরে সর্বোচ্চ বাতিল আদালত তার মুক্তির অনুরোধ দু’বার প্রত্যাখ্যানের পর আতালে সাংবিধানিক আদালতে আবেদন করেন। সাংবিধানিক আদালত ৫ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে তার মামলা পর্যালোচনা শুরু করে ২৫ অক্টোবর আতালেকে মুক্তির রায় দেয়।

সর্বোচ্চ বাতিল আদালত আতালের দোষী সাব্যস্ত হওয়া “তার সংসদীয় সদস্যপদ কেঁড়ে নেওয়ার একটি বৈধ সাংবিধানিক কারণ” এর উপর জোর দিয়ে তুরস্কের আইনি ব্যবস্থা অনুযায়ী অবৈধ সাংবিধানিক আদালতের রায় মেনে নিতে অস্বীকার করে – সাংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্ত সকলের জন্যে, এমনকি সর্বোচ্চ বাতিল আদালতের জন্যেও বাধ্যতামূলক। সর্বোচ্চ বাতিল আদালত এছাড়াও সংসদকে “[সংসদ থেকে] আতালের সদস্যপদ অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করার” নির্দেশ দিয়েছে

সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় আতালের আইনজীবী ওজগুর উরফা বলেছেন, “বাতিল আদালত সাংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি না দিয়ে অপরাধ করেছে। এটি একটি বিচারিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা।”

গেজেট দুভারের প্রতিবেদন অনুসারে, বাতিল আদালত “সংবিধান লঙ্ঘন ও তাদের কর্তৃত্ব” অতিক্রমের জন্যে সাংবিধানিক আদালতের সদস্যদের বিচারের দাবী পর্যন্ত করেছে। তুরস্কের জাতীয় আইনি কাঠামো অনুসারে, একমাত্র সর্বোচ্চ ফৌজদারি আদালতই সাংবিধানিক আদালতের বিচারকদের বিচার করতে পারে।

রাজনৈতিক ভাষ্যকার মুরাত ইয়েৎকিন লিখেছেন, “[বাতিল আদালতের] উদ্দেশ্য হলো সাংবিধানিক আদালতের সদস্যদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা”:

পদত্যাগে বাধ্য করার মাধ্যমে আদালত এমন একটি প্রক্রিয়াও এড়াতে চাইতে পারে যা ফৌজদারি অভিযোগের হুমকিতে সাংবিধানিক আদালতের সদস্যদের বিচারে জটিল উভয়সংকট সৃষ্টি করবে।

রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ১০ নভেম্বর উজবেকিস্তান সফর থেকে ফিরে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় বাতিল আদালতের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বলেন, “বাতিল আদালতের সিদ্ধান্তকে একপাশে ঠেলে দেওয়া যাবে না।”

গণমাধ্যম ও আইন শিক্ষা সমিতির (এমএলএসএ) মতে, “সাংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্ত… আইন প্রণয়ন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় অঙ্গ, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ, প্রকৃত ও আইনী ব্যক্তিবর্গের জন্যে বাধ্যতামূলক।”

রাষ্ট্রপতি তার নিজের একেপি পার্টির বাতিল আদালতের রায়ের সমালোচনাকারী আইন প্রণেতাদেরও সমালোচনা করেছেন।

“বিচারিক অভ্যুত্থান”

সাংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান ও আদালতের সদস্যদের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের – দুটো সিদ্ধান্তেরই সমালোচনা করেছে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্বাধীন আইনজীবী ও পর্যবেক্ষকরা৷

গুড (ইয়ি) পার্টির সদস্য বিলগে ইলমাজের মতে, বাতিল আদালত একটি “সাংবিধানিক অপরাধ” করেছে এবং এর সিদ্ধান্ত “আমাদের সাংবিধানিক আদেশের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা।”

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগলুও এই সিদ্ধান্তকে “বিচারিক অভ্যুত্থান” বলে অভিহিত করেছেন

প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস (সিএইচ) পার্টির নবনির্বাচিত সভাপতি ওজগুর ওজেল এক বিবৃতিতে আদালতের সিদ্ধান্তটি “আমাদের সংবিধানের কর্তৃত্ব কেড়ে নেওয়ার একটি প্রচেষ্টা” বলে জনগণকে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে উৎসাহিত করেন।”এই বেআইনিতার কাছে আত্মসমর্পণ না করার জন্যে আমরা রাস্তায় ও ময়দানে নামবো,” ওজেল আরো বলেন।

আতালের পার্টি টিআইপির সভাপতি এরকান বাশ বাতিল আদালতের সিদ্ধান্তকে “একটি নির্লজ্জ অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা” বলে বর্ণনা করেছেন

সাম্প্রতিক সঙ্কটের পর্যালোচনায় গণমাধ্যম ও আইন শিক্ষা সমিতির আইনি দল লিখেছে, “[সর্বোচ্চ] বাতিল আদালত স্পষ্টভাবে সাংবিধানিক আদালতের কর্তৃত্বকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে তার অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।”

উপরন্তু দলটি আপিল আদালতের সাংবিধানিক আদালতের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ দায়েরের সিদ্ধান্তকে বেআইনি এবং অভিযোগ দায়েরকারীদের নিয়ন্ত্রণ করে পদত্যাগ করতে বলা উচিত। এমএলএসএ দলটি এছাড়াও সুপারিশ করেছে:

