জাপানের রৈখিক বুলেট ট্রেনের প্রকৃত ব্যয়

ইয়ামানাশি প্রিফেকচারের পরীক্ষামূলক পথে রৈখিক (এল০) “ম্যাগলেভ” মোটরগাড়ি। সৃজনশীল সাধারণ অনুমতি, উইকিপিডিয়া, সারুনো হিরোবানো

কয়েক দশক ধরে জাপানি ব্যবসায়িক ও সরকারি নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি অনেক গণমাধ্যম দেশের পরিকল্পিত বুলেট ট্রেন রৈখিক চুও শিনকানসেন (রৈখিক) প্রচার করেছে। চৌম্বকীয়ভাবে উত্তোলিত (“ম্যাগলেভ”) বুলেট ট্রেনটি ৫০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিতে চলতে পারে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে ৪০ মিনিটের মধ্যে টোকিও থেকে নাগোয়া এবং ২০৪৫ সালের মধ্যে মাত্র ৬৭ মিনিটের মধ্যে ওসাকার সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্যে নির্ধারিত।

তত্ত্বগতভাবে বর্তমান বুলেট ট্রেন তোকাইদো শিনকানসেনকে পরাজিত করবে, যা ইতোমধ্যে উল্লিখিত শহরগুলির মধ্যে যথাক্রমে প্রায় ৫০ মিনিট ও দেড় ঘন্টার মধ্যে চলছে।

প্রকল্পের পিছনে থাকা বেসরকারি সংস্থা কেন্দ্রীয় জেআরর দাবি রৈখিকটি জাপানি শিল্পকে শক্তিশালী করে বিশাল অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনবে — বিশেষ করে ম্যাগলেভ প্রযুক্তি বিদেশে রপ্তানি করা হলে।

তবে ২০১৪ সালে নির্মাণ শুরু হওয়ার পর থেকে, অনেক জাপানি বাসিন্দারা শুধু কিছু সুবিধার প্রত্যাশার সাথে ক্রমবর্ধমান খরচ দেখেছে।

শুরু করার জন্যে জাপানি করদাতাদের বিস্ময়কর ৯ লক্ষ কোটি ইয়েন (প্রায় ৬.৬৮ লক্ষ কোটি টাকা) প্রাক্কলিত ব্যয়ের একটি বড় অংশে অংশ নিতে বলা হচ্ছে৷ উদাহরণস্বরূপ ২০১৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আবে শিনজোর প্রশাসন কেন্দ্রীয় জেআর’কে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে অতি-অল্প-সুদে বিস্ময়কর ৩ লক্ষ কোটি ইয়েন (প্রায় ২.২ লক্ষ কোটি টাকা) দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দিয়েছে।

তার ওপর,স্থানীয় প্রিফেকচারের সরকার ও করদাতারা রৈখিকের জন্যে নতুন ট্রেন স্টেশন নির্মাণের ব্যয় বহন করছে। কেন্দ্রীয় জেআরের নিজস্ব প্রাক্কলন অনুসারে, শুধু স্টেশন নির্মাণে গড় খরচ ৩,৫০০ কোটি ইয়েন (প্রায় ২, ৫৯৭ কোটি টাকা), এমনকি কানাগাওয়া প্রিফেকচারের ক্ষেত্রে ২২,০০০ কোটি ইয়েন (প্রায় ১৫,৪০৮ কোটি টাকা) পৌঁছেছে।

বিশেষ করে কেন্দ্রীয় জেআরের নিজ সভাপতি যখন স্বীকার করেছেন ম্যাগলেভ অভ্যন্তরীণভাবে লাভ না করলেও মূলত বিদেশে জাপানি প্রযুক্তি বিক্রি করতে ব্যবহৃত হবে, তখন উচ্চ মূল্যের মতোই মনে হচ্ছে।

করদাতাদের মানিব্যাগ ছাড়াও রৈখিক প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরও প্রভাব ফেলছে।

উদাহরণস্বরূপ যখন এর সমর্থকরা ট্রেনের “পরিচ্ছন্ন” ও কার্বন ডাই অক্সাইড-বাঁচানোর সনদগুলি তুলে ধরে, তখন রৈখিক আসলে বর্তমান তোকাইদো শিনকানসেনের তুলনায় প্রতি ব্যক্তি প্রতি তিন থেকে চার গুণ বেশি শক্তি ব্যবহার করবে। এই শক্তির বেশিরভাগই জীবাশ্ম জ্বালানি ও পারমাণবিক থেকে উৎসারিত হবে।

তাছাড়া, টোকিও থেকে ওসাকা পর্যন্ত রৈখিকের যাত্রার ৯০ শতাংশ সম্পূর্ণরূপে ভূগর্ভস্থ হবে, যার মধ্যে ৭০ কিলোমিটার সরাসরি জাপানি আল্পসের নিষ্কলুষ বিজন এলাকার তলদেশ দিয়ে বহমান।

বর্তমান তাকাইদো শিংকানসেনের সাথে মেলানো রৈখিক চুয়ো শিংকানসেন (“ম্যাগলেভ”) পথের একটি মানচিত্র। হালকা গোলাপী রঙে জাপানি কেন্দ্রীয় ও দক্ষিণ আল্পস। শিজুওকা প্রিফেকচারের ওআই নদী হালকা নীল। কেন্দ্রীয় জেআর ©জাস্টিন আউকেমার পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে লেখকের উপস্থাপনা।

এটি ইতোমধ্যে প্রচুর পরিমাণে মাটি ও ময়লা বর্জ্য তৈরি করছে, যার মধ্যে কিছু আর্সেনিকপারদের মতো বিষাক্ত রাসায়নিকে দূষিত, এবং যার প্রায় সবকটিরই কোনো নির্দিষ্ট ব্যবহার বা সঞ্চয়স্থান নেই। অনুমান করা হয় শুধু টোকিও ও নাগোয়ার মধ্যে টানেল নির্মাণ ৫.৬৮ কোটি ঘনমিটার বর্জ্য উৎপন্ন করবে।

এসবের মাত্র একটি ভগ্নাংশ পুনঃব্যবহারযোগ্য বলে বেশিরভাগই গিরিসঙ্কট ও নদী উপত্যকা ভরাট করতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে অনেক বিশেষজ্ঞ ও বাসিন্দারা ভারি বৃষ্টিতে সম্ভাব্য ভূমিধসের আশঙ্কায় আতঙ্কিত।

বিশেষ করে জাপান আল্পসের নীচে অনেক বড় স্রোত ও নদী উৎপন্ন হয় বলে অন্যরা আশেপাশের সম্প্রদায়ের জল সরবরাহের উপর টানেলের প্রভাব নিয়ে চিন্তিত। প্রকৃতপক্ষে জেআরের নিজস্ব সমীক্ষায় দেখা গেছে এর টানেলগুলি প্রতি সেকেন্ডে দুই মেট্রিক টন কম জল ওআই নদীতে প্রবাহিত করবে। এটি জীবিকার জন্যে নদীর উপর নির্ভরশীল শিজুওকা প্রিফেকচারের বাসিন্দাদের এতোটাই উদ্বিগ্ন করেছে যে গভর্নর কাওয়াকাতসু হেইতা তাদের প্রিফেকচারের ভেতর দিয়ে ম্যাগলেভ নির্মাণের জন্যে তার অনুমোদন স্থগিত করেছেন

রৈখিক “প্রিফেকচারের জন্যে একেবারেই কোন সুবিধা নিয়ে আসে না,” কাওয়াকাতসু বলেছেন

শিজুওকার বাসিন্দা সুজি হিরোশি (৮৬) এর সাথে একমত। আসাহি শিম্বুনের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি ১৯৩০-এর দশকে আরেকটি ট্রেন টানেল ভূগর্ভস্থ জলাশয় ও স্থানীয় খামার ধ্বংসের কথা স্মরণ করেন। “জল একবার চলে গেলে, তা আর ফিরে আসে না,” তিনি আফসোস করেন।

তবুও সম্ভবত রৈখিক প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মানুষের।

উদাহরণস্বরূপ, ২৮ অক্টোবর, ২০২১-এর রাতে সুড়ঙ্গ কর্মী কোসাকা কোকি (৪৪) গিফু প্রিফেকচারের সরল রৈখিক টানেলের একটি অংশে একটি ডিনামাইট বিস্ফোরণের ফলাফল পরিদর্শনের সময় ছুটে আসা পাথরে পিষ্ট হয়ে মারা যান

শুধু ম্যাগলেভ নির্মাণের সময় নাগানো প্রিফেকচারে কমপক্ষে চারটি বড় কর্মক্ষেত্রে আঘাতের ঘটনা ঘটেছে।

আর নির্মাণ শ্রমিকরাই শুধু ব্যথা পান নি। কানাগাওয়া প্রিফেকচারের সাগামিহারার ১০০টি বাড়িসহ অনেক বাসিন্দাকে আগত ট্রেনের পথ তৈরি করতে জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করা হচ্ছে।

সাগামিহারা সিটি জনসাধারণের তহবিল থেকে আসা ৩,৩০০ কোটি ইয়েন (প্রায় ৩,৬৩২ কোটি টাকা) সহ মোট ৫,৩৮০ কোটি ইয়েন (প্রায় ৩,৯৯৫ কোটি টাকা) ব্যয়ে একটি নতুন রৈখিক স্টেশন তৈরি করতে ১৩.৭ হেক্টর এলাকা থেকে বাসিন্দাদের বের করে দিচ্ছে

ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও বিখ্যাত এলাকার মতো আইনানুসারে জমিগুলি জব্দ করায় অনেকেই আলোচনার ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্ট

শহরটি ২০২২ সালে নতুন স্টেশন উন্নয়নের বিষয়ে চিন্তাভাবনা সম্পর্কে জরিপকৃত ৩৭৩জন বাসিন্দার  মধ্যে ৩১৬ জন – ৮৫ শতাংশ – প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে যে তারা এর সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছে। একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে প্রস্তাবিত ধ্বংসের পথে পড়া বাড়ির বয়স্ক বাসিন্দা আকেশি কাজুকো বলেছেন “আমাদের রৈখিকের দরকার নেই।“

স্থানীয় জনবিরোধিতা এতোটাই বেড়েছে যে ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে টোকিও ও কানাগাওয়ার ৭৮০ জন বাসিন্দা সম্পূর্ণ ব্যয় মূল্যায়ন না করেই রৈখিক প্রকল্প অনুমোদন দেওয়ার জন্যে জাপান সরকারের বিরুদ্ধে একটি শ্রেণী ব্যবস্থার মামলা দায়ের করেছে।

নাগানো প্রিফেকচারের ইডা সিটিতে অনুরূপ একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে নতুন একটি রৈখিক স্টেশনের জন্যে ১৯০টি পরিবারকে জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করা হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত একজন বাসিন্দা কুবো মিকি স্থানীয় সংবাদ সংস্থা শিনানো মাইনিচি শিনবুনকে বলেছেন তিনি মনে করেন তার কোনো “কণ্ঠস্বর নেই।” “সত্যিই আ্মার মন খারাপ,” অন্য একজন বলেছেন, “এটি সত্যিই একটি শান্ত ও শান্তিপূর্ণ জায়গা ছিল এবং আমি এখানে আমার শেষ দিনগুলি কাটানোর কথা ভেবেছিলাম।”

অন্যান্যদের সাথে একজন বয়স্ক নারী এককথায় প্রতিরোধের চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “একটি জাতীয় নীতি হওয়ায় এর প্রতিবাদ করা অর্থহীন।”

