ধ্বংসস্তূপে আটকে আছে শরীর ও মন

বাচ্চাদের বাঁচাতে সাবধান করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে একজন মা নিজের মুখ চেপে ধরে রাখেন। ইউটিউবে ‘টাইটান আক্রমণ’-এর ১ম পর্ব থেকে গৃহীত পর্দাছবি (২২:২৮)। ন্যায্য ব্যবহার।

ইসরায়েলের গাজায় অবিরাম বোমাবর্ষণের একটি ব্যক্তিগত বর্ণনা হিসেবে সালেহ জামাল সাফি এই গল্পটি লিখেছিলেন যা আমরা সংখ্যা নই প্রথম ১২ জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখে প্রকাশ করে। অসম্পাদিত অবস্থায় গল্পটি, যুদ্ধের একজন সাক্ষীর মুক্ত সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপিত এবং একটি বিষয়বস্তু ভাগাভাগির চুক্তির অংশ হিসেবে এখানে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

দৈত্যাকৃতির দানব একটি গ্রামে আক্রমণের সময় একজন মায়ের পা তার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নীচে আটকে রয়েছে। হাঁটতে না পেরে তিনি তার ছেলেকে তাকে ফেলে রেখে তার বোনকে নিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন।

“ইরেন, মিকাসাকে নিয়ে পালাও!”

“আমি পালাতে চাই! তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বের হও,” ইরেন বলে।

“এখন! … আমার পা ধ্বংসস্তূপে পিষ্ট। বেরুতে পারলেও দৌড়াতে পারবো না। তুমি কি বুঝতে পেরেছো?”

“তাহলে আমি তোমাকে বহন করবো!” ইরেন উত্তর দেয়।

“কখনো তুমি আমার কথা শুনো না কেন? শেষবার অন্তত আমার কথা শোনো!” মা বলেন।

ঠিক তখনই একজন প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিবেশীএসে সময়মতো মাকে বাঁচাতে পারবে না বুঝতে পেরে শিশু দুটিকে তুলে নিয়ে যায়। মা তাকে ফেলে রেখে না যেতে অনুরোধ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে তার মুখ ঢেকে রাখে।

এই বেদনাদায়ক দৃশ্যটি কমিক বই টাইটান আক্রমণ ভিত্তিক জনপ্রিয় জাপানি এনিমে টিভি ধারাবাহিকের প্রথম পর্বের।

এই দৃশ্য কি বাস্তবে ঘটতে পারে? একেবারেই না — অন্তত ৭ অক্টোবরের কয়েক মাস আগে যখন আমি প্রথম ধারাবাহিকটি দেখেছিলাম তখন আমি সেটাই ভেবেছিলাম। এটা খুবই পরাবাস্তব ছিল।

পরাবাস্তব মনে হলেও, বাস্তব

গাজায় ইসরায়েলি দখলদারের গণহত্যার ৫৩তম দিন ২৯ নভেম্বর, ২০২৩ ছিলএকটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতির চতুর্থ দিন। আমি সেদিন কাছাকাছি পাওয়া যায় না এমন কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে খান ইউনিস থেকে একজন অপরিচিত ব্যক্তির গাড়িতে রাইড শেয়ার করে রাফাতে বাড়ি ফিরছিলাম।

দেখা গেলো গাড়িতে থাকা অন্য ব্যক্তিটি দুই সপ্তাহেরও কম আগে ১৮ নভেম্বর সংঘটিত আল হোজ্জা সড়কের গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া একজন। তিনি আমার সাথে ভাগ করেছিলেন পরিস্থিতিটি কতো দুঃখজনক ও ভয়ঙ্কর ছিল।

“আমরা সরে যাচ্ছিলাম,” তিনি ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনী তাদের শুধু পরিচয়পত্র ছাড়া কিছুই নিতে দেয়নি, এমনকি খাবার বা পানিও নয়। জনতার উপর ইসরায়েলি বিমান আঘাত হানার সময়  “আমরা রাস্তায় নিরস্ত্র হেঁটেছিলাম।অনেক  মানুষ শহীদ হয়েছে। অন্যরা আহত। কেউ কেউ বেঁচে গেলেও তাদের বেশিরভাগ আহতদের সাহায্য করতে পারেনি – অনেকেই হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। চেষ্টা করেও কেউ তাদের সাহায্য করতে পারেনি।” সে বলেই যাচ্ছিল:

“একজন আহত ব্যক্তি তার সন্তানকে স্ত্রীর কাছে দিয়ে তাকে ফেলে রেখে চলে যেতে বলেছিলেন যাতে দুজনে সেখান থেকে বেরুতে পারে। পিতা মারা যাওয়ার পর সে তার সন্তানদের চোখের দিকে কিভাবে তাকাবে হয়তো তা ভেবেই স্ত্রী থেমে গেলো।”

টাইটান আক্রমণের ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি বাস্তবে পরিণত হওয়া আমাকে আঘাত করলেও আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে এমন কিছু ঘটতে পারে।

লোকটির গল্প এখানেই শেষ হয়নি।

“আমরা কৃতজ্ঞ যে আমার ভাই ও তার ছোট ছেলে বেঁচে গেছে,” তিনি বলেন। “আমরা সুখ, দুঃখ ও অপরাধবোধের সাথে হতাশার মিশ্রণ অনুভব করেছি। বেঁচে থেকে খুশি এবং অন্যরা যখন পরিবারের সদস্য ও তাদের শরীরের অংশ হারায় তখন সুখী হওয়ার জন্যে দোষী। আমাদের সব অনুভূতি খারাপ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।”

তিনি ব্যাখ্যা করে যাচ্ছিলেন যে তারা একটি ইসরায়েলি দখলদার চেকপয়েন্টে পৌঁছালে রক্ষীরা তাদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে নিশ্চিত করে যে তারা কেউ হামাসের সাথে সম্পর্কিত নয়। তখন একজন সৈনিক বলে, “এখানে আয়, ছাগল।”

“সে ছেলেকে কোলে নেওয়া আমার ভাইকে ডাকছিল। বিভ্রান্ত হয়ে আমরা ভাবছিলাম কি হচ্ছে। সে কী চায় আমার ভাই দেখতে গেলে সৈনিকটি তাকে এই অপমানজনক, বর্বর বাক্য দিয়ে আঘাত করে: “ছাগল, তুমি তোমার ছেলেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো বলে মনে করছো? জীপে ওঠ, কারণ তুই জেলে যাচ্ছিস। কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তা জানার অধিকারও আমার ভাইয়ের নেই।”

“সৈন্যরা তাদের জামাকাপড় খুলে ফেলে কেবল তাদের অন্তর্বাস পরে থাকতে দিলো। তারা তার বাবার সাথে কেমন আচরণ করছে তা দেখার সময় একটি শিশু কেমন অনুভব করবে?”

আমাদের জীবনের একটি তথ্যচিত্র

আরো ভয়ানক জিনিস দেখে আমার মনে হয়েছে যেন টাইটান আক্রমণ আমাদের জীবনেরই একটি তথ্যচিত্র।

আমি ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ খাবার নিয়ে আমার বোনদের সাথে তর্ক করছিলাম। খালি করে আমরা আমার দাদির বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম, যেখানে কাছাকাছি একজন ফালাফেল বিক্রেতা ছিল। আমাদের ক্ষুধা মেটানোর একমাত্র সমাধান হিসেবে কিছু সব্জির ফালাফেল ভাজা কিনতে গিয়ে আমি একটি দীর্ঘ লাইন দেখতে পেলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি আমার পালার অপেক্ষায় রইলাম। আমার পাশে প্রায় ১০ বছর বয়সী একটি মেয়ে তার ছোট বোনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

হঠাৎ ফালাফেল বিক্রেতার পাশের একটি ছোট রাস্তা থেকে রক্তাক্ত মুখের একটি শিশুকে নিয়ে কয়েকজন লোক বেরিয়ে আসে। আমি অনেক শহীদ দেখলেও সেদিন ছিল অন্যরকম। আমি কখনোই কারো এতো কাছাকাছি হইনি।

আমি দৃশ্যটি সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিলাম, আর সত্যিই আমার খারাপ লাগতে লাগলো। অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার জন্যে আমি অনুশোচনা করেছি। একটি দেবদূতের মুখ দেখে আমি কীভাবে এরকম অনুভব করেছি?

এদিকে ১০ বছরের মেয়েটি তার ছোট বোনকে দেখতে নিষেধ করেছে। হয়তো আমি নিজেকে বিভ্রান্ত করতে গিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেও তা করতে পারিনি। মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি বাচ্চাটিকে দেখেছি কিনা। আমার মনে হয় সে আমার মুখ পড়ে অবশ্যই ঠিকই বুঝেছে।

আমি তাকে একই প্রশ্ন করলে সে মাথা নাড়ালো। তারপর সে জিজ্ঞাসা করলো, “ও খুব ছোট, ও স্বর্গে সুখী হবে, তাই না?”

আমি হ্যাঁ বলে আর বেশি কিছু বলতে পারলাম না।

কয়েক মিনিট পরে তারা ধ্বংসস্তূপ থেকে একই বোমা হামলায় নিহত আরেকটি শিশু ও এক ব্যক্তিকে বের করে আনে। আমার আবেগ আটকে যায়, আমার অনুভূতিগুলি ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .