
সৌদি মসজিদ, রাজধানী নোয়াকচটের বারোটি মসজিদের একটি। উইকিমিডিয়া সাধারণের মাধ্যমে পাওয়া ফ্রাসোঁয়া কলিনের ছবি। সৃজনী সাধারণ একইরকম ভাগভাগি ২.৫ অনুমতি।
মোহাম্মদ আহমেদ আবে (কামাল) ও মরিয়ম যৌথভাবে এই নিবন্ধটি লিখেছেন।
মৌরিতানিয়ার ১৯ বছরের স্কুল-ছাত্রী মারিয়া উবেদ ২৬ জুলাই, ২০২৩ তারিখে নিজেকে ধর্মদ্রোহ বা ব্লাসফেমির গুরুতর অভিযোগের মুখোমুখি হতে দেখেন। একটি লিখিত পরীক্ষায় নবী মুহাম্মদকে অসম্মান করার অভিযোগ থেকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সূত্রপাত ঘটে।
তিনি এখন মৌরিতানীয় দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার সম্ভাবনার মুখোমুখি বলে পরিস্থিতির গুরুত্বকে ছোট করা যাচ্ছে না।
যেভাবে ধর্মদ্রোহ মামলাটি বিকশিত হয়েছে
প্রথমে ৩ জুলাই, ২০২৩ তারিখে ধর্মদ্রোহী বক্তব্য সম্বলিত পরীক্ষার খাতাটি শিক্ষার্থীর নাম প্রকাশ না করে ফেসবুকে ভাগাভাগি করা হয়। উচ্চ শিক্ষার মূল প্রবেশদ্বার জাতীয় উচ্চ বিদ্যালয় পরীক্ষা গ্রেড করার জন্যে শিক্ষা মন্ত্রনালয় প্রতিষ্ঠিত বিশেষ সুবিধায় পরিদর্শন করা একজন শিক্ষক এই পদক্ষেপটি নেন।
পোস্টটি ভাইরাল হলে বেনামী শিক্ষার্থীকে লক্ষ্য করে শত্রুতার একটি বিশাল তরঙ্গ দেখা দেয়। মৌরিতানিয়ার পরীক্ষার উত্তরপত্র বিতরণে কঠোর প্রবিধানজনিত নিষেধাজ্ঞা অনলাইনে পাওয়া চ্যালেঞ্জপূর্ণ করে তুলেছে।
সামাজিক গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়লে পরীক্ষার উত্তরপত্রের তদন্তের জন্যে ৭ জুলাই শুক্রবারের নামাজের পর শত শত বিক্ষোভকারী সমাবেশ করে। আন্দোলনকারীরা আদালতে মামলার রেফারেল বিলম্বিত করার জন্যে সরকারের সমালোচনা করে শিক্ষার্থীর পরিচয় প্রকাশ ও বিচার দাবি করে। বিক্ষোভকারীদের কাছে বিক্ষোভের অনুমতি না থাকায় দাঙ্গা পুলিশ হস্তক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গের অনুরোধ করে।
এর কিছুক্ষণ পরেই মৌরিতানিয়ার সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ মৌরিতানীয় উলামা (ধর্মীয় পণ্ডিত) বিলম্বিত পদক্ষেপের জন্যে সমিতি সরকারের সমালোচনা করলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীটিকে চিহ্নিত করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জনদাবির প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর অপরাধ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ডের আবেদনের সুপারিশ করে সমিতি একটি ফতোয়া জারি করে।
কয়েকদিন পরে সংসদ সদস্য মোহাম্মদ বোয় সরকারের সমালোচনার একটি জনপ্রিয় কৌশলের অংশ হিসেবে তিনি পরীক্ষার বিষয়বস্তুতে নবীর নামটি রাষ্ট্রপতির সাথে প্রতিস্থাপন করে একটি নথি প্রচার করে এই মামলার মাধ্যমে মৌরিতানিয়ার রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ঔলদ গাজোয়ানিকে প্রকাশ্যে বিব্রত করার চেষ্টা করেন। যথেষ্ট বিতর্কিত এই চালটিতে উবেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের উপর চাপ বেড়ে যায়।
উবেদকে “নবীকে অসম্মান ও তাকে উপহাস” এবং “ইসলামের পবিত্র মূল্যবোধ ক্ষুন্ন করার জন্যে সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার করার” অভিযোগে বিচারের আগে ২৬ জুলাই কারাগারে রাখা হয়৷ রাজধানী নোয়াকচটের সরকারি অভিসংশক কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা এই তথ্য জানালেও পরীক্ষার উত্তরপত্রের নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু প্রকাশ করেননি।
একটি বিবৃতিতে উবেদের পরিবার মারিয়া ও বিতর্কিত পরীক্ষার উত্তরপত্রের মধ্যে কোনো সম্পর্ক অস্বীকার করে তারা বলেছে তরুণীর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে এবং ইসলামি সম্প্রদায় ও মৌরিতানীয় জনগণের কাছ থেকে সহানুভূতি দাবি করেছে:
আমাদের মেয়ে একটি অনৈতিক পথ অনুসরণ বা নাস্তিকভাবে চিন্তা করেনি, এমনকি স্বীকৃত সামাজিক নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয়নি। যারা তাকে চেনে তারা জানে সে নৈতিক শুদ্ধতা ও বিনয়ের অবতার। তবে আমরা তার মধ্যে প্রত্যাহারের লক্ষণ, কম কথা, ক্লান্তি ও অত্যধিক ঘুম লক্ষ্য করেছি। এই সূচকগুলি সম্ভাব্য অন্তর্নিহিত মানসিক সমস্যার নির্দেশ করে।
ধর্মীয় পণ্ডিত সমিতির সদস্যরা অবশ্য এই দাবির সমালোচনা করেছে।
আল-কুদস সংবাদপত্রের মতে, এই মামলাটি মৌরিতানীয় কর্তৃপক্ষকে সাধারণ জনগণের চাপে পড়ে তরূণীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আহ্বান জানানো ও স্বাধীনতার পক্ষের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যাচাই-বাছাইয়ের মধ্যবর্তী একটি কঠিন অবস্থানে ফেলেছে।
তরুণীটির মৌরিতানিয়ায় কয়েক দশক ধরে দাসত্ব সহ্য করা হারাতিন (প্রাক্তন ক্রীতদাস) সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত থাকা এই দ্বিধাকে আরো জটিল করে তুলেছে। এভাবে আল-কুদস সংবাদপত্র পরিস্থিতিটির সংক্ষিপ্তসার করেছে:
একটি দ্রুত আইনি সিদ্ধান্ত নেওয়া না হলে এই মামলাটি যথেষ্টবিক্ষোভের দিকে ধাবিত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। এটি ২০১৪ সালে ঔলদ মাখাইতিরের একটি অপমানজনক নিবন্ধ উদ্ভূত একটি ঘটনা অনুসরণ করছে। তার মৃত্যুদণ্ড হয় এবং ২০১৯ সাল পর্যন্ত তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আহ্বান জানিয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্প্রদায়ের চাপের কারণে সরকার সাজা কার্যকর করতে হিমশিম খায়।
মৌরিতানিয়ার ধর্মদ্রোহ আইন
মৌরিতানীয় সংসদ ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারা প্রতিস্থাপন করে একটি উল্লেখযোগ্য আইনি সংশোধনী চালু করে। সংশোধিত আইনে “ধর্মদ্রোহী বক্তৃতা” ও “বিদ্বেষমূলক” বিবেচিত কাজে দোষী সাব্যস্তদের জন্যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রাক্তন ধারা ৩০৬ এর বিপরীতে হালনাগাদকৃত আইনটিতে অপরাধী সাথে সাথে অনুতপ্ত হলেও মৃত্যুদণ্ডকে কারাদণ্ডের প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
আল জাজিরার মতে, স্থানীয় আদালতের নির্দেশে শেখ মাখাইতির নামে পরিচিত দাসপ্রথা বিরোধী কর্মী ও ব্লগার মোহাম্মদ ঔলদ শেখ ঔলদ মাখাইতিরকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় মৌরিতানিয়া আইনটিকে কঠোর করেছে।
ধর্মদ্রোহ ও নবীকে অপমান করার অভিযোগে ২০১৪ সালে শেখ মাখাইতিরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মৌরিতানিয়ায় দাসত্বকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট ধর্মীয় গ্রন্থের ব্যবহারের সমালোচনা করে তার লেখা একটি পোস্টের কারণে মূলত এই রায়টি হয়।
প্রাথমিক দুই বছরের সাজা সত্ত্বেও মাখাইতিরকে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর যার বেশিরভাগই নির্জন কারাগারেই কাটাতে হয়। অবশেষে মুক্তি পেয়ে তিনি দেশত্যাগ করেন।
কীভাবে ধর্মদ্রোহ আইন মৌরিতানিয়ার মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে?
আইনটি ২০১৮ সালে অনুমোদন করা হলে এই আইনটি “গুরুতরভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন” ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করবে বলে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলে, “এই সংশোধনটি ধর্ম বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বৈষম্য, শত্রুতা বা সহিংসতার প্ররোচনার জন্যে মৌরিতানিয়ায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে আরো ক্ষুন্ন করার মঞ্চ তৈরি করবে।”
আজকের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলি এমন জায়গায় রূপান্তরিত হয়েছে যেখানে পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পায়। শুধু মৌরিতানিয়া নয় এই প্রবণতা অন্যান্য অনেক ইসলামি দেশেও প্রচলিত। ভিন্নমত পোষণ বা ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীরা প্রায়শই সাইবার উত্যক্তের, চরম ক্ষেত্রে এমনকি সহিংসতার লক্ষ্যবস্তুও হয়ে ওঠে।
এই অনলাইন শত্রুতা বাক-স্বাধীনতার মূল্যবোধকে ক্ষুন্ন করার পাশাপাশি ব্যক্তি নিরাপত্তা ও সুস্থতাকে ক্রসফায়ারের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে যেকোনো আলোচনা প্রচেষ্টা প্রায়শই মারাত্মক প্রতিক্রিয়াযুক্ত ধর্মদ্রোহ, ধর্মত্যাগ ও নাস্তিকতার অভিযোগ তৈরি করে।
মারিয়া উবেদের সাথে জড়িত সাম্প্রতিক ঘটনাটি ধর্মদ্রোহ ও বাক স্বাধীনতার প্রতি মৌরিতানীয় আইনের আচরণ সম্পর্কে পর্যালোচনা করার জরুরি প্রয়োজনকে তুলে ধরে।