আপিল আদালতের সাংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্যে একটি নতুন প্যানেল স্থাপন করে সাংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কান আতালের মুক্তি দেওয়া উচিত। উল্টো কোনো আলোচনা ও পদক্ষেপ নেওয়ার মানে তুরস্কের দেড়শত বছরের আইনি ইতিহাসকে ধ্বংস করা। আপিল আদালতের তৃতীয় ফৌজদারি কক্ষের সাংবিধানিক আদেশের বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা শুধু আইনের কাঠামোর মধ্যে নেওয়া দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে বন্ধ করা যেতে পারে।

স্বাধীন নিউজলেটার তুরস্ক রিক্যাপের সাথে কথা বলা পর্যবেক্ষকদের মতে, এতে দুটি রাজনৈতিক দল – ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন (একে) পার্টি এবং একেপির মিত্র জাতীয় আন্দোলন ( এমএইচ) পার্টি – জড়িত থাকার কারণে সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি “আইনি সংকটের পরিবর্তে একটি রাজনৈতিক সংকট” এর লক্ষণ। সাংবাদিক আলিজান উলুদাগের মতে, দুটি আদালতের মধ্যে সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বটি “[একেপি ও এমএইচপি] এর মধ্যে একটি দ্বন্দ্বের শুরু দেখাচ্ছে।”

তুরস্ক রিক্যাপের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে সংসদের একজন জ্যেষ্ঠ্য সদস্য এই পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেছেন: “এখন [একেপি] এমএইচপিকে প্রদত্ত অনেক ক্ষমতা মোকাবেলা্র চেষ্টা করছে। বিশেষ করে বিচার ব্যবস্থায় ও পুলিশি ক্ষমতায় এমএইচপি শক্তিশালী হয়েছে। কিছু সময়ের জন্যে সরকারি অংশীদারদের মধ্যে একটি নীরব যুদ্ধ হয়েছে। এখন এটি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং [সাংবিধানিক আদালত] ও [বাতিল আদালত] এর মধ্যে সাম্প্রতিক লড়াইয়ের ফলাফল এই যুদ্ধের বিজয়ীকে নির্দিষ্ট করবে।”

অতীতে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে এমএইচপি’র নেতা দেভলেত বাহচেলি সাংবিধানিক আদালতকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার দাবি এবং আদালত বিরোধীদলীয় কুর্দি-পন্থী পিপলস ডেমোক্রেটিক (এইচডি) পার্টি বন্ধ না করার পরে এটিকে “বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের পিছনের উঠোন” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সংসদ নির্বাচনে ২০১৫ সালে ৮০টি আসন পাওয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীন একেপি’র সাথে খারাপ সম্পর্কে থাকা এইচডিপি তার সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অস্বীকার করে এবং এরপর থেকে ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার প্রাক্তন যুগ্ম-সভাপতি সেলাহাতিন দেমিরতাসসহ এইচডিপি’র অনেক সিনিয়র সদস্যকে সন্দেহজনক সন্ত্রাস-সম্পর্কিত অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে ২০২২ সালের জুনে তুরস্কের সাংবিধানিক আদালত এইচডিপি বন্ধের দাবিতে একটি অভিযোগ গ্রহণ করলেও মামলাটি চলমান। এইচডিপি ২০২৩ সালের অক্টোবরে তার নাম পরিবর্তন করে জন সমতা ও গণতান্ত্রিক পার্টি (এইচইডিইপি) রেখে আঙ্কারায় একটি কংগ্রেসে দু’জন নতুন যুগ্ম-সভাপতি নির্বাচিত করে

এদিকে এমএইচপি’র নেতা বাহচেলিও ২০২৩ সালের মে মাসে সাধারণ নির্বাচনের পরে সংবিধান পরিবর্তন করে “সাংবিধানিক আদালতের মধ্যেকার বিশ্বাসঘাতকদের নির্মূল করার” প্রতিশ্রুতি দেয়

চলমান সংকটের প্রতিক্রিয়ায় ইস্তাম্বুল আইনজীবী সমিতি “অসদাচরণ” ও “একজন ব্যক্তিকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার” জন্যে বাতিল আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেছে

তুরস্কের আইনজীবী সমিতির ইউনিয়ন ১০ নভেম্বর “আইনের শাসন” ব্যানারে একটি পদযাত্রার আয়োজন করে। আইনজীবীদের সংবিধানের পুস্তিকার বাস্তব কপি হাতে ধরা মিছিলটি আঙ্কারা আদালত ভবনের বাইরে থেকে শুরু হয়ে আপিল আদালতের সভাপতির কার্যালয়ের বাইরে তার চূড়ান্ত গন্তব্য পর্যন্ত চলে যায়

সকল যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ

সর্বশেষ ৮ নভেম্বর, ২০২৩-এ প্রকাশিত ইউরোপীয় কমিশনের বার্ষিক দেশ প্রতিবেদন অনুসারে, সাম্প্রতিক সংকটটি মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বিচারিক স্বাধীনতাআইনের শাসনে দেশটির ইতোমধ্যে পিছিয়ে পড়া ট্র্যাক রেকর্ডের সর্বশেষ।

এমএলএসএ’র মতো অন্যদের আশংকা, আতালের মামলায় সর্বোচ্চ বাতিল আদালতের সিদ্ধান্ত সাংবিধানিক আদালতের ভূমিকাকে বিতর্কিত করতে পারে।

একমত তুরস্কের আইনজীবী সমিতির ইউনিয়নের সভাপতি আইদিন সাকান একটি বিবৃতিতে বলেছেন, “সর্বোচ্চ [বাতিল] আদালতের লক্ষ্য ছিল সাংবিধানিক আদালতের কার্যকারিতাকে বাতিল করা।“

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .