পেটানোর সময় তিনি চিৎকার করছিলেন। অন্য বন্দীরা তার চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল। ময়না তদন্তে দেখা যায় তার মুখ ছিল বিকৃত, মাথার খুলি ফাটা, পাজর ছিল ভাঙ্গা এবং তার যকৃৎ ফেটে গিয়েছিল। তিনি ৩৬ বছর বয়স্ক হাসান আলশেখ এর সহগামী হলেন। হাসান আলশেখ বাহরাইনের কারাগারে নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন, তিনি সাজার অর্ধেকেরও বেশি খেটেছিলেন।
৬ নভেম্বর, ২০১৪ তারিখে বাহরাইনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একজন কারাবন্দীর মৃত্যু নিয়ে টুইট করেনঃ
An inmate, 36, at the Directorate of Reformation and Rehabilitation who is convicted in a drug case died. Concerned bodies notified
— Ministry of Interior (@moi_bahrain) November 6, 2014
রিফর্মেশন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডিরেক্টরেটের ৩৬ বছর বয়স্ক একজন কারাবন্দী মৃত্যুবরণ করেছে। তার দেহ শনাক্ত করা হয়েছে, তিনি মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন।
স্পস্টিকরণের জন্য বলা হয়েছে যে তার এই মৃত্যু কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়
Criminal suspicions over the death of inmate http://t.co/cXaSB9YR4H
— Ministry of Interior (@moi_bahrain) November 6, 2014
কারাবন্দী অপরাধীর মৃত্যু নিয়ে সংশয়
২০১১ সাল থেকে নির্যাতনের কারনে যে সকল কারাবন্দীর মৃত্যু ঘটেছে হাসান আলশেখ হল তাঁদের মধ্যে পঞ্চম। দুঃখজনকভাবে আমার দেশে যেটা নিতান্তই সাধারণ সে বিষয় নিয়ে আমি তার সাথে শেয়ার করেছি- আমরা দুজনেই ছিলাম নির্যাতনের শিকার।
৩০ জুলাই ২০১৩ তারিখ রাতে সপ্তাহের ছুটির দিন, পিয়ানো শিক্ষার ক্লাস নিয়মিত করবো কিনা এ সব মামুলি বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। তখন কী আর জানতাম যে খুব দ্রুতই এই সিদ্ধান্তগুলো আমার হাতছাড়া হয়ে যাবে?
৩১ জুলাই ভোরে আমাকে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা অধিদপ্তরে (সি আই ডি) তে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পাঁচদিন ধরে নির্যাতন করা হয়।
গত কয়েক বছর ধরে মানবাধিকার সংস্থার কাজ করার সুবাদে বাহরাইনে নির্যাতন সম্পর্কে আমি পড়েছি, কাজেই ভবিষ্যতে আমার সাথে কী হতে পারে সে সম্পর্কে অন্যদের চাইতে আমি ওয়াকিবহাল ছিলাম, এটা করে যে খুব বেশি পার্থক্য হয়েছে এমনটা নয় কিন্তু তারপরেও এটা আমাকে এক ধরণের মানষিক সুস্থতা দিয়েছে। অন্তরীণের দিনগুলোতে আমার চোখ বাঁধা ছিল ও হাতকড়া পরানো ছিল, এ বিষয়ে আমার আগেই ধারণা থাকায় আমার অনুভূতি আমাকে প্রশিক্ষিত করে তোলে।
আমি তথ্য সংগ্রহ শুরু করি। প্রায় ছয় বাই ছয় অস্থায়ী সেলে আমাকে রাখা হয়। এ কক্ষের গড়ন থেকে বোঝা যায় যে সম্প্রতি এই সেলটিকে বিভক্ত করা হয়েছে। প্লাইউডের দেওয়াল সিলিং পর্যন্ত পৌছে নি । সেখানে অনেক কক্ষ ছিল না, কিন্তু তারা আপনাকে বিভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে এমন এক বিভ্রম তৈরি করবে যে আপনার মনে হবে সেখানে অনেকগুলো কক্ষ রয়েছে।
কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে কীনা কিংবা কেউ বসে আছে কীনা (সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আমাদের বাধ্য করা হতো) সেটা নিয়মিত তদারকের জন্য প্রহরীরা যখন অনুসন্ধানে বের হয়ে দরজা বন্ধ করত তখন আমি শব্দ শুনে দরজার সংখ্যা গণনা করতাম। এতে বোঝা যেত যে সেখানে খুব বেশি একটা কামরা নেই।
দীর্ঘ সময় ধরে পিঠমোড়া করে হাতকড়া পরানো অবস্থায় থাকলে আপনার শক্তিক্ষয় হবে। কিছুক্ষণ পর আপনার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে এবং আপনার দেহের অঙ্গগুলো অসাড় হবে। প্রত্যেক শিফটে আমরা মাত্র একবার পায়খানায় যাওয়ার সুযোগ পেতাম, প্রয়োজন না হলেও আমরা পায়খানায় যেতাম কারন আমাদের হাতকড়া খোলার এটাই ছিল একমাত্র সুযোগ।
পায়ের কাছে হাত নেওয়ার কৌশল আমি রপ্ত করেছিলাম (আমাদের পিঠমোড়া করে হাতকড়া পরানো হত) এবং চোখ বাধা অবস্থায় প্রশান্ত থাকা রপ্ত করেছিলাম। কাজেই যখন আমাকে পায়খানায় নেওয়া হত তখন আমি ঐ কামরাটি পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেতাম। আমি বুঝতে শুরু করলাম কিভাবে কর্মকর্তা ও প্রহরীদের মধ্যে আদেশ আদান প্রদান চলে। পরবর্তীতে অন্যান্য কারাবন্দীদের সাথে কথা বলে এবং তাদের বিবৃতি পাঠ করে আমি জানতে পারি যে, যদি আপনার দরজায় সবুজ রঙের আঠালো কাগজ লাগানো থাকে তাহলে আপনার ঘুমানোর অনুমতি নাই এবং আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, হলুদ আঠা যুক্ত কাগজ সাঁটা থাকার অর্থ হল আপনার রাতে ঘুমানোর অনুমতি আছে, আপনার কক্ষে কোন কাগজ সাঁটা না থাকার অর্থ হল আপনি বসার অনুমতি প্রাপ্ত। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এ কারনে যে এটা থেকে বোঝা যায় যে এ স্থানে একধরণের শ্রেনীবিভাজন ও পদ্ধতি রয়েছে। সেখানে কোন একক সিদ্ধান্ত ছিল না।
নির্যাতনকালে আমাকে শেখানো হত সরকারি উকিলের সামনে আমি কি বলব। আমাকে যে ধরণের প্রশ্ন করা হবে এবং তার উত্তর কি হবে সেটা তারা আমাকে শিখিয়ে দিত। প্রকৃতপক্ষে আমার নির্যাতনকারীরা আমাকে যে প্রশ্ন শিখিয়ে দিত আমার সরকারি উকিল আমাকে সেই প্রশ্নগুলোই করতেন, সহযোগিতার ধরণের ভিত্তিতে তারা আমাকে তুষ্ট করত, আর এ ধরণের বাস্তবতাই বাহরাইনে বিরাজমান।
আমাকে শাসানো হত যদি আমি সরকারি উকিলের কাছে কোন অভিযোগ করি তাহলে আমার উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাবে। আমার উকিল আমার বিষয়ে কিছু টুইট করতে পারবেননা, এটা আমি ধারণা করতে পারতাম। অনেক কারাবন্দীরই এ অভিজ্ঞতা আছে, আমার সমসাময়িক কারাবন্দী অনেকেরই নিজস্ব উকিল ব্যতিরেকেই সরকারি উকিল তাঁদের প্রশ্ন করেছে।
পরবর্তীতে আমাকে যখন ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হল তখন সেখানে আমার কিছু পরিচিত পেলাম এবং সেখানে অনেকেই আমাকে বিশ্বাস করত। ১৬ বছর বয়স্ক একজন সহ কারাবন্দী যখন দেখল আমাকে নোটবুক ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে তখন আমি তার চোখে ঈর্ষা দেখতে পেলাম। এ ধরণের জায়গায় নোটবুক নিয়ে প্রবেশ করাটা বেশ কঠিন, আমি তাকে বঞ্চিত না করে আমার নোটবুকটি ব্যবহার করতে দিলাম আর সে আমাকে অবাক করে দিয়ে তার নিজের প্রজেক্টের কাজ শুরু করল। সে সহচ কারাবন্দীদের মধ্যে ফরম বিতরণ শুরু করল এবং কিভাবে তারা অত্যাচারিত হয়েছে সে গল্প লিখতে বলল।
আমি এই লেখাগুলোর নাম দিয়েছিলাম “টর্চার নোট”। একটা কাগজে লেখা কিছু শব্দ মাত্র নয়- এগুলো ছিল শয়তানের কার্যকলাপ। বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে আসা বিভিন্ন বয়সের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের এ গল্পগুলো পড়াটা ছিল এক নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা। এ নোটবুকটা ছিল আমাদের জাতির জন্য লজ্জাজনক এবং একটা রাস্ট্রের কাঠামোগত ব্যর্থতার নিদর্শন। বাহরাইনের নির্যাতন যে কল্পনাকেও হার মানায় সে বিষয়ে এ নোটবুক আমার বিশ্বাসকে আরও মজবুত করে।
কারাগারে কোন নতুন কারাবন্দীর মৃত্যু কোন চমকপ্রদ ঘটনা নয়, বাহরাইনের কারাগারে যে ধরণের অনুশীলন বা চর্চা রয়েছে তাতে কোন কারাবন্দীর মৃত্যু নির্ভর করে অত্যাচারের মুখে সে কতক্ষণ টিকতে পারবে তার উপর, তাছাড়া চিকিৎসা সেবার অভাব, জনাকীর্ণ কারাগারে শারিরীক অবস্থার অবনতি এবং নির্যাতনের মাত্রার উপরেও কারাবন্দীদের মৃত্যু নির্ভর করে।
হাসান আলশেখ কে নির্যাতন করে হত্যার জন্য কারাগারের তিনজন কর্মী দায়ী। তিনজনের মানে হল এটা ছিল একটা দলগত সিদ্ধান্তঃ তিনজনের কেউই বন্দীদের নির্যাতন করাকে অন্যায় মনে করত না, এ মানসিকতা নির্যাতনের আবহকে সাধারণ স্বীকৃতি দেয়। হাসান আল শেখের নির্যাতনকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন যে মাদক অপব্যবহারকারীদের পূণর্বাসন প্রভাষকের দায়িত্বে ছিলেন। তার এধরণের দায়িত্ব প্রাপ্তি ব্যবস্থাপনার কাঠামোত ব্যর্থতার ইঙ্গিত বহন করে।
অন্য আরও আটজন কারাকর্মীকে সাক্ষী রেখে তাদের উপস্থিতিতে আলশেখকে নির্যাতন করা হয় এবং হত্যা করা হয়। এ অপরাধ রোখার জন্য কেউ এগিয়ে না এসে ভবিষ্যতে নির্যাতনের মাত্রা দেখার জন্য অপেক্ষা করল। অন্য কারাবন্দীরা শুধু বসে ছিল আর তার মৃত্যুর আর্তচীৎকার শুনছিল।
পশ্চিমা জোট যতক্ষন পর্যন্ত বাহরাইন সরকারের “সংস্কার” কর্মসূচির প্রশংসা করা বন্ধ না করবে ততক্ষন পর্যন্ত বাহরাইনে হাসান আলশেখ এর মত নির্যাতনে মৃতের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। জোট বিশেষত যুক্তরাজ্য যখন “সংস্কারের” বিষয়ে মন্তব্য করে তখন তা প্রতিবার পাঠ করে কারাবন্দিকালীন মুমূর্ষু থাকা অবস্থা্র চাইতেও আমি বেশি অপমানিত বোধ করি, এটা আমার দুস্বপ্নকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
হাসান এবং অন্যান্য ৮০জন সহকারাবন্দীর কাহিনী পড়ে আমি আপনাদের কাছে একটি সহযোগিতা প্রত্যাশা করিঃ দয়া করে আমাদের অপমান বন্ধ করার জন্য আপনারা ফরেন এন্ড কমনওয়েলথ অফিসের পররাষ্ট্র সচিব জনাব ফিলিপ হ্যামন্ড কে লিখুন বা টুইট করুন।