দক্ষিণ আল্পসের একটি ঘুমন্ত গ্রাম নাগানোর ওশিকা গ্রামের বাসিন্দারাও অসন্তুষ্ট। ২০২০ সালের একটি তথ্যচিত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেখানে রৈখিকের জন্যে টানেল নির্মাণে প্রতিদিন ১.৭৬৩টি ডাম্প ট্রাক সরু পাহাড়ি রাস্তায় নামে, যা ইতোমধ্যে “প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অপরিবর্তনীয় ক্ষতি করেছে।”

গ্রাম ও এর আশপাশের ধ্বংসের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে স্থানীয় দুগ্ধ খামারি কোবায়শি সুনাও বলেন, “একবার প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেলে তা চিরতরে চলে যায়।”

প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রীয় জেআরের জাপানি আল্পসের মধ্য দিয়ে খননের পরিকল্পনা বিশেষ করে স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয় হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১ সালের একটি সরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে ৮৮৮জন উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬৪৮জন বা ৭৩ শতাংশ আল্পস রুটের বিরোধিতা করার কথা বলে বলেছেন পরিকল্পনাগুলি বাতিল করা উচিত।

তবুও এই জনপ্রিয় বিরোধিতার অনেক কিছুই কর্ণপাত করা হয়নি বলে মনে হচ্ছে।

এদিকে পথের শেষে জাপানের কানসাই অঞ্চল ও ওসাকা শহরে যেখানে ২০৪৫ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় জেআর রৈখিক প্রসারিত করার আশা করছে, সেখানকার অনেক লোক এখনো এর প্রকৃত ব্যয় সম্পর্কে সচেতন নয়।

স্থানীয় ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা আগ্রহের সাথে নতুন ম্যাগলেভের প্রচার করছে। উদাহরণস্বরূপ, নারা সিটিতে পপ আইডল ওনিশি মোমোকা ট্রেনের জন্যে একটি প্রচারমূলক ভিডিও প্রকাশ করেছে এবং জেআর নারা স্টেশনকে রৈখিকপন্থী বিজ্ঞাপন দিয়ে ঢেকে ফেলেছে।

রৈখিকপন্থী একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে জেআর নারা স্টেশনের দিকে যাওয়ার একটি সিঁড়ি রঙ করা হয়েছে যেখানে লেখা আছে “নারাকে সরল রেখায় আনুন।” লেখকের ছবি। ৪ জানুয়ারি, ২০২৪।

ওসাকা সরকারও রৈখিকের পক্ষে জোরালো সমর্থন জানিয়েছে

তবে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। অন্যদের একটি ছোট দলসহ অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক কাসুগা নাওকি ম্যাগলেভের সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ২০১৫ সালে রৈখিক নাগরিক নেটওয়ার্ক ওসাকা শুরু করেন।

গোষ্ঠীটি নিরাপত্তা ও ব্যয় উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে ওসাকা সরকারের কাছে রৈখিকের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে আবেদন করে

কিন্তু ব্যাপক শ্রোতাদের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে।

“স্থানীয় সরকার ও কিছু বড় ব্যবসা রৈখিক নির্মাণের জন্যে চাপ দিচ্ছে,” তিনি গ্লোবাল ভয়েসেসকে একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন৷ “এই রৈখিকপন্থী গোষ্ঠীগুলি রৈখিক কতটা দুর্দান্ত শুধু তার ওপর জোর দিলেও,” এর নেতিবাচক দিকগুলিকে উপেক্ষা করার প্রবণতা দেখায়।

ফলে “ওসাকার অনেক লোক […] রৈখিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন নয়,” তিনি আরো বলেন।

তবুও রৈখিক প্রকল্পটি এগিয়ে চলেছে। এখন কাসুগার মতো অনেকেই উদ্বিগ্ন যে খুব দেরি হওয়ার আগে জনগণ এর আসল ব্যয় বুঝবে না।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .