আর্জেন্টিনার ফুটবল কিংবদন্তি ম্যারাডোনাকে বিদায় জানালো বাংলাদেশ

বাংলাদেশে ছড়িয়েছে ফুটবল জ্বরের উত্তাপ। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া দলগুলোর নানা রং ও বর্ণের পতাকা। যাত্রাবাড়ি, ঢাকা। ছবি তুলেছে সৌরভ লস্কর। সর্বস্বত্ত্ব ডেমোটিক্স (৮/৬/২০১৪)

বাংলাদেশে ছড়িয়েছে ফুটবল জ্বরের উত্তাপ। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া দলগুলোর নানা রং ও বর্ণের পতাকা। যাত্রাবাড়ি, ঢাকা। ছবি তুলেছে সৌরভ লস্কর। সর্বস্বত্ত্ব ডেমোটিক্স (৮/৬/২০১৪)

বাংলাদেশের অনেক ফুটবল ভক্তের কাছে ফুটবল মানেই ম্যারাডোনা। তাই গত ২৫শে নভেম্বর আর্জেন্টিনার কিংবদন্তীর এই ফুটবলারের মৃত্যুতে বাংলাদেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। বাংলাদেশের অনেক ফুটবলপ্রেমী সোশ্যাল মিডিয়াতে জানিয়েছেন ম্যারাডোনা তাদের জীবনে কিভাবে জড়িয়ে ছিলেন।

ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর টুইটার ব্যবহারকারী একটিক্স টুইট করে জানান বাংলাদেশের মনের খবরঃ

আমি শুনতে পাচ্ছি বাংলাদেশের কান্না

ম্যারাডোনার নাম কিভাবে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পরিচিত হল সে সম্পর্কে সাব্বির টুইট করেছেনঃ

আমার একেবারে শৈশব থেকে আমি তাঁর কথা স্মরণ করতে পারি। সে সময় আমি বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করতাম আর ভাবতাম যদি আর কিছুদির হেটে যাই তাহলে আমি পৃথিবী থেকে পড়ে যাব কারণ পৃথিবী চ্যাপ্টা। এই ছিল আমার জ্ঞানের পরিধি, কিন্তু আমি ম্যারাডোনার নাম জানতাম। তিনি আসলে এতটাই জনপ্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন।

পরবর্তী দিন বাংলাদেশীরা বিভিন্নভাবে ম্যারাডোনার কীর্তিকে স্মরণ করে। যেমন ঢাকায়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের মাঠে স্মরণ করা হয় ম্যারাডোনাকে।

আজকে মাঠে উপস্থিত চারটি দলই কিংবদন্তীর ফুটবলার ডিয়োগো ম্যারাডোনার শোকে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন। আজকের অনুষ্ঠিত দুটি খেলার প্রথম খেলা শুরুর ঠিক আগে কিংবদন্তীর জন্য এই শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়।

ফিফা বিশ্ব ফুটবল র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান খুব নীচে হলেও এ দেশে খুবই জনপ্রিয় এই খেলা। বেশিরভাগ বাংলাদেশী ফুটবলপ্রেমী লাতিন আমেরিকার ফুটবল লিগ অনুসরণ করেন এবং তাদের আইকন হচ্ছে আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা বা ব্রাজিলের পেলের মতো বিশ্বনন্দিত আইকনগুলি।

কিছু অনুরাগী বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে ম্যারাডোনা মৃত্যু ঘটেছে। রম্য ম্যাগাজিন উন্মাদ এর সহকারী সম্পাদক আনিসুল কবীর ফেসবুকে লেখেনঃ

পৃথিবীতে ম্যারাডোনা নামের অবাক করা মানুষটি নাই, ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ফুটবল বিশ্ব সেরাদের মধ্যে সেরা একজন কিংবদন্তিকে হারালো। খারাপ লাগলো খবরটা শুনে।

ফেসবুকে নোমান মোহাম্মদ লেখেনঃ

ডিয়েগো ম্যারাডোনা মারা গেছেন। খবরটা মিথ্যা হোক, খুব করে চেয়েছিলাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওয়েবসাইটে ঢুকে বুঝতে চেয়েছি, কেউ যেন এটিকে গুজব বলে। কিন্তু তা হল না। আর্জন্টিনার ক্লারিন থেকে গোল ডট কম সবাই নিশ্চিত করছে। ম্যারাডোনা আর নেই।

এর মাঝখানে তাজিন টুইট করেছেনঃ

ফুটবল কিংবদন্তি দিয়েগো #মারাদোনা গত ২৫শে নভেম্বর বুধবার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তার ফুটবল ক্যারিয়ার জুড়েই বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও তার বিশাল ফ্যান রয়েছে। আমরা তাঁর ফুটবল যাদু দেখে বড় হয়েছি।
পরপারে শান্তিতে থাকুন ম্যারাডোনা। তাঁর পরিবার ও বন্ধুদের জন্যে রইল সমবেদনা। আমরা আপনাদের ভালোবাসি ❤️!

অনেক বাংলাদেশী আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সমর্থক যাদের উল্লেখযোগ্য অংশ সে দেশের ভক্ত হয়েছেন মূলতঃ ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে।

ফেসবুকে সাকিবুর রহমান খান ব্যাখ্যা করেছেনঃ

অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে স্বৈরাচারী হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে প্রথম চমকটি দেখান সরাসরি বিশ্বকাপ ফুটবল টেলিভিশনে দেখিয়ে । বাংলাদেশের সকল মানুষের সাথে আমিও সেই বাল্যকালে নেশায় বুঁদ হয়ে ব্রাজিলের ভক্ত হয়ে যাই । সেই ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলে বাংলাদেশের মানুষ ম্যারাডোনাকে খুব একটা চিনলো না। ১৯৮৬ সালে যখন ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল শুরু হয় তখন আমরা দেখি ম্যারাডোনার জাদুকরী ফুটবল খেলা । বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ ব্রাজিল ছেড়ে আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করা শুরু করে। ঢাকা শহরের আমিনবাজার, Old town তখন ছেয়ে যায় আর্জেন্টিনার পতাকায় । তার পরের ইতিহাস শুধুই ম্যারাডোনার।

আর বাংলাদেশে ম্যারাডোনাময় দিনগুলোর কথা উঠে এসেছে ফেসবুকে লেখা সরদার জোবায়ের হোসেন এর স্ট্যাটাসঃ

স্কুলের খাতায় ম্যারাডোনা, বাজারের ব্যাগে আর্জেন্টিনা, বাড়ির চার দেয়ালে আকাশি-সাদা ডোরা, আমাদের শৈশব ছিল ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির ম্যারাডোনাময়। ধানমন্ডিতে মিরপুরের রোডের উপর চাইনিজ রেস্টুরেন্টের নাম ছিল ম্যারাডোনা। পাড়া মহল্লায় আর্জেন্টিনা- ব্রাজিলের নামে ফ্রেন্ডলি ফাইটিং পর্যন্ত চলত। ৮৬ সালের পর বাঁশের আগায় দুইখান পতাকা রাখতাম ঘরে। একখান আর্জেন্টিনা, আরেকখান ঢাকার মোহামেডান । আহা দিন!

বাংলাদেশে ম্যারাডোনা এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়কে নিজেদের জয় এবং পরাজয়কে নিজেদের পরাজয় বলে বিবেচনা করত অনেকে। ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ফাইনালে জার্মানীর কাছে পরাজিত হওয়ার পর ম্যারাডোনা সাথে কেঁদেছিল বাংলাদেশ। তবে শুধু কান্না নয় অনেকে ম্যারাডোনা ভক্ত আর্জেন্টিনার এই পরাজয় মেনে নিতে না পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। এদের অনেকে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ মিছিল বের করে রেফারির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

সে বছরই বাংলাদেশ এর উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমেদ ঘোষণা দেন ম্যারাডোনা বাংলাদেশে আসছেন। কিন্তু সেটা বাস্তবে পরিণত হয়নি। শোনা যায় ম্যারাডোনাকে বাংলাদেশ নিয়ে আসার এই ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল সে সময় ক্ষমতাসীন শাসকের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ব্যাপক গণ আন্দোলন প্রশমিত করা।

পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার এই ফুটবল মহানায়ককে বাংলাদেশে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল: ২০০৮ সালে, যখন তিনি প্রতিবেশী দেশ ভারত সফর করেছিলেন, এবং ২০২০ সালে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করার জন্য তার বাংলাদেশে আসার কথা ছিল।

১৯৯৪ সাল ছিল ম্যারাডোনার শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু মাদক নেবার অভিযোগে এই বিশ্বকাপে ম্যারোডোনা নিষিদ্ধ হয়ে যান এবং সেই সাথে আর্জেন্টিনাও বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। এবার বাংলাদেশী ম্যারাডোনা ভক্তরা ফিফার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়।

বাংলাদেশের ম্যারাডোনা ভক্তদের সেইসময়কার কথা উল্লেখ করে টুইটারে আসিফ হাদি টুইট করেনঃ

যখন ১৯৯৪ সালে ম্যারাডোনাকে বিশ্বকাপ এ নিষিদ্ধ করা হয়, এর ফলে অনেকে এখানে অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এখানে ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তা পরিমাপ করা অসম্ভব। ওপারে শান্তিতে ঘুমান ম্যারাডোনা।

তবে সবাই ম্যারাডোনার ফুটবলের ভক্ত হলেও তাঁর জীবন যাপনের যে ধরণ তার ভক্ত ছিল না অনেকে। প্রখ্যাত বাংলাদেশী লেখিকা তাসলিমা নাসরিন টুইট করেছেনঃ

মাদকাসক্তি ম্যারাডোনার মৃত্যুর কারণ

তার জীবন যেমন ভাবেই যাপন করুন না কেন, ম্যারাডোনার প্রতি বাংলাদেশীদের এই ভালবাসার কথা এই কিংবদন্তীর অজানা ছিল না। আর তাই তাঁর আত্মজীবনী “এল দিয়েগোর” শুরুতে উল্লেখ রয়েছে বাংলাদেশের নাম। যে বাংলাদেশ তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁকে ধারণ করে রেখেছে হৃদয়ে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .