ক্যামেরায় ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর ঐতিহ্যবাহী কার্নিভালের মনোমুগ্ধকর ঝলক

ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর কার্নিভালের জাদু: ঐতিহ্যবাহী মুখোশধারী ট্রেসি শংকর-শার্লু এবং তার ছেলে জ্যুদ ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ অ্যাডাম স্মিথ স্কোয়ারে তাদের প্রদর্শর্নীর জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত

ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর চমৎকার শুক্রবার – কার্নিভালের সপ্তাহান্তে উপস্থাপিত মহিমান্বিত দিন – এবং উত্তেজনা অনুভব করা যাচ্ছে। ভারী বাদ্যযন্ত্র আর তারকায় ঠাসা সোকা এবং ডান্সহল (এক ধরনের রেগে সঙ্গীত) সেটে দর্শকে ভরপুর জাতীয় স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে দেয়া বার্ষিক কার্নিভাল ক্যালেন্ডারের হয়তো সবচেয়ে বড় কনসার্ট – মিশেল মানডে – দিয়ে সপ্তাহ শুরু করা উৎসবপ্রেমীরা নিশ্চয়ই বিরামহীন কার্নিভালের মুডে রয়েছে। (এছাড়াও সমাবেশটি আপাতদৃষ্টিতে উদ্দাম সরাসরি প্রবাহের মাধ্যমে ইন্টারনেটের অনেকটাই নাড়িয়ে দিয়েছে।)

কার্নিভাল ২০১৭-এর গান সমৃদ্ধ এবং সর্বাঙ্গীন – এবং এর সম্মোহনী তালে আসরপ্রেমীদের নাচ, ঘুরপাক আর “লাফিয়ে উঠা” অনেকটাই মনোযোগ কেঁড়ে নিয়েছে। সোকা যদি ত্রিনিদাদ ও টোবাগো কার্নিভালের হৃদস্পন্দন হয় তবে তার স্বয়ং হৃদয় হলো “মাস” (“মাস্কেরাদে” বা ছদ্মবেশের ছোট রূপ) – যেমন শুদ্ধ তেমন দুষ্ট আর শক্তিতে পরিপূর্ণ।

কার্নিভালের আলোকচিত্রী মারিয়া নুনেস  এখন থেকে কয়েক বছর ধরে। ঐতিহ্যবাহী মাস চরিত্রগুলোর প্রতি তার বিশেষ ভালবাসা রয়েছে এবং তিনি কার্নিভালের ইতিহাসের এই দিকটি সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টায় একটি সশ্রদ্ধ ও আবেগপূর্ণ পদ্ধতিতে সেগুলো ক্যামেরাবন্দী করে রাখেন। তার ফেসবুক পাতায় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন:

কার্নিভাল ছাড়া আমি সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যেতাম। কার্নিভালেই আমি আমার শক্তি, আমার উদ্দীপনা, বাকিটা বছর আমার এটা করে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। এই কয়েকটাদিন আমার আত্মা গান গায় আর নাচে। আমি [ঐ] মানুষদের জন্যে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ […] যারা বিস্ময়কর সৃষ্টিগুলোর স্বপ্ন দেখায় এবং তাদেরকে এতো সুন্দর করে জীবন্ত করে তোলে। অন্ধকার  দুর করার জন্যে শুধু সামান্য আলো দরকার।

নুনেসের দক্ষ চোখ এই বছরের চিত্রায়ণে ঘনিষ্ট একটা ভাব এনে দিয়েছে। সেখানে হাজির থাকার মতো মনে হচ্ছে… অনেকটাই!

লাঠিযুদ্ধ

২০১৭ সালের লাঠিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্বের একজন অংশগ্রহণকারী, মোরুগা, দক্ষিণ ত্রিনিদাদ। মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

লাঠিযুদ্ধ (দাসপ্রথার আমল থেকে চলা) একটি শতবর্ষ পুরানো ঐতিহ্য যেখানে পুরুষেরা “গাইয়েল” [বেষ্টনী]-এর মধ্যে “বোয়া” [কাঠ বা লাঠি] নিয়ে আফ্রিকীয় দামামার তালে (সাধারণত: পাতোয়া অর্থাৎ গ্রাম্য বা আঞ্চলিক ভাষায়) সুর তুলে অথবা গান গাইতে গাইতে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করে।

মোরুগাতে চলা ২০১৭ সালের প্রাথমিক পর্বের লাঠিযুদ্ধ: বোয়া একাডেমির জাঙ্গি (বামে) রিও ক্লারোর চুফি’র সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

মোরুগার সেন্ট মেরি জংশনে ২০১৭ সালের প্রাথমিক পর্বে মোলোম্বো দামামা বাদকেরা। মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

জনতার বিশাল ভীড় জমে যায় কোন একজন প্রতিপক্ষের মারাত্মক আঘাত বা এমনকি মৃত্যু ঘটে যাওয়া প্রচণ্ড মারামারি দেখার জন্যে। বিজয়ী তার জয়ের সঙ্গে আসা মর্যাদা ভোগ করে যা অনেক সামাজিক মুদ্রা বয়ে আনে।

ত্রিনিদাদের মোরুগাতে ২০১৭ সালের প্রাথমিক পর্বে (ক্যামেরাতে) ধরা পড়া একজন দর্শক। মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

১৮৮০ সালে ক্যানবুলে দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ এর চর্চা নিষিদ্ধ করে দেয়ার পর এটা ১৯৩৭ সালে (কঠোর নিয়মসহ) আবার চালু করা হয়। প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে বিদ্রোহী চেতনাটিকে উদযাপন  করে প্রতি বছর ক্যানবুলে দাঙ্গাটির পুণরাভিনয় এবং স্মরণ করা হয় যা উৎসবটির ভিত্তিটি তৈরি করেছে।

মোরুগাতে ২০১৭ সালের প্রাথমিক পর্বে রিও ক্লারো গাইয়েলের চুফি। চুফি ছিলেন এই সঙ্গীতের রাজা। মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

ঐতিহ্যবাহী ‘মাস’ (ছদ্মবেশ)

মোকো জাম্বি ঐতিহ্যবাহী মাস রূপায়ণ “টাচ ডি স্কাই” ব্যান্ডের অ্যালান ভন পরিকল্পিত “একটি ধারালো চাকুর প্রান্তে ঝড়”  এর একটি চরিত্র। মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

ত্রিনিদাদ ও টোবাগো কার্নিভালের ঐতিহ্যগত মাস গঠনকারী চরিত্রগুলো বিস্তৃত এবং বৈচিত্রময় – বুরোকিত (গাধার পিঠে চড়া মানুষের পোশাক), খেয়ালি নাবিক ও ইন্ডিয়ান, সুশ্রী (এবং ভীতিকর) শয়তান এবং এরকম আরো অনেক। নুনেসে এই বছরের সবচেয়ে সেরা কয়েকটিকে ধরতে পেরেছেন। এগুলোর মধ্যে কোন একটি ভয়ংকর লোককাহিনীর একটি মা ও ছেলের চরিত্র: একটি লাগাহু (নেকড়ে-মানবের মতো একটি পৌরাণিক চরিত্র যার রূপ পরিবর্তনের ক্ষমতা রয়েছে) এবং একটি ডৌয়েন (খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত না হওয়া শিশুর – যার পা পিছন দিকে ঘুরানো – হারিয়ে যাওয়া আত্মা বলে বিশ্বাস করা হয়)।

ট্রেসি শংকর-শার্লু এবং তার ছেলে জ্যুদের “লাগাহু” এবং “ডৌয়েন” চরিত্রে অভিনয়। নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

“লাগাহু” চরিত্রে ট্রেসি শংকর-শার্লু;  মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

বাদুরের পোশাকও জনপ্রিয় যেটা সাধারণত: শরীরের একটি জামা, একটি সুসজ্জিত শিরস্ত্রাণ এবং দর্শনীয় ডানা নিয়ে তৈরি। শিরস্ত্রাণ টি প্রায়শঃই পাপিয়ের মাচে বা মন্ডের এবং ডানা দু’টি কার্নিভালের বাঁকানো তারের শিল্প ব্যবহার করে তৈরি। কিন্তু কোনো বাদুরের মাসের বা ছদ্মবেশের সেরা অংশটি হলো এর সঙ্গে যাওয়া নাচটি: মন্ত্রমুগ্ধ করা দেহ সঞ্চালনার মাধ্যমে ছদ্মবেশী বাদুড়ের উড়ে যাওয়াকে অনুকরণ করে ঘোরে, সামনে ঝাঁপায় আর তার ডানা ঝাপটায়।

রোজমেরি পলের বাদুর চরিত্র রূপায়ণ, “তারা আমার কার্নিভাল দিয়ে কী করে?” মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

পশ্চিম আফ্রিকীয় উৎসের ঐতিহ্য – ঐসব গগনস্পর্শী অন্যজগতের রণপা নর্তকী মোকো জাম্বিরা ত্রিনিদাদ ও টোবাগো কার্নিভালে ঐন্দ্রজালিক পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করে। মৌখিক ঐতিহ্য মনে করে রণপার উচ্চতা জাম্বিদেরকে ক্ষুদ্রতর (বা অন্তত: অপেক্ষাকৃত খাটো) মরণশীলদের চেয়ে আরও দ্রুত মন্দ উপলব্ধি করার ক্ষমতা দেয়। আর তাই চরিত্রটিকে সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। রণপা দিয়ে যারা হাঁটেন তাদের ছদ্মবেশে রণপায়ের উচ্চতা ১০ থেকে ১৫ ফুট হয়ে থাকে; দৈত্যদের মতো দেখানোর জন্যে এই পাগুলো নিচ পর্যন্ত ঝুলানো প্যান্ট বা ঘাগড়া দিয়ে ঢাকা থাকে – এটি দেখার মতো একটি অবিশ্বাস্য প্রদর্শনী।

“টাচ ডি স্কাই” মোকো জাম্বিদের তাদের “একটি ধারালো চাকুর প্রান্তে ঝড়” উপস্থাপনা। পরিকল্পনা করেছেন অ্যালান ভন; ব্যান্ড নেতা আদ্রিয়ান ইয়াং; মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

নারী রণপা নর্তকী তার মোকো জাম্বি পোশাকে; মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

টাচ ডি স্কাই-এর ২০১৭ সালের মোকো জাম্বি উপস্থাপনা “একটি ধারালো চাকুর প্রান্তে ঝড়”; মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

একটি শয়তানের চরিত্রের রূপায়ণ ছাড়া কোন ঐতিহ্যগত মাস পরিপূর্ণ হবে না। “সুশ্রী শয়তান”-এর পোশাকটি একটি মধ্যযুগীয় বিদূষকের পোশাক থেকে অনুপ্রাণিত, একটু বিভিন্ন উপায়ে বিবর্তিত। তারপরও এতে সাধারণত রঙিন কাপড়ের প্যানেল, ঝুনঝুনি, বাঁশি – ​​এবং অবশ্যই শিঙ্গা যেটা তারের ভিত্তির ওপর কাপড়ের ছদ্মাবরণে তৈরি করা। জাব মোলাসির শংকর শয়তান মাসটি তারনির্মিত একটি লেজ, (একজোড়া) শিং এবং একটি ত্রিশূল পরে থাকে; মাস্কেরেদার বা ছদ্মবেশী নিজেকে শিকল, তালা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক দিয়ে সাজিয়ে তার সারা শরীরে রঙ, তৈলাক্ত ময়লা অথবা কাদা মাখিয়ে রাখে। জাবটি প্রায়ই তার ক্ষুদে শয়তানদের টিনের পাত্রের উপর তোলা একঘেয়ে ছন্দের তালে (ঘুরতে থাকার মতো) “মাতলামো” করে আর অন্য ক্ষুদেগুলো বন্যভাবে নাচার চেষ্টা করা মূল শয়তানকে সামালানোর মতো করে তার শিকল ধরে থাকে।

রিকার্ডো ফেলিসিয়েনের ২০১৭ সালের “জাব মোলাসি” চরিত্র রূপায়ন; মারিয়া নুনেসের তোলা ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

হ্যাঁ, ২০১৭ সালের ত্রিনিদাদ ও টোবাগো কার্নিভালের দরজা এই চমৎকার শুক্রবারে খুলতে যাচ্ছে – অথবা মারিয়া নুনেস যেমন বলেছেন, “কার্নিভাল আমাদের সামনে রয়েছে। অন্ধকারে যারা তাদের আলো জ্বালিয়েছেন তাদেরকে ধন্যবাদ।”

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .