অভিবাসনকে যুক্তরাজ্যের সমস্যা বিবেচনার সাথে আফ্রিকা ও আফ্রিকীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার কর্মীরা একমত নয়

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের জন্যে রুয়ান্ডার রাষ্ট্রপতি পল কাগামের সাথে লন্ডনের ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে ৪ মে, ২০২৩ সাক্ষাৎ করেছেন। ছবি: ফ্লিকারে সাইমন ডসন/ ১০ নম্বর (সৃজনী সাধারণ ৪.০ অনুমতি)

যুক্তরাজ্য (ইউকে) ও রুয়ান্ডা ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ ব্রিটেন থেকে কিছু নির্দিষ্ট আশ্রয়প্রার্থীকে রুয়ান্ডায় স্থানান্তরের একটি বিতর্কিত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তিটি যুক্তরাজ্যে আসা কিছু আশ্রয়প্রার্থীকে প্রক্রিয়াকরণ ও সম্ভাব্য নিষ্পত্তির জন্যে রুয়ান্ডায় পাঠানো সম্পর্কিত।

এই চুক্তির পিছনে অনুপ্রেরণা হলো ছোট নৌকায় আসা অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা ২০২০ সালে প্রায় ৮,৫০০, ২০২১ সালে ২৮,০০০ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৪৫,০০০ হলে সরকার মনে করে এই নীতি বাস্তবায়িত হলে জনগণ ইংলিশ চ্যানেল পার হতে ছোট নৌকা ব্যবহারসহ “যুক্তরাজ্যে প্রবেশের অবৈধ, বিপজ্জনক বা অপ্রয়োজনীয় পদ্ধতি” ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবে।

তবে এই ব্যবস্থাটি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) মতো মানবাধিকার সংস্থার সমালোচনা ছাড়াও বিরোধীদলীয় ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের কাছে অকার্যকর ও অমানবিক বিবেচিত হয়েছে। নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত পরিকল্পনাটির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে:

যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় পাঠানোর ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে এটিকে বেআইনি বলেছে।

আদালত সর্বসম্মতভাবে রায় দিয়েছে রুয়ান্ডা আশ্রয়প্রার্থীদের পাঠানোর জন্যে নিরাপদ কোনো তৃতীয় দেশ নয়।

এখানে কিছু প্রসঙ্গ রয়েছে 🧵

সিজিটিএন আফ্রিকার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে রুয়ান্ডা সরকারের উপ-মুখপাত্র অ্যালাইন মুকুরারিন্দা অভিবাসী সংকট মোকাবেলার প্রতিশ্রুতি হিসেবে রুয়ান্ডার এই চুক্তির স্বীকৃতিকে স্পষ্ট করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন অভিবাসীদের স্বাগত জানানোর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রুয়ান্ডা ন্যূনতম জীবনমান প্রদানে সক্ষম একটি নিরাপদ দেশ।

তবে ২০২০ সালে সর্বজনীন পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনা (ইউপিআর) প্রক্রিয়ার কাছে ইউএনএইচসিআর রুয়ান্ডার আশ্রয় প্রক্রিয়া সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ইউএনএইচসিআর কিছু লোকের জন্যে আশ্রয়ের পদ্ধতিতে প্রবেশে ইচ্ছেমাফিক অস্বীকার, অনথিভুক্ত আশ্রয়প্রার্থীদের আটক ও নির্বাসনের ঝুঁকি, এলজিবিটিআইকিউ+ ব্যক্তিদের মুখোমুখি হওয়া আশ্রয়ের পদ্ধতিতে বৈষম্যমূলক প্রবেশাধিকার ও আইনি প্রতিনিধিত্বের অভাবের মতো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

মুকুরারিন্দা যুক্তরাজ্য সরকারের তহবিল দিয়ে আশ্রয়প্রার্থী স্থানান্তরের আশ্রয় কর্মসূচি অর্থায়নের সত্যটি তুলে ধরেছেন। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলি আইনি চ্যালেঞ্জের কারণে যুক্তরাজ্য থেকে রুয়ান্ডায় কোনো আশ্রয়প্রার্থী পাঠানো না হলেও যুক্তরাজ্য গত বছর প্রদত্ত ১৪ কোটি পাউন্ডের (প্রায় ,৯৪৪ ১কোটি টাকা) পরে এই বছর আরো ১০ কোটি পাউন্ড (প্রায় ১,৩৮৮ কোটি টাকা) প্রদান করেছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে।

এটি এধরনের চুক্তির প্রথম ঘটনা নয়। সিজিটিএন আফ্রিকার একটি ইউটিউব ভিডিওতে আন্তর্জাতিক শরণার্থী অধিকার উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক আচিং আকেনা আশ্রয় প্রক্রিয়ার বহিঃকরণের বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানদের উগান্ডায় পাঠানো এবং ডেনমার্কের রুয়ান্ডার সাথে অনুরূপ চুক্তির চেষ্টার মতো ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন। আচিংয়ের মতে, আফ্রিকীয় ইউনিয়ন এই প্রক্রিয়াটিকে প্রবাসীভীতি ও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য হিসেবে সমালোচনা করেছে। তিনি বলেন জনগণের সাথে পরামর্শ ছাড়া সরকারের মধ্যে করা এই গোপন চুক্তিটি আফ্রিকীয়দের জন-কেন্দ্রিক মহাদেশ অর্জনের নিখিল-আফ্রিকাবাদের আদর্শের সাথে বিরোধপূর্ণ।

একই ইউটিউব ভিডিওতে মানবাধিকার_পর্যবেক্ষকের মধ্য আফ্রিকার পরিচালক লুইস মুজ চুক্তিটির সাফল্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন:

এটা অস্ট্রেলিয়ায় কাজ করেনি। অস্ট্রেলিয়া এই ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে মানুষের মানবাধিকার সম্পূর্ণ পদদলনের প্রেক্ষিতে এর চরম পরিণতি হয়েছিল

আফ্রিকার বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি এই চুক্তিটিকে ভিন্ন ভিন্নভাবে নিয়েছে। কেউ কেউ এতে কোনো দোষ খুঁজে না পেলেও অনেকেই এর তীব্র বিরোধিতা করেছে।

ইউএনএইচসিআর-এর মতে, বিশ্বের ৮৫ শতাংশ শরণার্থী ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। রুয়ান্ডা একাই প্রায় ১,৩০,০০০ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, যার ৯১ শতাংশ শিবিরে বসবাস করে। সিজিটিএন আফ্রিকার ভিডিওতে মানবাধিকার আইনজীবী ও স্বাধীন রাজনৈতিক বিশ্লেষক গেতেতে নিরিঙ্গাবো রুহুমুলিজা রুয়ান্ডার শরণার্থী গ্রহণের ক্ষমতা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে উল্লেখ করেছেন:

অভিবাসীরা আমাদের জন্যে কোনো সমস্যা নয়। এটা আমাদের গ্রহণ ক্ষমতার বিষয় নয়; এটা তাদের শক্তি ও দক্ষতার সাথে তাল মেলানোর ব্যাপার। এই সহনশীল ব্যক্তিরা নদী, মরুভূমি ও যুদ্ধাঞ্চল অতিক্রম করেছে। আমরা তাদের থেকে উপকৃত হতে চেষ্টা করেছি। আসলে আমাদের কাছে নতুন মানুষ পাঠাতে আমাদেরকে যুক্তরাজ্যের অর্থ প্রদান করতে হয়।

আশ্রয়প্রার্থীদের সুবিধার বিষয়ে লুইস মনে করেন এই চুক্তিটি যুক্তরাজ্যে যেতে চাওয়া ব্যক্তিদের উপকার করবে না। তার যুক্তিতে যুক্তরাজ্যে পৌঁছানো ব্যক্তিদের সেখানে শরণার্থী ও আশ্রয় সংক্রান্ত মামলার শুনানি করার অধিকার রয়েছে এবং কারণগুলি বিশ্বাসযোগ্য হলে তাদের আশ্রয় দেওয়া উচিত।

লুইস ও আচিং দাবি করেছে যুক্তরাজ্য আশ্রয় প্রদানের দায়িত্ব এড়াতে এই পরিকল্পনাটি ব্যবহার করছে। তারা চুক্তিটিকে নেতিবাচক বিবেচনায় রুয়ান্ডার সমস্যাজনক মানবাধিকারের রেকর্ডের দিকে ইঙ্গিত করে নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে যুক্তরাজ্যের রুয়ান্ডাকে অনুমোদনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

আচিংয়ের যুক্তিতে চুক্তিটি সত্যিকারভাবে ইতিবাচক হলে জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া গোপনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো না। তিনি রুয়ান্ডায় স্থানান্তরিত ব্যক্তিদের অধিকারের বিষয়ে স্পষ্টতার অভাবের উপর জোর দিয়ে স্পষ্ট পদ্ধতি ও অধিকার সুরক্ষা প্রয়োগ করার বিষয়ে তথ্যের অনুপস্থিতির সমালোচনা করেন যা যুক্তরাজ্যে পাওয়া গেলেও গন্তব্য দেশে নাও থাকতে পারে। তিনি এটিকে অগ্রহণযোগ্য, অভিবাসীবিরোধী ও বর্ণবাদী মনে করেন।

যুক্তরাজ্য ও রুয়ান্ডা আফ্রিকীয়দের অভিবাসনকে সমস্যা বিবেচনা করলেও আচিং এবং আফ্রিকীয় ইউনিয়ন এতে একমত নয়। আচিং তুলে ধরেছেন ইউরোপে আন্তঃমহাদেশীয় ও এশীয় অভিবাসনের তুলনায় অভিবাসনকারী আফ্রিকীয়দের সংখ্যা অনেক কম। আচিংয়ের মতে, আফ্রিকীয় ইউনিয়নের আফ্রিকা জুড়ে আইনি অভিবাসন উন্নত করে চলাচলের স্বাধীনতা প্রোটোকল গ্রহণের একটি প্রক্রিয়া এখনো চলমান।

ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১০.৮ কোটিরও বেশি মানুষ নিপীড়ন, সংঘাত, সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা জনশৃঙ্খলাকে গুরুতরভাবে বিঘ্নিতের ঘটনার কারণে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এই বিতর্কিত নীতি শরণার্থীদের অধিকারকে ক্ষুন্ন না করে অভিবাসী সংকটকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করবে কিনা তা এখনো দেখার বিষয়।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .