সংবাদ থেকে ফেসবুকের পিঠটান: মেনা অঞ্চলের স্বাধীন স্থানীয় সংবাদের মরণঘন্টা

সাওসেন বেন শেখের ছবি। অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

অনলাইন তথ্যে প্রবেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকা গুগল ও মেটা সাধারণভাবে ইন্টারনেটের দ্বৈত-শাসক হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষের সাথে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাধ্যতামূলকভাবে সংবাদ প্রকাশকদের অর্থপ্রদানের একটি নতুন আইনের প্রতিক্রিয়ায় এই প্রযুক্তি দানবরা কানাডায় তাদের নেটওয়ার্কে সংবাদ অবরোধের প্রস্তুতি নিয়েছে।

সিদ্ধান্তটি বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম শিল্পের মুখোমুখি হওয়া দোদুল্যমান বিজ্ঞাপনের আয় ও পাঠকের জন্যে সামাজিক নেটওয়ার্কগুলির উপর অতি-নির্ভরশীলতার মতো বিস্তৃত চ্যালেঞ্জগুলির সাথে মিলে যায়।

উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা (মেনা) অঞ্চলে ফেসবুকের সংবাদ শিল্পের সাথে পরিবর্তনশীল সম্পর্ক, অ্যালগরিদম সমন্বয় ও স্থানীয় গণমাধ্যম কেন্দ্রের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া বিশেষ করে ছোট স্বাধীন প্রকাশকদের সংবাদ প্রচারের দৃশ্যপটে জটিলতা  বাড়িয়েছে।

সংবাদ শিল্পের সঙ্গে ফেসবুকের অনিশ্চিত সম্পর্ক

ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মূল সংস্থা মেটা ভুয়া খবর ও ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচারের জন্যে অসংখ্য সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেসংবাদ থেকে সাম্প্রতিক প্রত্যাহার ব্যবহারকারী-উৎপাদিত বিষয়বস্তুকে অগ্রাধিকারের দিকে একটি ব্যাপক পরিবর্তনের অংশ হলেও তার মঞ্চে সংবাদের ভূমিকা নিয়ে ফেসবুকের অস্বস্তি প্রকাশ এবারই প্রথম নয়। সংবাদ শিল্পের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা, লক্ষ লক্ষ ডলারের তহবিল ঢোকানো এবং সাংবাদিকতা প্রকল্পের মাধ্যমে গণমাধ্যম প্রশিক্ষণ প্রদানের পর ফেসবুক পিঠটান দিয়েছে।

জনসাধারণ ও নিয়ন্ত্রক চাপের মধ্যে ২০১৮ সালে মার্ক জুকারবার্গ প্রথম ঘোষণা করেন তারা “ব্যবহারকারীদের ব্যবসা, ব্র্যান্ড ও গণমাধ্যম কেন্দ্রের পোস্টের মতো কম প্রকাশ্য বিষয়বস্তু দেখানোর জন্যে “আমাদের ফেসবুক তৈরিতে একটি বড় পরিবর্তন আনতে হবে।” মঞ্চটি বছরের পর বছর ধরে কখন-কীভাবে এটির পোস্টগুলিকে এর কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য বিভাগের নিউজফিডে দেখানোর নিয়ম নির্ধারণ সংক্রান্ত অ্যালগরিদম পরিবর্তন করে তা নিয়ে কুখ্যাত অস্বচ্ছতা রয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ এটির পুনঃনামকরণ “ফিড” করা হয়

সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ইকোবক্স জানিয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ সংঘটিত সবচেয়ে সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য ফেসবুক অ্যালগরিদমের পরিবর্তনটি মে মাসে ত্বরান্বিত হয়৷ এই পরিবর্তনের ফলে প্রকাশক পৃষ্ঠাগুলির বিষয়বস্তু ব্যবহারকারীর ফিড থেকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে৷ এই আকস্মিক পরিবর্তন গণমাধ্যম ওয়েবসাইটের ট্র্যাফিককে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে, মেনা-অঞ্চলসহ বৈশ্বিক দক্ষিণের শ্রোতা ও প্রকাশকদের অসমভাবে প্রভাবিত করছে। এই অঞ্চলগুলি সংবাদে প্রবেশের জন্যে সামাজিক গণমাধ্যমে উল্লেখের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে।

মেনা অঞ্চলে ফেসবুকের অসম প্রভাব

অঞ্চলটিতে সামাজিক গণমাধ্যম ব্যাপক জনপ্রিয়। টিকটক, ইনস্টাগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাটের মতো নতুন মঞ্চের উত্থান সত্ত্বেও মেনা অঞ্চলে ফেসবুক একটি প্রধান শক্তি হিসেবে রয়ে গেছে। অনেকের কাছে এটি নিজেই ইন্টারনেটের প্রতিনিধিত্ব করে। মঞ্চটিতে আরবি তৃতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা। মেনা-অঞ্চলে ২০২২ সালে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় প্রায় ৭২ শতাংশ উত্তরদাতারা দৈনিক ফেসবুক ব্যবহারের কথা জানিয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, লিবিয়া (১০০ শতাংশ), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৯৩ শতাংশ) এবং কাতার (৯০ শতাংশ) তাদের জনসংখ্যার তুলনায় ব্যতিক্রমীভাবে ফেসবুকে পৌঁছেছে। মিশর, মরক্কো এবং আলজেরিয়াও দ্রুততম ক্রমবর্ধমান ফেসবুক ব্যবহারকারী ভিত্তির জন্যে শীর্ষদশে স্থান পেয়েছে।

আরো নাজুক গণমাধ্যম দৃশ্যপট

আরো সক্ষম পরিবেশে তাদের পশ্চিমা সতীর্থদের থেকে ভিন্নভাবে মেনা-অঞ্চলের গণমাধ্যম কেন্দ্রগুলি ডিজিটালাইজেশন, সীমিত সংস্থান ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মতো চ্যালেঞ্জগুলির সাথে দীর্ঘ লড়াই করেছে। এই অনন্য বাধাগুলি তাদের প্রতিবেদন ও বেঁচে থাকাকে নাজুক করেছে। ক্রমবর্ধমান দুর্বল ডিজিটাল সংবাদ দৃশ্যপটে প্রকাশকরা নিজেদেরকে তৃতীয়-পক্ষের মঞ্চের করুণা নির্ভরশীল, যেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সংবাদের জন্যে অ্যালগরিদমের পরিবর্তন কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাঁটাই বা এমনকি ব্যবসায়িক পতন ঘটাচ্ছে।

ইয়েমেনের প্রত্যন্ত প্রান্তিক অঞ্চলের একটি অনলাইন স্থানীয় সংবাদ কেন্দ্র রেইম পোস্টের প্রতিষ্ঠাতা কামেল গ্লোবাল ভয়েসেসকে এই পরিবর্তনের আকস্মিক পরিণতি বর্ণনা করেছেন:

কোনো পূর্ব-সতর্কতা, অন্তর্দৃষ্টি ও প্রস্তুতি ছাড়াই রাতারাতি পরিবর্তন আমাদের বিতরণের প্রধান আমাদের বিষয়বস্তু চ্যানেল ফেসবুকে আর দেখা যায়নি। আমরা ফেসবুক থেকে আমাদের ওয়েবসাইটে আসা  আমাদের প্রায় ৮০ শতাংশ দর্শক হারিয়েছি। খুবই হতাশাজনক। আমাদের শ্রোতা ও ব্যবসা হারিয়ে আমরা সংকটে আছি।

অর্থ না দিলে আপনার দর্শকরা আপনাকে দেখবে না

দৃশ্যমানতার জন্যে মূল্য আরোপের আগে চিরায়ত বাণিজ্যিক ভূমিকা নিয়ে প্রাথমিকভাবে খবরের বিষয়বস্তুর জন্যে বাস্তবে পৌঁছাতে সক্ষম করে ফেসবুক নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছে। এখন ব্যবহারকারীর ফিডে একদা বাস্তবে উপস্থিত সংবাদ বিষয়বস্তু দেখার সুযোগের জন্যে পৃষ্ঠপোষণা আবশ্যক। উপরন্তু, ব্যবহারকারীদের মঞ্চে রাখা ফেসবুকের লক্ষ্য হওয়া বাহ্যিক লিঙ্কসহ পোস্টগুলি নিচুমানের করা হয়েছে।

এই পরিবর্তনটি তরুণ বেকার আলজেরীয় হাসেনের মতো ব্যবহারকারীদের হতাশ করেছে। তিনি গ্লোবাল ভয়েসেসকে জানিয়েছেন, “ফেসবুকের আমরা কী দেখতে চাই তা আমাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত। আমি খবর এবং চাকরি, প্রশিক্ষণ ও শেখার সংস্থান ইত্যাদির সুযোগ পোস্ট দেওয়া আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির হালনাগাদ অনুসরণ করতাম। আমি লক্ষ্য করেছি সেগুলি আর আমার ফিডে আসে না৷ আমি কেবল বন্ধুদের প্রায়শই খুব আকর্ষণীয় বা দরকারী নয় এমন পোস্টগুলি দেখি।”

প্রায়শই রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক সংস্থা অর্থায়িত বৃহত্তর ওয়েবসাইটগুলি তাদের বিষয়বস্তু প্রচারের জন্যে মানিয়ে নেওয়া ও অর্থ প্রদানের ক্ষমতা বেশি থাকলেও, সীমিত সংস্থানের কারণে ছোট স্বাধীন প্রকাশকদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরো নাটকীয়।

জনস্বাস্থ্য শিক্ষার জন্যে নিবেদিত ইয়েমেনের একটি অলাভজনক সংবাদকক্ষ আওয়াফির প্রতিষ্ঠাতা ওয়ায়েল শারহা একসময় অবাধে পাওয়া বিষয়বস্তুর জন্যে চার্জ করার জন্যে ফেসবুকের আক্রমণাত্মক চাপের সমালোচনা করেছেন। তিনি গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছেন:

এখন ফেসবুকের আমাদেরকে বিনামূল্যে পাওয়া বিষয়বস্তুর জন্যে অর্থ প্রদানের দিকে ঠেলে দেওয়াটা খুবই আক্রমনাত্মক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। আমরা তথ্য দিয়ে জনসাধারণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে মঞ্চটির সামাজিক মূল্য তৈরি করছি। আমাদের অঞ্চলে ইতোমধ্যেই আমরা সংগ্রাম করছি, এখন রাজস্ব তৈরি ও স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন করা আরো কঠিন।

ফেসবুকের টিকটকায়

ইন্টারনেটের সূচনা থেকেই লিখিত বিষয়বস্তু তথ্য পৌছানোর প্রাথমিক মাধ্যম। রয়টার্স ডিজিটাল সংবাদ প্রতিবেদন ২০২৩ অনুসারে, দ্রুত ও সুবিধাজনকভাবে তথ্য পেতে বিশ্বব্যাপী বেশিরভাগ অনলাইন ব্যবহারকারী এখনো দেখার বা শোনার চেয়ে খবর পড়তে বেশি পছন্দ করে।

তবে সামাজিক গণমাধ্যম ও স্মার্টফোনের মাধ্যমে সহজে ভিডিও তৈরি ও ভাগাভাগি করার নেওয়ার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মের অভ্যাস বিবর্তিত হয়েছে। এই সামাজিক বাসিন্দারা এখন উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি সংখ্যক প্রচলিত সাংবাদিকদের পরিবর্তে প্রায়শই প্রভাবশালীদের উপস্থাপিত ছোট ভিডিও ব্যবহার করে। এই পরিবর্তনটি ফেসবুক বা টুইটারের মতো আরো পাঠ্য-কেন্দ্রিক নেটওয়ার্কগুলির বিপরীতে ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও সাম্প্রতিককালের টিকটকের মতো আরো দৃশ্যমানতা-ভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্কগুলির সাফল্যের চালিকা।

প্রতিক্রিয়ায় পাঠ্য-ভিত্তিক বিষয়বস্তুর চেয়ে ভিডিওকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্যে তাদের অ্যালগরিদমগুলি সংশোধন করে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম আক্রমনাত্মকভাবে সংক্ষিপ্ত-ফরম্যাট ভিডিও বিষয়বস্তু প্রচার করেছে। পাঠ্য নিবন্ধগুলির অবনমন প্রকাশকদের উপর খারাপভাবে প্রভাব ফেলেছে। অনেক সাংবাদিক সংক্ষিপ্ত ভিডিওর গুরুত্বের সমালোচনা করে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে সংবাদের টিকটকায়ণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে তুচ্ছ করে তুলছে।

ছোট ভিডিওগুলিতে প্রসঙ্গ উপস্থাপন ও জটিল গল্প ব্যাখ্যা করার চ্যালেঞ্জের উপর জোর দিয়ে পরিবেশ-ভিত্তিক একটি তিউনিসীয় ডিজিটাল গণমাধ্যম কেন্দ্র কসমস মিডিয়ার প্রধান মাবরুকা খেদির গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেন, “লিখিত সংবাদ আরো জটিলতা ও বিস্তারিত জানাতে সাহায্য করে। আমরা আগে থেকেই টানাপোড়েনে, তাছাড়া পাঠ্যের তুলনায় একটি ভাল ভিডিও তৈরি করতে অনেক বেশি সংস্থান লাগে।”

গভীরতর সমস্যা: চ্যালেঞ্জপূর্ণ প্রেক্ষাপটে মুক্ত সংবাদমাধ্যমকে সমর্থন

বিজ্ঞাপনের আয় ও দর্শক ক্রমেই  সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চের দিকে স্থানান্তরিত হওয়ায় স্থানীয় অসংখ্য গণমাধ্যম টিকে থাকার জন্যে লড়াই করছে, কিছু ইতোমধ্যে অদৃশ্যও হয়ে গেছে। কোনো মুক্ত, স্বাধীন তথ্য না থাকা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবেদন না করায় মেনার অত্যন্ত দমনমূলক পরিবেশে অঞ্চলগুলির “সংবাদের মরুভূমিতে” পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে৷

বেশিরভাগ মেনা দেশ সীমান্তবিহীন প্রতিবেদকের বৈশ্বিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সূচকের তলানিতে রয়েছে৷ তাদের প্রধানত তরুণ জনসংখ্যা ও অংশগ্রহণে আগ্রহী নারীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও তাদের কণ্ঠস্বর বিস্তৃত করতে এবং জননীতিমালা গঠনে অবদান রাখতে পারার মতো স্থানীয় মঞ্চের অভাব রয়েছে।

সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চ ও গণমাধ্যম শিল্পের দায়িত্ব সম্পর্কে চলমান বিতর্ক একটি গভীরতর বৈশ্বিক সমস্যাকে তুলে ধরে। সারাবিশ্বে সমাজ, বিশেষ করে সংঘাতের প্রেক্ষাপটে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার মৌলিক গুরুত্ব নিয়ে লড়াই করছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতন্ত্র, শান্তি ও উন্নয়নের ভিত্তি।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .