সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া মানেই আপনি স্বাধীন না: বেহরুজ বুচানি, লেখক ও শরণার্থী


অভিবাসীদের দেশ বলা হয় অস্ট্রেলিয়াকে। তবে শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি দেশটির আচরণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো বিশদ বলতে পারবেন ইরানি-কুর্দিস লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংবাদিক বেহরুজ বুচানি। তিনি শরণার্থী হয়ে মানুস দ্বীপের ক্যাম্পে থেকেছেন ছয় বছর। পাপুয়া-নিউগিনির একটি দ্বীপে অবস্থিত ক্যাম্পটি ২০১৭ সালে বন্ধ হয়ে গেলে বুচানিকে (পাপুয়া নিউ গিনির রাজধানী) পোর্ট মোর্সবিতে স্থানান্তর করা হয়। সাথে সাথে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তার ভবিষ্যত।

বুচানির টিকে থাকার মনোবল ও ক্যাম্পের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বকে জানানোর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তাকে আরো সংকল্পবদ্ধ করেছে। তিনি সাথে রাখা ডায়েরি থেকে তথ্য এবং তার হোয়াটসঅ্যাপ বার্তাগুলোর সঙ্কলন করে ‘নো ফ্রেন্ড বাট দ্য মাউন্টেনসঃ রাইটিং ফ্রম মানুস প্রিজন (পাহাড় ছাড়া আর কোন বন্ধু নেইঃ মানুস জেল থেকে লিখছি) ” নামে একটি জীবনকাহিনী লিখেছেন। এর জন্যে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে পেয়েছেন সাহিত্যে ভিক্টোরিয়ান পুরস্কার ও নন ফিকশন বিভাগে ভিক্টোরিয়ান প্রিমিয়ার পুরস্কার।

বুচানির বই আর গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টের মতে, মানুস আইল্যান্ডের শিবিরগুলোতে আটক থাকা অবস্থায় অন্তত ১৬ জন মারা গেছেন। এছাড়া আত্মহত্যা, নিজেকে আঘাত বা চরম সহিংসতার মত ঘটনাও ঘটছে। নারী ও শিশুসহ আটকৃতদের সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ছেড়া ও গন্ধযুক্ত তাবুতে ইঁদুর ও তেলাপোকার সাথে তাদের থাকতে হয়েছে, সাথে ছিল অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা। এর জন্য দায়ী অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার সীমানার বাইরে শরণার্থীদের যাচাই করার নীতি। এর লক্ষ্য যারা নৌকা বা এই জাতীয় যানবাহনে করে অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় চাইতে আসে তাদের নিরুৎসাহিত করা।

এখানে রয়েছে বেহরুজ বুচানির মোবাইল ফোনে ধারণ করা মানস ক্যাম্প ডকুমেন্টারির ট্রেলার: 

সম্প্রতি বুচানির সঙ্গে ফারসি ভাষায় হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলার সুযোগ পাই। সেই সাক্ষাৎকারের অনুবাদ এখানে-

ফ্রেড পেট্রোসিয়ান: এই বন্দি শিবিরগুলোতে শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের সাথে অপরাধীদের মতো আচরণ করা হয়। যদিও তারা কোনো অপরাধ করেননি। আপনি মনে করেন, এর চেয়েও জঘন্য অবস্থা তাদের। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলুন।

বেহরুজ বুচানি: আগেই আপনাকে বুঝতে হবে, শিবিরে থাকা কোনো ব্যক্তিরই অধিকার বলতে কিছু নেই। যেখানে কারাগারে বন্দি থাকা অপরাধীরা শোচনীয় অবস্থার মধ্যে থাকলেও কাউকে ফোনে জানানোর মতো কিছু মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারে; সেখানকার শরণার্থীরা এ ধরনের ন্যূনতম কোনো অধিকার পেতেন না।

সময়ই ভালো বলতে পারে মূল অবস্থা আসলে কেমন। কারাগারের বন্দিরা জানে তাদের কতদিন এখানে থাকতে হবে; কিন্তু আমরা তা জানি না। আমরা এটাও জানি না কবে এই শিবির থেকে চলে যেতে পারবো। এটা এক রকম মানসিক নির্যাতন। একটা কারণই, যেটা খুবই অস্বস্তিকর, এখানে সময় একদমই কাটে না।

এফপি: এই অবস্থায় একজন কিভাবে প্রতিবাদ করতে পারে?

বিবি: দুই রকমভাবে। একটা হলো ব্যক্তিগত, তা অনশন ধর্মঘট হতে পারে। মানুষের কোনো কিছুর প্রতি বিরোধ পোষণ করার নানা মাত্রা আছে। আমি লিখতে শুরু করেছি, আরেকজন এক বর্গমিটার বাগান তৈরি করেছে, একজন গান করছে। নিজের ক্ষতি করাও বিরোধ পোষণ করার আরেকটি মাধ্যম। আপনার শরীরকে হাতিয়ার বানানো হয় এখানে। কারণ শরীরও এক ধরনের রাজনৈতিক হাতিয়ার। গুনলে একশরও বেশি ব্যক্তি পাওয়া যাবে যারা নিজের সাথে এই রকম করছে। কয়েকটি রিপোর্টেও শরণার্থীদের এই অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।

আরেকটা হলো দলবদ্ধভাবে বিরুদ্ধ আচরণ করা। ২০১৪ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে সবচেয়ে সফল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। শিবির রক্ষী ও শরণার্থীরা সবাই আক্রমণ শুরু করে দেয়। এতে এক শরণার্থী মারা যান। তার নাম রেজা বারাতি। ওইসময় দুই সপ্তাহজুড়ে বন্দিরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করেন। এরপর দ্বিতীয় বিদ্রোহ হয় ২০১৫ সালে। এইসময় ৮০০ বন্দি দুই সপ্তাহ ধরে অনশন ধর্মঘট করে।

শিবির কর্তৃপক্ষ আমাদের ওপর চড়াও হওয়া শুরু করে। আমাদের কয়েক নেতাদের কারাগারে স্থানান্তর করে। দুইটা শিবিরে হামলা চালায় এবং অনেককে মারধর করে। তৃতীয়বারের মতো ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালে। যখন বন্দিরা নতুন জায়গায় স্থানান্তর হতে অস্বীকৃতি জানায়। এটা শান্তিপূর্ণভাবে ২৩ দিন ধরে চলে। কিন্তু শেষে আমাদের ওপর হামলা চালানো হয় এবং অনেকেই আহত হন। এর সাথে স্থানীয়দের আক্রমণের শিকার হয় শরণার্থীরা। এর মূলে ছিলো যে, অস্ট্রেলিয়া অপপ্রচার চালায় আমরা এই সমাজের জন্য ক্ষতিকর, বিপদজ্জনক।

এফপি: আপনি লিখেছেন শরণার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ভীতি ছড়িয়ে বিভাজনের সৃষ্টি করছে। শরণার্থীদের তুলে ধরা হয় অপরাধী হিসেবে আর স্থানীয়দের বর্বর হিসেবে। এই সমালোচনা থেকে মানুষ আদৌ বের হয়ে আসতে পেরেছে?

বিবি: একদম প্রথম থেকেই ভয়ের ওপর ভিত্তি করে এই বিষয়টি চলে আসছে। স্থানীয় ও শরণার্থীদের মাঝে অবিশ্বাস ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়েছে। দুই দলই ভুক্তভোগী। কিন্তু যখন শরণার্থীরা বাইরে যাওয়া শুরু করে এবং স্থানীয়দের সাথে মিশতে থাকে তখন এই আলোচনাটি ম্লান হয়ে যায়; তবে সন্দেহ কিন্তু থেকেই যায়।

এফপি: তাহলে নিউজিল্যান্ডে ১৫০ শরণার্থী স্থানান্তরের প্রস্তাবটি অস্ট্রেলিয়া কেন অগ্রাহ্য করে? এটাকে মানব পাচারকারীদের সুযোগ করে দেয়া হিসেবে কি কারণে ধরা হয়?

বিবি: কারণ, অস্ট্রেলিয়ার লিবারেল পার্টি কখনোই চায়নি এই বন্দি শিবিরগুলো বন্ধ হোক। এর কয়েকটি কারণ আছে; প্রথমে, লিবারেল পার্টির কৌশল হলো এই বন্দি শিবিরগুলোর মাধ্যমে ভয়ভীতির সৃষ্টি করে লেবার পার্টির সাথে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা করা। মানে এই বিষয়টা বুঝিয়ে দেয়া যে, ‘আমরা যদি না থাকি, তাহলে নৌকার চড়ে আসা মানুষগুলো আরো ভিড়তে থাকবে।” এই যুক্তি সত্য নয়। নৌকা আর ভিড়তেই পারবে না, কারণ তীরে আসার আগেই তাদের বিতারিত করে জোরপূর্বক পাঠিয়ে দেয়া হয়। মানুস ও নাউরু শিবিরে প্রতিরোধের কোনো প্রভাব পড়েনি। আর এই বন্দি শিবিরের পেছনে রয়েছে অগণিত টাকার খেলা। এর ভেতরকার দুর্নীতি রয়েছে প্রায় বিলিয়ন ডলারের। সবশেষে আরেকটা কারণ হলো বর্ণবাদ ও মানসিক বিকারগ্রস্ততার জন্য এখানকার মানুষগুলো বেশ ভুগছে।

এফপি: সম্প্রতি, মানস শিবিরের একজন শরণার্থী সুইজারল্যান্ডে মানবাধিকার পুরস্কার আনতে যান। সেখানকার লোকজন অস্ট্রেলিয়ার এই বন্দি শিবির সম্পর্কে একবারেই অবগত না। এটা কিভাবে সম্ভব? এই বিষয়ে কিভাবে সচেতনতা তৈরি করা যায়?

বিবি: এই ছয় বছর রাতদিন আমি লিখেই চলছি। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আমরা উদার পশ্চিমা সরকারের আওতায় আছি আর জনগণের কাছে এই সরকার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রয়েছে। মানুসে শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে যারা জড়িত তারা এখান থেকে বের হওয়ার পথ তৈরি করতে পারে, সবার মাঝে স

চেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, আমার বই ২৫টি দেশে প্রকাশিত হয়েছে এবং আমার নির্মিত চলচ্চিত্র অনেক আন্তর্জাতিক ফেস্টিভেলে দেখানো হয়েছে। মিডিয়া ছাড়াও মানুষ শিল্পের ভাষায় এই বিষয়গুলো বুঝতে পারে, সচেতন হতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ার জনগণের মধ্যেও এই বিষয়ে বেশ উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। দেশটির লেবার পার্টি দাবি করেছে যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডাটন অস্ট্রেলিয়ার সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। তার মতে, ২০১৪ সাল থেকে এখানে ৮০,০০০ মানুষ বিমানে করে শরণার্থী হিসেবে এসেছেন। এর সাথে জড়িত দুর্নীতির অভিযোগ, রয়েছে বিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি এবং নতুন কর্মসংস্থানের রাজনীতি।

আন্তর্জাতিকভাবে নামকরা প্রতিষ্ঠান ও বিখ্যাত তারকারা; এর মধ্যে রয়েছের রাসেল ক্রো এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল -এই বরবর্তার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করেছেন। আবার অনেক রাজনীতিবিদরা এই রকম নীতির প্রশংসাও করেছেন। ইতালির প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী মাতেও সালভানি অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন নীতিকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। অনেকের মতে, শরণার্থীদের প্রতি ট্রাম্পের বিদ্বেষমূলক আচরণ অস্ট্রেলিয়ার এই অভিবাসন নীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .