যুদ্ধ আর নিরাপত্তাহীনতায় আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক অর্জনগুলো যখন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিলো, ব্যক্তি মিনা মঙ্গল তখন তার কর্মকাণ্ডের জন্যে অগ্রগতির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। গত ১১ মে, ২০১৯ তারিখে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
রাজনীতিকে জীবনব্রত হিসেবে গ্রহণ করা মিনা মঙ্গল আফগানিস্তানের সংসদের নিন্মকক্ষ ওলেসি জিরগা বা গণপরিষদের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সেদিন সকাল সাড়ে সাতটায় আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের পূর্বাঞ্চলীয় উপকণ্ঠে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে মঙ্গল নিহত হন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৩০ বছর।
তবে রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে আফগানদের কাছে উপস্থাপিকা হিসেবেই তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন। লেমার টিভি, শামশাদ টিভি ও এরিয়ানা টিভি নামের তিনটি বেসরকারি চ্যানেলে তিনি বেশ কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। এরিয়ানা টিভিতে একটি জনপ্রিয় নারী-অধিকার বিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকাও তিনি।
দেশটিতে তালেবান শাসনের সময় সৃষ্ট তথ্য-শুন্যতা কাটাতে (তখন টিভি নিষিদ্ধ ছিল) এবং গণমাধ্যমের পুনর্গঠনে এইসব বেসরকারি চ্যানেলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এটা এখনো পরিষ্কার না কে বা কারা মঙ্গলকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের পূর্বাঞ্চলীয় উপকণ্ঠে সকাল ৭:৩০ এর সময় গুলি করেছিল। মঙ্গলের বাবা তালেব জান বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানান, স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর পারিবারিক বিরোধের জেরেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে বলে তার ধারণা।
মিনার পেশাদার কর্মকাণ্ডের সাথে হত্যাকাণ্ডের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য আফগান সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে ‘নাইয়া মিডিয়া ইন্সটিউট'।
তবে হত্যার পেছনে কারণ যাই হোক, তালেব জান সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, “আমার মেয়েদের মত আরও যেসকল নারী আমাদের সমাজকে সংস্কার করতে ঘর থেকে বেরিয়ে পরেছে, তাদের নিরাপত্তা দাও।” তার এই করুণ আর্তনাদ মানুষের হৃদয়ে প্রচণ্ড দাগ কেটেছে।
So sad to hear, Journalist& Advisor to the Parliament #MinaMangal assassinated today in Kabul by unknown person. She was a strong self made woman; RIP #Mina. She isn’t the 1st and wouldn’t be the last lost(unfortunately). Serious protection 4 female journalists! Is what we need pic.twitter.com/6g205oQDA5
— Shagufa Noorzai (@Shagufa_Noorzai) May 11, 2019
এটা খুবই দুঃখজনক যে, আজ কাবুলে সাংবাদিক ও সংসদের উপদেষ্টা মিনা মঙ্গল অজ্ঞাতদের দ্বারা গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। সে একজন দৃঢ় আত্মপ্রণোদিত নারী। শান্তিতে থেকো মিনা ! তিনিই প্রথম নন এবং দুর্ভাগ্যবশত শেষজনও নন। আমাদের এই মুহূর্তে দরকার নারী সাংবাদিকদের জন্যে সত্যিকারের নিরাপত্তা।
টেলিভিশনের পরিচিত মুখ
২০১৭ সালে আফগানিস্তানের নিন্মকক্ষ ওলেসি জিরগা বা গণপরিষদের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের পূর্বেও মিনা মঙ্গল বিশিষ্ট গণমাধ্যম বাক্তিত্ত হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
১৯৮৯ সালে পাকতিয়া প্রদেশে তার জন্ম। প্রায় দশ বছর যাবত গণমাধ্যমে কাজ করার পূর্বে তিনি ধাত্রীবিদ্যা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
সম্প্রতি তিনি আইন ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
#MinaMangal was a known #journalist in the country which shot death by unknown gunman today. I hope she Rest In Peace, I am really sorry for her?, no one is able to quite us, we are committed to our work more than past.@UNDPaf @UNDPasiapac @NPeaceNetwork #Afghanistan https://t.co/SXTAlrYe90
— Samim Azad (@AzadSamim) May 11, 2019
দেশব্যাপী পরিচিত সাংবাদিক মিনা মঙ্গল অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে আজ মারা গিয়েছেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। সমবেদনা রইলো তার জন্য? চলার পথে কেউই কারো চিরসাথী হতে পারে না। দায়িত্বের প্রতি অতীতের চেয়ে এখন আমরা আরো বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
Completely shocked by the assassination of former TV journalist #MeenaMangal perpetrators must be taken to court. pic.twitter.com/O09WoMPllL
— Shawali kayhan? (@KayhanShawali) May 11, 2019
সাবেক সাংবাদিক মিনা মঙ্গলের হত্যাকাণ্ডে আমি সম্পূর্ণ স্তম্ভিত! অপরাধীদের অবশ্যই আদালতের মুখোমুখি করতে হবে।
গত ২ মে ফেইসবুকে এক পোস্টে মিনা মঙ্গল জানান, সম্প্রতি তিনি বেশ কিছু হুমকি পেয়েছেন। তবে কে বা কারা হুমকি দিচ্ছিলো, সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেন নি।
এক নির্বোধ বলছে, আমার জীবন নাকি হুমকির সম্মুখীন! আমি তাকে বলেছি, আমার দেশকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, আমরা স্রষ্টার কাছ থেকে এসেছি এবং তার কাছেই ফিরে যাবো। স্রষ্টার মহিমায় আমার এবং আমার মহান জাতির ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। বরং যারা নারীদের হুমকি দেয়, তারাই মরবে। নির্বোধগুলাই জানে, তারা কারা! আবারো যদি তারা হুমকি দেয়, আপনাদের কাছে তাদের পরিচয় করিয়ে দিবো।
মঙ্গলের পরিবারের জানিয়েছে, দু'বছর আগে সে বিয়ে করেছিল। কিন্তু স্বামীর দ্বারা শারিরিক নির্যাতনের কারনে অবিলম্বে সে বিবাহ-বিচ্ছেদ করে। পারিবারিক সূত্রে আরও জানা যায়, স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্নভাবে প্রায়ই মিনাকে হুমকি দিতো। মৃত্যুর মাস পর্যন্ত মিনাকে এরকম পরিস্থিতি সহ্য করতে হয়েছে।
সাবেক স্বামীর দ্বারা মিনাকে একবার অপহরণ করার ঘটনাও ঘটেছিল বলে তার বাবা প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন।
আফগানিস্তানের খনি ও পেট্রোলিয়াম বিষয়ক মন্ত্রী নারগিস নাহান এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে হুমকিপ্রাপ্ত নারীদের রক্ষার্থে নীতিমালা প্রণয়নে তিনি কাজ করছেনঃ
قتل مینه منگل قتل آزادی بیان، برابری و صداهای مبازر میباشد. من این عمل وحشیانه را محکوم میکنم. امروز با @ShaharzadAkbar و @hasina_safi صحبت نمودیم تا عاجل یک جلسه در شورای امنیت ملی داشته باشیم جهت تعقیب این قضیه و ایجاد یک میکانیزم برای امنیت زنان که با تهدیدات مواجه اند. pic.twitter.com/bG2NIgVhCY
— Nargis Nehan (@NehanNargis) May 11, 2019
সংস্কৃতি ও তথ্য বিষয়ক মন্ত্রী হাসিনা সাফি, নিরাপত্তা পরিষদের উপ-প্রধান শাহজাদ আকবর এবং আমি হুমকির সম্মুখীন নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।
নিরাপত্তা কেবল কাগজে-কলমে, দীর্ঘদিনের নিরাপত্তাহীনতাই বাস্তবতা
সম্প্রতি এই নারী সাংবাদিকের করুণ মৃত্যুতে নারী এবং সাংবাদিক উভয় গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিয়েই প্রচণ্ড আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে
নারীদের প্রতি লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক সহিংসতা, বিভিন্ন ঘরোয়া নির্যাতন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক যৌন সহিংসতা এবং উগ্রবাদের প্রচারণার ঘটনাগুলো জাতীয় পর্যায়ে দৃষ্টিগোচর করার ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের বেসরকারি গণমাধ্যমগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
#Farkhunda was burned to death, #BabyMahsa was kidnapped, raped & killed, #BibiAyesha nose was cut, Women got stoned and today #MinaMangal shoot 9 times. All these crimes took place mainly during the day & mainly in the green zone capital city of #Kabul. #StopKillingWomen pic.twitter.com/X1MUf64fNP
— Diva Patang (@DivaPatang) May 11, 2019
ফারখুন্দকে পুড়িয়ে মারা হলো, অপহৃত শিশু মাহশাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হলো, বিবি আয়েশার নাক কাঁটা হলো, নারীদের পাথর ছোঁড়া হলো। অতঃপর আজ ৯টা গুলি করে মিনা মঙ্গলকে হত্যা করা হলো। এই সবগুলো অপরাধই দিনে সংগঠিত হয়েছে এবং প্রধানত রাজধানী কাবুলের আশেপাশে। #নারী_ হত্যা_থামাও
২০১৯ এর মে মাসে শীর্ষস্থানীয় সংবাদ সংস্থা “টলো নিউজ” পারিসা নামের গর্ভবতী এক নারীকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, স্বামী এবং তার স্বজনরা পারিসাকে বিল্ডিঙের ষষ্ঠতলার একটি জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পারিসাকে ক্রীতদাসের মত রাখা হতো এবং তার পরিবারের সাথে দেখা করতে দেয়া হত না।
গণমাধ্যমের সাথে সমাজের সম্পৃক্ততা যত বাড়ছে, সমাজে এধরনের ঘটনাগুলোর সন্ধান তত বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে অনলাইন এবং টেলিভিশনের মত গণমাধ্যমগুলোর প্রভাব তর্কাতীতভাবে প্রতীয়মান হওয়া সত্ত্বেও আফগানিস্তানের সাংবাদিকদরা ক্রমাগত নিরাপত্তাজনিত নানান দুঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।
বছরের শুরুর দিকে তাখার প্রদেশের একটি রেডিও স্টেশনে অজ্ঞাত দুই বন্দুকধারী প্রবেশ করে দুই সাংবাদিকের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক শফিক আ'য়া (২৮) এবং অনুষ্ঠান উপস্থাপক রহিমুল্লাহ রহমানি (২৬) তৎক্ষণাৎ মারা যান। এর জের ধরে পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু গ্রেফতারকৃতদের কেউই এই হামলা সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলে নি।
এপ্রিলে “রিপোর্টার্স ইউদাউট বর্ডার্স” কর্তৃক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তালেবানদের পতনের পর ২০১৮ সালই ছিল দেশটির সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ বছর। এসময় বোমা হামলা ও হত্যার শিকার হয়ে ১৫ জন সাংবাদিক প্রান হারিয়েছেন।