জ্যামাইকাতে বব মার্লেকে কেন এখনো জাতীয় বীর করা হয়নি?

লন্ডনের হক্সটন সড়কে বব মার্লির ম্যুরাল। ফ্লিকারে লিউক ম্যাককারনানের তোলা ছবি, সিসি বাই-এসএ ২.০

জ্যামাইকার কথা মনে করলেই আপনার বব মার্লের কথা ভাবতে হবে।  তর্কাতীতভাবে মার্লে চার দশকেরও বেশি আগে মারা গেলেও এখনো তিনি জ্যামাইকার সঙ্গীত, সংস্কৃতি এবং বিশ্বদর্শনকে সারা বিশ্বের মনোযোগ কেঁড়ে নিয়ে রেগে সঙ্গীতের একজন পথিকৃৎ হিসেবে স্টক ধরে রাখা ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিখ্যাত রপ্তানি। জ্যামাইকার পরবর্তী সরকারগুলি পর্যটন বিজ্ঞাপনে তার সঙ্গীত ব্যবহার, বব মার্লে যাদুঘরকে অবশ্যই দেখার আকর্ষণ হিসেবে প্রচার এবং এমনকি গাঁজাকে অপরাধমুক্ত (মার্লে ছিলেন একজন কট্টর রাস্তাফারি, যে ধর্মে গাঁজার ব্যবহার আধ্যাত্মিকতা পালনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ) করে তার স্থায়ী তারকা শক্তি সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন থেকেছে।

বিশ্বজুড়ে সম্মানিত হলেও মার্লে এখনো তার জন্মভূমিতে চূড়ান্ত স্বীকৃতি: জাতীয় বীরের খেতাব অর্জন করতে পারেন নি। ৫ এপ্রিল তারিখে বিভিন্ন কারণের মধ্যে মার্লির শান্তির বার্তা, তার কৃষ্ণাঙ্গ চেতনা এবং অন্যায়ের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্পষ্টভাষা তৈরি, তার “দরিদ্র এবং অধিকারহীনদের জন্যে গীতিমূলক সক্রিয়তা” তার রেগে এবং রাস্তাফারি উভয়েরই দুর্দান্ত উপস্থাপনা, এবং তার উদারতা এবং “এক প্রেম” দর্শনের জন্যে তাকে মরণোত্তর এই সম্মান দেওয়া উচিত উল্লেখ করে দীর্ঘ-স্বীকৃত এই বিস্মরণটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদে নিয়ে যান প্রাক্তন সংস্কৃতি মন্ত্রী লিসা হান্না:

জ্যামাইকার জাতীয় বীরেরা ছোট একটি একচেটিয়া ক্লাবের অন্তর্গত যার সদস্য বর্তমানে মাত্র সাত জন। নিখিল-আফ্রিকাবাদী মার্কাস গার্ভেই প্রথম এই সম্মানটি অর্জন করেন। অন্যান্য বীরদের মধ্যে রয়েছেন মোরান্ট উপসাগরীয় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়ে ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের হাতে  নিহত ঊনবিংশ শতকের ডিকন এবং সক্রিয় কর্মী পল বোগল; ক্রীতদাস আফ্রিকীয়দের বীর জর্জ উইলিয়াম গর্ডন; জ্যামাইকাকে শেষ পর্যন্ত দাসপ্রথা বিলুপ্তির দিকে পরিচালিত করা একটি বিদ্রোহ মঞ্চস্থকারী  স্যামুয়েল শার্প; জ্যামাইকার স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি নরমান ম্যানলি; দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার বুস্তামান্তে; এবং তীক্ষ্ণ সামরিক কৌশল তার জনগণের জন্যে স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে সাহায্যকারী অষ্টাদশ শতকের মেরুন নেত্রী একমাত্র নারী বীর মেরুন ন্যানিজাতীয় বীর আদেশ সম্মাননাটি ১৯৬৯ সালে পাস হওয়া  দেশের জাতীয় সম্মান ও পুরস্কার আইনে বিশদভাবে বর্ণিত রয়েছে।

ফেসবুকে হান্না আরো লিখেছেন:

আমাদের জাতীয় সম্মান ও পুরস্কার আইনে জাতীয় বীরের মূলমন্ত্র বর্ণিত রয়েছে: ‘তিনি ভিতসহ একটি শহর গড়েছেন।’
আজকে বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতে আরো বেশি জর্জরিত এবং জাতি রাষ্ট্রগুলি তাদের জনগণের অর্থনৈতিক বেঁচে থাকার বিষয়ে উদ্বিগ্ন বলে আমাদের মানবতাকে পরস্পরের সাথে পুনরায় যুক্ত করার জন্যে আমাদের ববের নির্দেশনা, আশ্বাস এবং বিপ্লবী ক্ষমতায়নের প্রয়োজন।

প্রজাতন্ত্র হওয়ার বিষয়ে যদি আমরা মনোযোগী হয়ে থাকি, তাহলে আসুন প্রথমে আমাদের জীবন এবং বৈশ্বিক গ্রামের উপর তারা যে বিশাল প্রভাব ফেলেছে তা স্বীকার করে আমাদের নিজেদেরকে আলিঙ্গন করে সেটা প্রদর্শন করি। এখন বব মার্লেকে আমাদের অষ্টম জাতীয় বীর বানানোর সময় এসেছে।

সামাজিক গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়াগুলি দ্রুত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে আসে। অনেকে সবিস্ময় প্রকাশ করে ইতোমধ্যে মার্লেকে কেন এই জাতীয় সম্মান প্রদান করা হয়নি। আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক কিছু অর্জনের জন্যে ইস্যুটি ব্যবহারের জন্যে হান্নাকে অভিযুক্ত করলেও বিশেষ করে স্থানীয় রাস্তাফারি সম্প্রদায়ের সাথে কর্তৃপক্ষের সাথে আশঙ্কাজনক সম্পর্কের আলোকে অন্যান্যরা এই পদক্ষেপটিকে “দীর্ঘ বিলম্বিত” অনুভব করে।

দারোগাকে কে গুলি করেছে তথ্যচিত্রটি দেখে বব মার্লে সম্পর্কে নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছি। আক্ষরিকভাবেই তিনি তার জীবনকে সারা দেশে শান্তি উত্সাহিত করার পথে নিযুক্ত করেছিলেন। সঙ্গীতের মাধ্যমে আমাদেরসহ বিভিন্ন জাতির অধিকারের জন্যে ছিল তার প্রচারণা…. সত্যিকারভাবে জাতীয় বীর।

জনগণ মার্লের সঙ্গীতের টেকসই প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করার সময় অনেকে এমনকি মনে করছে যে জাতীয় বীরের উপাধির জন্যে হয়তো আলাদা মানদণ্ডের প্রয়োজন। ফেসবুক ব্যবহারকারী ইউনিক ইয়ান প্রাইস ব্যাখ্যা করেছেন:

বব মার্লেকে দেওয়া জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রশংসা নিয়ে আমার একেবারেই কোন সমস্যা নেই। পেশাদারভাবেই তিনি এর যোগ্য। তবে জাতীয় বীর হিসেবে না, কখনোই না। সেটা বহু দূর। সেখানকার সাতজন নিঃস্বার্থভাবে তাদের খেতাব অর্জন করেছে। ব্যক্তিগত কোন স্বার্থ ছাড়াই এই দেশ এবং আগামী প্রজন্ম[গুলো]র জন্যে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেছে […] যাতে আমরা প্রতিটি উপায়ে স্বাধীন থাকতে পারি। […] তাই বব মার্লে এবং উসাইন বোল্টকে এই শ্রেণিতে রাখা পাগলামি।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিরোধীদলীয় সিনেটর ফ্লয়েড মরিস জ্যামাইকার চার সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব – মার্লে, জিমি ক্লিফ, উসাইন বোল্ট এবং লুই বেনেট-কাভার্লি-কে ব্রিটেনের কাছ থেকে দেশটির স্বাধীনতার ৬০তম বার্ষিকী ২০২২ সালের ৬ আগস্টের মধ্যে জাতীয় বীর হিসেবে অভিষিক্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ঘটনাক্রমে প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে জ্যামাইকার ইতিহাস মার্লের বীর মর্যাদার পক্ষ সমর্থনকারীদের যুক্তির অংশ হয়ে উঠেছে। ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর ব্রিটেন থেকে নিজেদের স্বাধীনতার ৫৫তম বার্ষিকীতে  বার্বাডোস তার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে ত্যাগ করে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি প্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠে এবং বার্বাডোসে জন্ম নেওয়া পপ তারকা রিহানাকে জাতীয় বীরের খেতাব প্রদানের জন্যে এই উপলক্ষটি ব্যবহার করে।

একদা “ক্ষুদ্র ইংল্যান্ড” অভিহিত একটি ক্যারিবীয় দ্বীপ বার্বাডোসের ঔপনিবেশিকতার চিহ্নটিকে এমন একটি ইচ্ছাকৃত উপায়ে ছূঁড়ে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি জ্যামাইকা এটি অনুসরণ করবে কি বা কখন করবে সে সম্পর্কে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। গত মাসে দেশেটিতে কেমব্রিজের ডিউক এবং ডাচেসের একটি বিশ্রী সফরে চতুরতার সাথে প্রিন্স উইলিয়ামের ক্ষতিপূরণের কথা এড়িয়ে যাওয়া এবং দাসত্ব চাপানোর জন্যে ক্ষমা চাওয়ার কাছাকাছি কিছু বলার পরে উভয়েই প্রজাতন্ত্র মর্যাদার এবং শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী নাগরিকদের সম্মানের কারণে জ্যামাইকার উপর আবারো বার্বাডোসের পদাঙ্ক অনুসরণের চাপ বেড়েছে। বার্বাডোসের সিনেটর ক্রিস্টাল হেইনস টুইট করেছেন:

আজ জ্যামাইকার বিরোধীদলীয় সাংসদ এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে আমার প্রিয় নারীদের একজন @লিসাহান্নাএমপি বব মার্লেকে জাতীয় বীর হিসেবে মনোনীত করার জন্যে জ্যামাইকার সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন।

বার্বাডোসে বসবাসকারী একজন জ্যামাইকাবাসী ভাবছেন:

এজন্যেই @লিসাহান্নাএমপি এখনি জ্যামাইকার একজন জাতীয় নায়ক হিসেবে বব মার্লির স্বীকৃতির জন্যে এগিয়ে এসেছেন। আমি হ্যাঁ বলতে চাইলেও রীতার সাথে তার আচরণটা তার বিরুদ্ধে বাধ সেধেছে।

এদিকে আরেকজন জ্যামাইকাবাসী জিজ্ঞেস করেছেন:

আমরা কতবার এই ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছি? বব মার্লে মারা যাওয়ার সময় রিহানার জন্ম না হলেও সে ইতোমধ্যেই তার নিজ দেশের জাতীয় বীর। আর কতকাল ব্যাবিলন রাস্তা(ফারি)কে নির্যাতন করবে, এমনকি মৃত্যুর পরেও? গংকে তার পাওনা দিয়ে দাও। এখনই ঠিক সময়! সমস্যাটা কী?

ফেসবুকে রবিন লিম লামসডেন লিখেছেন:

জ্যামাইকা কি সামাজিক ন্যায়বিচার এবং বিশ্ব শান্তির উন্নতি ও সচেতনতায় অবদান রাখা কোন ব্যক্তিকে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে জাতীয় বীরে পরিণত করা শেষ দেশ হতে চলেছে? তিনি সম্ভবত সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত জ্যামাইকাবাসী। তিনি যেমন গেয়েছিলেন আমরা তেমনি জাতি হিসাবে বিব্রতকরভাবে প্রাদেশিক মনে করি এবং এখনো পশ্চাদপদ ঔপনিবেশিক গালাগাল ও ভণ্ডামি দিয়ে শাসিত। হয়তো আমরা বব মার্লেকে যে মাটি থেকে তিনি এসেছেন সেই মাটির ছেলে হিসেবে আলিঙ্গন না করার মতো অবিশ্বাস্যভাবে বোকা। কেউ মানুক বা না মানুক, জ্যামাইকার সাথে সারাবিশ্বের জনগণের প্রধান সংযোগকারী তিনি।

“প্রধান সংযোগকারী” হোন বা নাই হোন, জ্যামাইকা তার সবচেয়ে বিখ্যাত নাগরিককে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়ার জন্যে বেছে নেবে কিনা তা এখন দেখার বিষয়।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .