তুরস্কে দাবানল না হলে স্যুট পরা লোভীরা বন ধ্বংস করে

আকবেলেন বন ধ্বংস প্রতিরোধে স্থানীয় জনগণের সংগ্রাম সম্পর্কিত একটি তথ্যচিত্রের পর্দাছবি।

তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ মুগলার ইকিজকোয় গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দারা ২০১৯ সাল থেকে তাদের গ্রামের কাছে অবস্থিত আকবেলেন বন উজাড় রোধের চেষ্টা করলেও তুরস্কের ক্ষমতাসীন ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন পার্টির কোনো সুষ্ঠু পরিবেশগত নীতি না থাকায় সবুজ স্থান সংরক্ষণ কখনোই অগ্রাধিকার পায়নি।

গেজি পার্কের ধ্বংস রোধে পরিবেশবাদীদের একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের অভিযান ক্ষমতাসীন সরকারের জন্যে একটি বিশেষ মুহূর্ত যা একেপি’র পরিবেশবিরোধী যাত্রাকে চিহ্নিত করে। তারপর থেকে তুরস্ক জুড়ে প্রায়শই অবশিষ্ট সবুজ স্থান রক্ষা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্প্রসারণ রোধের চেষ্টায় স্থানীয় বাসিন্দারা মঞ্চস্থ ও সংগঠিত অসংখ্য বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সবুজ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে পরিবেশের মূল্যে অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার সাধারণ নাগরিকদের খরচে লোভী কোম্পানিগুলোকে তাদের কোষাগার পূরণ করতে দিচ্ছে। এখানে এই সংগ্রামটি চালু রয়েছে। আকবেলেন বনে ২৪ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বন উজাড় এর একটি নির্লজ্জ উদাহরণ। ইতোমধ্যে বন ধ্বংসের পিছনে থাকা সংস্থাগুলি শুরুতেই প্রকল্পটি স্থগিত করা একটি আদালতের আদেশ মানতে অস্বীকার করেছে

ব্যবসায়িক স্বার্থ

কয়লা-চালিত ৩৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে মুগলায় তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র — ইয়াতাগান (১৯৮২ থেকে চালু), ইয়েনিকোয় (১৯৮৬ থেকে চালু) এবং কেমারকোয় (১৯৯৩ থেকে চালু) — রয়েছে। এই তিনটিই ২০১৪ সালে বেসরকারিকরণ করা হয়। ইয়েনিকোয় ও কেমারকোয়কে লিমাক হোল্ডিং ও ইচতাস এনার্জি প্রতিষ্ঠিত একটি যৌথ কোম্পানি ওয়াইকে এনার্জি কিনে নেয়। লিমাক ও ইচতাস উভয়েই ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে তাদের সম্পর্কের জন্যে পরিচিত

কেন্দ্রগুলির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কোম্পানিগুলি কেন্দ্রগুলির ভগ্ন স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত প্রভাব মোকাবেলায় খুব কমই কাজ করেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা স্থানীয়আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে এই প্রভাবগুলি ব্যাপকভাবে নথিভুক্ত করেছে। এই প্রভাবগুলিও জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়কে ২০২২ সালের মার্চ মাসে এলাকার প্রাকৃতিক জলপাই বাগানগুলিকে উন্নয়নের জন্যে উন্মুক্ত করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যে সবুজ-বাতি খনির কার্যক্রম চালু করার লক্ষ্যে একটি নতুন প্রবিধান চালু করতে বাধা দেয়নি।

একই মাসে পরিবেশ, নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় চতুর্থবারের মতো সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অঞ্চল (জাতীয় উদ্যান, প্রকৃতি উদ্যান, পরিবেশগতভাবে সুরক্ষিত অঞ্চল ও জলাভূমি) নিয়ন্ত্রণকারী একটি প্রবিধান সংশোধন করে খনিজ আহরণ ও নির্মাণের জন্যে এই অঞ্চলগুলিকে উন্মুক্ত করে দেয়। ইকিজকোয় গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের দায়ের করা আদালতে একটি মামলা চলাকালে এই সিদ্ধান্তগুলি ঘোষণা করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে লিগনাইট আহরণের জন্যে ওয়াইকে এনার্জির কাছে ৭৪ হেক্টর (প্রায় ১৮৩ একর) বনভূমি হস্তান্তর করে।

স্থানীয় অনলাইন সংবাদ মঞ্চ বিয়ানেটের প্রতিবেদন অনুসারে ৭৪ হেক্টর জমি খননের প্রয়োজনীয় অনুমতি পেয়ে কোম্পানিগুলি ২৪ জুলাই বনাঞ্চলে চলে যায়। কোম্পানিগুলো দাবি করে বনাঞ্চলের নিচের লিগনাইট দেশে ব্যবহৃত বিদ্যুতের মাত্র এক শতাংশ উৎপাদন করতে কয়লা ব্যবহারকারী ইয়েনিকোয় ও কেমারকোয়ের মতো বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি দেবে।

বিক্ষোভকারীরা এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সেই অনুমতি বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে। পরিবেশগত ১৬টি বেসরকারি সংস্থার স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা বলেছে, “তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি চালু রাখতে অকাল মৃত্যু ও জলবায়ু সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ বন উজাড়ের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়, বরং এর সাথে কাজ করে জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব। আমরা প্রাকৃতিক এলাকা, জলবায়ু ও সমস্ত জীবের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে গত ১০ বছরে আমাদের কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) নির্গমনের অর্ধেকেরও বেশি সৃষ্টিকারী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যে বনকে বলি দিতে পারি না।”

পরিবেশগত অবনমনের পরিণতি

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তুরস্ক খরা, দাবানল, বন্যা ও কাদাধ্বসের মতো বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত সংকট এবং সম্প্রতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির মতো একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্পের শিকার হয়েছে। গ্রীষ্মের তাপ নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর সাথে সাথে তুরস্কে বনের দাবানলের খবর শিরোনাম হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে জলবায়ু পরিবর্তন বা তীব্র আবহাওয়ার পরিস্থিতিতে ভূমিকা রাখলেও এসব বিপর্যয় ও সংকট সরকারি পর্যায়ে গৃহীত দুর্বল পরিকল্পনা ও ভুল সিদ্ধান্তের ফলও বটে।

তুরস্কের জলবায়ু স্বচ্ছতা প্রতিবেদন অনুসারে তুরস্ক তার ৩০ শতাংশেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে কয়লার মাধ্যমে। প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, “২০২১-২০২২ সালে কয়লা-চালিত উৎপাদন কমে যাওয়া সত্ত্বেও তুরস্কের কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করার কোনো ইচ্ছা নেই এবং প্রায় ২০.৪ গিগাওয়াট নতুন কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা পাইপলাইনে রয়েছে যা সারা বিশ্বে ষষ্ঠ৷ চীনের অর্থায়নে ২০২২ সালের জুনে ১.৩ গিগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ব্লক হুনুতলুতে চালু হয়েছে। পাইপলাইনে কয়লা বিদ্যুৎ ক্ষমতা ২০২০ সালের তুলনায় ৬৩ শতাংশ কমলেও উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে বা ২০৫৩ সালের মধ্যে তুরস্কের নিট শূন্য নির্গমনের লক্ষ্য অর্জন করতে নতুন কোন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা যাবে না।”

তুরস্ক শুধু ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুস্বাক্ষর করেছে, যা চুক্তি স্বাক্ষরের পাঁচ বছর পর ২০২১ সালের অক্টোবরে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এসময় তুরস্ক ২০৫৩ সালের মধ্যে নেট-শূন্য নির্গমন অর্জনের লক্ষ্যও ঘোষণা করে।

জলবায়ু উদ্যোগ ট্র্যাকারের মতে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেশটির প্রচেষ্টা “খুবই অপর্যাপ্ত।” আর প্যারিস চুক্তি অনুমোদন শুদ্ধ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়নি। পলিটিকো এবং রয়টার্সেপ্রতিবেদনে বলা হয়েছে পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্যে রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ফ্রান্স, জার্মানি, বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন ও ইউরোপীয় ব্যাংকের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তার নিশ্চয়তা পাওয়ার পরপরই এই সিদ্ধান্ত এসেছে। এর আগে আঙ্কারা বলেছিল অন্যায্য শ্রেণীবিভাগের কারণে তারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। তুরস্ককে একটি “উন্নত” বা “শিল্পায়িত” দেশ অ্যানেক্স ১ গ্রুপের একটি দেশ হিসেবে স্থান দেওয়া হয় যা এটিকে “উন্নয়নশীল” দেশগুলির মতো তহবিল চাইতে বাধা দেয়।

আকবেলেন বনাঞ্চলে বাসিন্দাদের সাহায্যের অনুরোধ ও বন ধ্বংস বন্ধের দাবি চতুর্থ দিনেও অব্যাহত ছিল। একজন বাসিন্দা তুর্কি সংবাদপত্র ইভরেন্সেলের সাথে কথা বলার সময় অনুরোধ করেন, “এই জায়গাটিও চলে গেলে সব জ্বলবে, সারা তুরস্ক জ্বলবে। আসুন আমরা আমাদের পাইন ও বন না কাটি।” অন্য এক বাসিন্দা বলেন, “আমি এমন একটি গ্রাম থেকে এখানে এসেছি যেটি কয়লার জন্যে আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে, এখন তারা আমাকে এখান থেকেও তাড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা কি এই দেশের মানুষ নই? সৈন্যরা আমাদের বাধা দিচ্ছে। আমাদের সাহায্য করুন।” স্থানীয় পুলিশের বলপ্রয়োগ, মরিচ ছিটানো, টিয়ার গ্যাস ও জলকামান ব্যবহারের প্রতিবেদন ও ফুটেজ অনলাইনে প্রচারিত হয়েছে, যা এলাকার পরিস্থিতির গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলেছে:

আকবেলেনে জবাই ও নিষ্ঠুরতা দুটোই চলছে। সবুজ বাম দল ও সিএইচপি’র ডেপুটিদের সাথে একসঙ্গে #আকবেলেনে_বনে প্রবেশের চেষ্টার সময় জেন্ডারমেরি আবারো ইকিজকোয়ের লোকেদের উপর কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে। তিনজনকে আটক করে নির্যাতন করা হয়েছে।

ওয়াইকে এনার্জি, লিমাক ও ইচতাস প্রতিষ্ঠিত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের জন্যে আকবেলেন বনে কাটা শুরু হয়েছে। কয়েক দিন ধরে যারা চলমান হত্যাকাণ্ড রোধ করতে চেয়েছে জেন্ডারমেরি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হস্তক্ষেপ করেছে।

ঘটনাটি কভার করা সাংবাদিকদেরও লক্ষ্যবস্তু করা হয়:

আমাকে চিত্রগ্রহণে বাধা দিতে জেন্ডারমেরি সরাসরি আমার চোখে মরিচ স্প্রে করেছে।

অন্তত দুজন সাংবাদিককে জরিমানা ও বেশ কয়েকজন বাসিন্দাকে আটক করেছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় পুলিশ লোকজনকে এলাকায় প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে এবং ব্যারিকেড স্থাপন করেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .