যুদ্ধের কারণে ইয়েমেনে যে তীব্র সম্পদের সঙ্কট দেখা দিয়েছে তার ফলে অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের স্কুল থেকে বের করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি ১৩ বছর বয়সের মেয়েদেরও প্রায়ই বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। তবে রাজধানী সানার একটি স্কুল এই সমস্যার একটি খুবই কার্যকরী সমাধান বের করেছে।
সলিডারিওস সিন ফ্রোন্টেরাস (স্পেন ও ইয়েমেনে অবস্থিত) একটি এনজিও। এটি প্রায় সম্পুর্ণ স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা পরিচালিত এবং অর্থায়নের প্রধান উৎস হল ব্যক্তিগত অনুদান, এখানে অনেকে মাসে মাত্র এক ইউরোও দান করে। প্রতিষ্ঠানটি এই স্কুলের ছয় থেকে ষোল বছরের মেয়েদের জন্য বিনামুল্যে সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করেছে। এই প্রকল্প শুরু হওয়ার আগে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মেয়েই অনুপস্থিত থাকত। সলিডারিওসের প্রতিষ্ঠাতারা বলেন, তবে প্রকল্প শুরু হলে ধীরে ধীরে তারা আসতে শুরু করে এবং ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৫২৫ জনই নিয়মিত স্কুলে আসছে।
এনজিওটির দুজন প্রতিষ্টাতার সাথে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আমার কথা হয়, একজন ইভা যার সাথে আমার কয়েক বছর আগে বারসোলনায় দেখা হয়েছিল আর অন্যজন ফাতেন, যিনি ইয়েমেনে থাকেন। তারা আমাকে তাদের প্রকল্প “ব্রেকফাস্ট টু এডুকেট এন্ড প্রোটেক্ট” সম্পর্কে বলেন। নিরাপত্তার জনিত কারণে আমি যেন তাদের পুর্ণ নাম এবং স্কুলের নাম প্রকাশ না করি সেটাও তারা আমাকে অবহিত করেন।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে সেই স্কুলের একজন শিক্ষক ফাতেনের কাছে আসে এবং আট বছরের একটি মেয়ের কথা বলে যে দিনে দিনে শীর্ণ আর অবসন্ন হয়ে আসছিল। এরপর হঠাৎ করেই সে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয়। যদিও সেই প্রথম স্কুল ছেড়েছে তা নয়, তবে সে ছিল সবচেয়ে কম বয়সী। তার পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায় যে তারা প্রচন্ড অর্থাভাবে আছে এবং তাদের মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছে।
ফাতেনের সাথে কথা বলার সময় সেই শিক্ষক জানায় যে যদি এক বেলা বিনামুল্যে খাবারের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে হয়ত তারা মেয়েদের স্কুল বন্ধ করবে না। আর তখনই এই ধারণার জন্ম হয়। ফাতেন বলেনঃ
এই মেয়েগুলো বেশীরভাগই টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে কাজ করা শ্রমিকের মেয়ে। যে ফ্যাক্টরি এখন ধ্বংসস্তূপ [বোমার আঘাতে]। তিন বছর ধরে এই পরিবারগুলো কোন বেতন পায়না। কিভাবে তারা তাদের খাদ্যের চাহিদা মেটাবে?[…] সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হলো আমরা তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাবার জন্য সাহায্য করার চেষ্টা করছি। আর পরিবারগুলোও খুশি, কারণ তাদের মেয়েকে আর বাসায় বসে থাকতে হচ্ছেনা বা অল্প বয়সে বিয়ে করতেও বাধ্য হচ্ছেনা।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে ইউনাইটেড নেশনস ঘোষণা দেয় যে মানবিক সঙ্কটের মধ্যে ইয়েমেনের অবস্থা পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুতর। বেকারত্ব আর মুদ্রাস্ফীতির চরম দশা, ৮০ ভাগ পরিবার ঋণে জর্জরিত আর ৬৫ ভাগ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে।
সলিডারিওস সিন ফ্রোন্টেরাস একজন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শে সকালের নাস্তার পদগুলো বাছাই করে। ফাতেন প্রতি সকালে সব কেনাকাটা করে এবং এক দম্পতির বাসায় এগুলো প্রস্তুত করা হয়, এরপর সেখান থেকেই সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয় স্কুলে। ৪৫ মিনিটের কর্ম বিরতিতে সে ছুটে যায় স্কুলে এবং সেখানকার শিক্ষকদের সহযোগিতায় তা বিতরণ করে। মাঝে মাঝে তার ভাই বোনও তাকে সাহায্য করে।
প্রতিষ্ঠানটির আরো তিনটি প্রকল্পে এই একই স্ব-উদ্যোগ দেখা যায়। এর মধ্যে একটি হল “ফুড এইড ফর ফ্যামিলিস”, যার মাধ্যমে সানা, এইডেন, আমরান, রেইদাহ, হবেদেইদাহ, আল দরিহিমি এবং তাইজ এর দুঃস্থ পরিবারগুলোয় খাবার সরবরাহ করা হয়। “ওয়াটার ফর ইয়েমেন” প্রকল্পে আম্রান ও রেইদাহের ক্যাম্প গুলোতে পানির মজুদের ব্যবস্থা এবং “রিবিল্ডিং সকোট্রা” প্রকল্পে ২০১৫ সালের ঘুর্ণিঝড়ে সকোট্রায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারে বাড়ি ও কুপ খননের জন্য সিমেন্ট প্রদান করা হয়।
“কিভাবে আমরা নিজেই উদ্যেগ নিতে পারি”
২০১২ সালে ইয়েমেনে ভ্রমণের সময় ইভা আর ফাতেনের পরিচয় হয়। সানার একটি ক্যাফেতে ইভা পাশের টেবিলে একটি মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান দেখছিল, মেয়েটি এসে ইভাকে কেক খেতে আমন্ত্রণ জানায়। সেই মেয়েটি ছিল ফাতেন। তাদের বন্ধুত্ব হয় এবং এরপর তাদের বেশ কয়েকবার দেখা হয়। সম্প্রতি ২০১৫ সালে তাদের যোগাযোগ হলে ফাতেন জানায়ঃ
যুদ্ধ শুরু হবার কয়েক সপ্তাহ পরে, আমি হোয়াটস অ্যাপে ইভাকে জিজ্ঞেস করি, ” আমরা কি কোন ভাবে সাহায্য করতে পারি?”। ইভা বলে সে তার এক বন্ধু নোয়েলিয়াকে নিয়ে স্পেনে কোন প্রতিষ্ঠান খুজে বের করার চেষ্টা করবে আর আমার কাজ হলো ইয়েমেনে খুজে দেখা।
আন্তর্জাতিক উন্নয়নে ১৫ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকার পরও ইভা ইয়েমেনে কাজ করছে এবং বিশ্বাসযোগ্য কোন গ্রাসরুটের এনজিও খুজে পায়নি। তখন সে ফাতেন আর নোয়েলিয়াকে নিয়ে নিজেরাই একটি এনজিও খোলার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই তিন নারী সেচ্ছাসেবী কার্যনির্বাহী হিসেবে কাজ করেন এবং দুই দেশের আরো অনেক বিশ্বস্ত সেচ্ছাসেবী তাদের সাহায্য করে থাকেন। ইভা ও নোয়েলিয়া স্পেন থেকে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করে, এর জন্যে তারা মুলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন বক্তৃতার মাধ্যমে অনুদানকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। বেশিরভাগ অনুদান অনলাইনের মাধ্যমে আসে আর এসএসএফ সেগুলো তাদের বিভিন্ন প্রকল্পে আলাদা ভাবে অর্থায়ন করে। ফাতেন তার বাসা থেকে মুল কর্মকান্ড পরিচালনা করে। এভাবেই তারা তিন জন নিজেদের কাজের পাশাপাশি এনজিওর কার্যনির্বাহ করে যাচ্ছে।
তারা নিয়মিত তাদের ছবি, ভিডিও এবং সম্পুর্ণ অগ্রগতি এসএসএফ এর সামাজিক যোগাযোগ পাতায় প্রকাশ করে। এছাড়া তারা ইয়েমেনে যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে স্পেন এবং অন্যান্য দেশ যেভাবে এই যুদ্ধের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করছে।