সমষ্টিগত চেতনায় ক্যারিবীয়দের স্থান করে দিয়ে ‘সর্বকালের অন্যতম মহাকবি’ ডেরেক ওয়ালকটের মহাপ্রয়াণ

নিকারাগুয়ার গ্রানাডাতে অষ্টম কবিতা উৎসবে ডেরেক ওয়ালকট, ফেব্রুয়ারি ২০১২। ছবি: স্তানিস্লাভ ল্ভভস্কি, সিসি বাই-এনসি-এনডি ২.০

১৯৯২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অতিকায় ডেরেক ওয়ালকট আমাদের বিশ্ব সাহিত্য চেতনা গভীরে ক্যারিবীয় কবিতাকে রোপণ করে দিয়ে আজ (১৭ মার্চ) তার সেন্ট লুসিয়া বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেছেন। ওয়ালকটের বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।

ইংরেজিভাষী ক্যারিবীয়দের বৃহত্তম সাহিত্য উত্সব বোকাস সাহিত্য উৎসব তাদের এই প্রাতিষ্ঠানিক বিবৃতিটিতে ওয়ালকটের দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার ধরে রাখার চেষ্টা করেছে:

তিন প্রজন্মের ক্যারিবীয় লেখকদের মধ্যে ওয়ালকটের একটি অপ্রতিরোধ্য উপস্থিতি রয়েছে, আর তার প্রভাব বহুমাত্রিক। ভাষার ওস্তাদ তিনি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে ইংরেজি কোন একক জাতি বা সংস্কৃতির সম্পত্তি নয়। তার নিজের সেন্ট লুসিয়া এবং বৃহত্তর ক্যারিবীয় প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর প্রতি একটা প্রচণ্ড এবং ধর্মের মতো ভক্তি ছিল যাকে তিনি তার পংক্তিমালা আর রূপকের মাধ্যমে অমরত্ব প্রদান করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ইতিহাসের নামহীন স্থান, মানুষ, এবং সব কিছু্র নাম দেয়া কবিদের কাজ এবং তিনি অন্যান্য কবিদের একই কাজ করতে সাহস যুগিয়েছেন।

[ওয়ালকট] তার কবিতায় লিখে দেখিয়েছেন যে এমনকি বিশ্বের প্রত্যন্ত এলাকার একটি ক্ষুদ্র দ্বীপের সবচেয়ে অচ্ছুৎ গ্রামটিও মহাকাব্যিক সৌন্দর্য এবং তাত্পর্যমণ্ডিত একটি স্থান হতে পারে।

তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ মহাকাব্যিক কবিতা ‘ওমেরোস (হোমার নামে পরিচিত গ্রিক কবির প্রকৃত নাম)’ সেগুলোরই প্রতিমূর্তি এবং বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম মহান একটি কাজ। তিনি তরুণ লেখকদের সশস্ত্র করে গোঁড়ামি এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রকদের চ্যালেঞ্জ করেছেন।

সর্বোপরি, তিনি আমাদের একজনের জীবন্ত উদাহরণ যিনি ক্ষুদ্র ক্যাস্ট্রিতে জন্ম নিয়ে, কিংস্টোনে পড়ালেখা করে, আর পোর্ট অফ স্পেন বসবাস ও কাজ করে দৈনন্দিন জীবনের পরিস্থিতিতে থেকে লিখে সর্বকালের সেরা কবিদের একজন হতে পেরেছেন।

নোবেল পুরস্কার ছাড়াও ওয়ালকট ১৯৮১ সালে ম্যাকআর্থার ফাউণ্ডেশনের ‘প্রতিভা’ পুরস্কার; ১৯৮৮ সালের কবিতার জন্যে রাণীর স্বর্ণপদক; ২০০৪ সালে এ্যানিসফিল্ড-উলফ গ্রন্থ পুরস্কারের আজীবন অবদান পুরস্কার; ২০১১ সালের টি.এস. এলিয়ট পুরস্কার; মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ আরো অন্যান্য বিশেষ সম্মান প্রাপ্তদের মাঝে লাতিন হিসেবে ক্যারিবীয় সাহিত্যের ওসিএম বোকাস  পুরস্কার লাভ করেছেন।

১৯ বছর বয়সে তিনি মায়ের কাছ থেকে ছাপার আর্থিক সহায়তা নিয়ে নিজেই নিজের প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন। তার একেবারে সাম্প্রতিক কাজ ‘প্যারামিনের সকাল’ (ফারার, স্ট্রস এ্যান্ড জেরি, ২০১৬) ছিল স্কটিশ চিত্রশিল্পী পিটার ডইগ-এর সঙ্গে যৌথভাবে তৈলচিত্র এবং কবিতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে। এটা ওয়ালকটের ক্যারিবীয় দৃশ্যপটের পুনরুদ্ধার, নতুন করে দেখা এবং বিস্ময়ের শাশ্বত উদ্বেগ তুলে ধরার কাজ হিসেবে নিউ ইয়র্ক গ্রন্থ সমালোচনার জুলিয়ান লুকাসের সমালোচক প্রশংসা লাভ করেছে:

কবিতাগুলো গোধূলির আবছায়ায় মিশে গেলেও এগুলোতে উচ্চকিত উদযাপন, একজন চিত্রকরের সতেজ চোখের আনন্দ, যাকে ওয়ালকট অনেকটা শেক্সপীয়র যেমন করে তার সনেটের যুবকটিকে আহবান করেছেন – বিশ্বে সৌন্দর্য সংরক্ষণ, উৎপাদন ও প্রজনন এবং এমনকি উত্তরাধিকারী হওয়ার অনুরোধ করে।

অঞ্চলটির বিদ্বান, শিক্ষার্থী, পাঠক, নাটকপ্রেমী, কবি ও শিক্ষাবিদরা শোকে নিমগ্ন। ব্যক্তি, সংগঠন, আন্দোলন ও পাঠক্রমের উপর ওয়ালকটের কাজগুলোর প্রভাবকে গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক গণমাধ্যম এবং প্রচলিত সংবাদ মাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলির একটা প্রাচুর্য প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

একটি আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধাঞ্জলিতে কবিতা সমিতি কারেন ম্যাকার্থি উলফের ‘প্যারামিনের সকাল’ পর্যালোচনা থেকে উদ্ধৃত করেছে। এতে ওয়ালকটের উত্তরাধিকার “ভাষা এবং এর আলোচনাটিকে সমৃদ্ধ করেছে বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে পাঠকেরা হয়তো একটি সংকরায়িত পরিবেশ হিসেবে অঞ্চলটির ইতিহাস এবং ঋজুতা সম্পর্কে জানতে পারবে।”

ওয়ালকটের ভাষার উপর সামষ্টিক দখল; ক্যারিবীয় কাব্যবিদ্যায় তার বিনিয়োগের একাগ্রতা; কোন দৃশ্যপট এবং এর মধ্যেকার জনগণ বর্ণনার ক্ষেত্রে তার নিষ্ঠার শ্বাসরুদ্ধকর পরিসীমাকে গুরুত্ব আরোপ করে অঞ্চলটির বাইরের আন্তর্জাতিক লেখক ও পাঠক গোষ্ঠীগুলোর প্রশস্তিও ঢেলে পড়ছে।

গার্ডিয়ান পত্রিকার আনুষ্ঠানিক শোকবাণী ওয়ালকটের নিজের ভাষায় শেকড়প্রবণতাকে কাজে পরিণত করার ক্ষেত্রে কবির নিজের বিশেষ অনুশোচনাহীন পক্ষপাতিত্বের প্রতি তার শৈল্পিক ও ব্যক্তিগত আত্মোপলব্ধি সম্পর্কে উদ্ধৃত করেছে:

কৃষ্ণাঙ্গ থিয়েটার এবং সাদা থিয়েটারের বিভাজন এখনও চলছে, আর আমি ঐ সংজ্ঞাগুলোর কোন একটিরও অংশ হতে চাই না। আমি (শুধুই) একজন ক্যারিবীয় লেখক।

তাই বলে ওয়ালকটের কর্মজীবন অবিতর্কিত ছিল না। ২০০৯ সালে দুই দশকের বেশি সময় আগের বিভিন্ন যৌন হয়রানির অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরে আনা হলে মর্যাদাপূর্ণ কবিতার অক্সফোর্ড অধ্যাপক পদের জন্যে তার প্রার্থীতার একটি আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটে। শেষ পর্যন্ত সেই পদটি দখল করা নারীর গোপণ সংবাদদাতা পরিচয় জানাজানি হলে মেয়াদের কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি পদত্যাগ করেন।

স্যার ডেরেক ওয়ালকটের জীবন, কর্ম এবং উত্তরাধিকারের প্রতি বিশ্ব বার্তা বোর্ডে, অনলাইন ফোরামে আর প্রকাশ্য জগতে শ্রদ্ধাঞ্জলির বন্যা অব্যহত রয়েছে। শোকার্তরা তাদের তাক থেকে তার বই নামিয়ে নিয়ে তাদের সবচেয়ে প্রিয় কবিতাগুলো খুলে মহিমান্বিত পংক্তিমালায় ওয়ালকটের গৌরবান্বিত উপস্থিতি উদযাপন করছে, মৃত্যু যার জৌলুস এতটুকু কমাতে পারেনি।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .