মালদ্বীপের প্রাক্তন মেয়র ও নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুইজ্জু ১৭ নভেম্বর, ২০২৩-এ মালদ্বীপের অষ্টম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। তার মেয়াদের প্রথম দিনে মুইজ্জু ভারত সরকারের কাছে মালদ্বীপে অবস্থানরত সৈন্য প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করেন যা দুই দেশেই শিরোনাম হয়েছে। তবে এটাও উল্লেখ করেছেন তিনি চীন বা অন্য কোনো দেশকে তাদের প্রতিস্থাপন করতে দেবেন না। মুইজ্জুর রাষ্ট্রপতিত্ব মূলত মালদ্বীপের বিষয়ে ভারতীয় প্রভাব হ্রাস করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মুইজ্জু দ্বিতীয় দফার দৌড়ে মালদ্বীপের গণতান্ত্রিক পার্টির বর্তমান সভাপতি ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহকে পরাজিত করেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ইয়ামিনের মালদ্বীপের প্রগতিশীল পার্টি (পিপিএম) সমর্থন নিয়ে মুইজ্জু তার প্রতিষ্ঠিত একটি বিরোধী দল জাতীয় গণকংগ্রেসের (পিএনসি) প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
উল্লেখ্য পিপিএম ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করতে ২০২০ সালে একটি ভারত-হটাও প্রচারণা শুরু করে। রাষ্ট্রপতি সোলিহ ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে চীনের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে ভারতের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে ‘ভারত প্রথম‘ নীতি গ্রহণ করেন। আবদুল্লাহ ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ুমের (২০১৩-২০১৮) মেয়াদে মালদ্বীপ চীনকে আলিঙ্গন করলে দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং অসংখ্য বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।
আরো পড়ুন: ভারত নাকি চীন: মালদ্বীপের আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ভবিষ্যতের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করবে
মালদ্বীপে ভারতীয় সেনা উপস্থিতি
মালদ্বীপের সাথে একটি সামুদ্রিক সীমান্ত ভাগাভাগি করা ভারত ঐতিহাসিকভাবে দ্বীপপুঞ্জটির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। মালদ্বীপের সাথে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ভারতের সম্পৃক্ততা শুধু আর্থ-সামাজিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মাউমুন আবদুল গাইয়ুমের বিরুদ্ধে ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে মালদ্বীপে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ছোট দ্বীপ দেশটির নিরাপত্তা দুর্বলতা প্রকাশ করে। শ্রীলঙ্কার তামিল দেশের জন্যে গণমুক্তি সংস্থার প্রায় ৮০ জন সশস্ত্র ভাড়াটে সৈন্য রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে হামলা চালালে রাষ্ট্রপতি গাইয়ুম অল্পের জন্যে একটি নিরাপদ বাড়িতে পালাতে সক্ষম হন। সেখান থেকে তিনি মিত্রদের কাছ থেকে সামরিক হস্তক্ষেপের অনুরোধ করলে ভারত দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়।
ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা ক্যাকটাস অভিযান নামে একটি মিশন চালিয়ে টানা ২,০০০ কিলোমিটার (১,২৪০ মাইল) উড়ে এসে রাষ্ট্রপতি গাইয়ুমকে উদ্ধার করে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা রাষ্ট্রপতি গাইয়ুমের সরকারের কাছে রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে দেয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর ফ্রিগেটগুলি শ্রীলঙ্কার উপকূলে পালিয়ে যাওয়া ভাড়াটেদের বহনকারী মালবাহী জাহাজটিকে আটক করে। ঘটনাটি দুই দেশের সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করে।
ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে ১৯৮৮ সাল থেকে সহযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা। ভারতীয় সৈন্যরা ২০০৪ সালের সুনামি, ২০১৪ সালের মালে পানীয় জলের সঙ্কট এবং ২০২০ কোভিড-১৯ মহামারীর সময় দ্বীপ দেশটিতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করে মালদ্বীপকে সাহায্য অব্যাহত রেখেছে। উভয় দেশ তাদের প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বকে সুসংহত করতে ২০১৬ সালের এপ্রিলে একটি ‘প্রতিরক্ষার জন্যে ব্যাপক কর্ম পরিকল্পনা’ স্বাক্ষর করে, যা ২০১৯ সালে আরো শক্তিশালী হয়েছে।
ভারত ২০১০ ও ২০১৩ সালে দুটি হেলিকপ্টার মালদ্বীপকে উপহার দেয় এবং ২০২০ সালে ভারতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইইজেড) এবং উদ্ধার প্রচেষ্টায় ভারত ও মালদ্বীপের যৌথ নজরদারি কার্যক্রমের জন্যে একটি ডর্নিয়ার ২২৮ সামুদ্রিক নজরদারি বিমান দিতে চায়। ভারতীয় সংবাদপত্রগুলি জানিয়েছে বিমানটির কাজ আঞ্চলিক জলসীমায় চীনা জাহাজের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ।
মালদ্বীপের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর (এমএনডিএফ) উদ্ধৃতি দিয়ে মালদ্বীপের সংবাদ পোর্টাল আভাসের ২০২১ সালের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে এই তিনটি বিমান পরিচালনার জন্যে ৭৫ জন ভারতীয় সামরিক কর্মী মালদ্বীপে ছিল।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুইজ্জু শপথ নেওয়ার পরে একটি সংবাদ সম্মেলনে ভারতকে মালদ্বীপ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্যে অনুরোধ করে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জননীতি বিষয়ক কনিষ্ঠ মন্ত্রী মোহাম্মদ ফিরুজুল আব্দুল খলিল ৭৭ জন ভারতীয় সামরিক কর্মী এখনো মালদ্বীপে উপস্থিত থাকার কথা নিশ্চিত করেছেন। ফিরুজুল আরো বলেছেন, নতুন সরকার সাবেক রাষ্ট্রপতি সোলিহের আমলে স্বাক্ষরিত ভারতের সাথে ১০০টিরও বেশি চুক্তি পর্যালোচনা করবে।
ভারত কি মালদ্বীপে আস্থা হারাচ্ছে?
এই অগ্রগতির সাথে সাথে কিছু প্রতিবেদন অনুসারে এটি মালদ্বীপে “চীনের প্রভাব মোকাবেলায় ভারতীয় প্রচেষ্টার জন্যে একটি ধাক্কা।” গত এক দশকে বৃহৎ অনেক অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে চীনের সড়ক ও বন্ধনী উদ্যোগের সাথে জড়িত কিছু দেশ – শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো ঋণ সঙ্কটের ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়েছে। ভারত মালদ্বীপকে নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে হেলিকপ্টার ও বিমান ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিতে “কার্যকর সমাধান” খোঁজার চেষ্টা করছে। মুইজু ও ভারতের কেন্দ্রীয় ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রী কিরেন রিজিজু ১৮ নভেম্বর, ২০২৩-এ একটি বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা করেন।
মালদ্বীপের সাংবাদিক আহমেদ আজান টুইট করেছেন:
President @MMuizzu government delivers on its promise: Indian military numbers revealed! Remember when secrecy was tied to food imports from India? 🇮🇳🍳🧅
Did India impose restrictions on essential supplies like eggs, onions, and potatoes to the Maldives? https://t.co/jumDybDXof
— Ahmed Azaan (@axanner) November 19, 2023
রাষ্ট্রপতি @এমমুইজ্জু সরকার তার প্রতিশ্রুতি পালন করেছে: ভারতীয় সামরিক সংখ্যা প্রকাশিত! ভারত থেকে খাদ্য আমদানির গোপনীয়তার কথা মনে আছে? 🇮🇳🍳🧅
ভারত কি মালদ্বীপে ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর মতো প্রয়োজনীয় সরবরাহের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল?
এদিকে উত্তেজনা তুঙ্গে থাকা ভারতে যেমন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় এয়ার ভাইস মার্শাল যশবন্ত সিং কুমারের এই টুইটটি:
India should firmly advise Maldives government regarding security issues for not only Maldives but also India. No Chinese intrusion acceptable We can’t afford to repeat what happened in Sri Lanka Nepal etc
— Jaswant Singh Kumar (@jaswantsk16) November 23, 2023
শুধু মালদ্বীপ নয় ভারতের নিরাপত্তার কারণেও ভারতের মালদ্বীপ সরকারকে দৃঢ়ভাবে পরামর্শ দেওয়া উচিত। কোনো চীনা অনুপ্রবেশ গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা শ্রীলঙ্কা নেপাল ইত্যাদিতে যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি হতে দিতে পারি না
শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহে জোর দিয়েছেন:
“Indian troops leaving was part of manifesto. India shouldn’t get too worried about it. Focus more on strengthening relationship with Maldives. The Maldives needs India’s help,” President Ranil Wickremesinghe asserted.https://t.co/ks4tJNyy1e
— BRISL (@BRI_SL) November 24, 2023
“ভারতীয় সৈন্যদের চলে যাওয়াটা ছিল ইশতেহারের অংশ। এটা নিয়ে ভারতের খুব বেশি চিন্তিত হওয়া উচিত নয়। মালদ্বীপের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার দিকে বেশি মনোযোগ দিন। মালদ্বীপের ভারতের সাহায্য দরকার,” রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহে জোর দিয়ে বলেন।
শিক্ষাবিদ অভিনব মেহরোত্রা ও অমিত উপাধ্যায়ও ভূ-রাজনৈতিক ম্যাগাজিনে লিখেছেন:
চীন-মালদ্বীপ সম্পর্কের বিকাশের ফলে ক্রমবর্ধমান হুমকির জন্যে ভারতকে মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের প্রতি তার কৌশল পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। […]
চীনের উপর মালদ্বীপের ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতার প্রেক্ষিতে এই অঞ্চলের গুরুত্ব বিবেচনা করে মালদ্বীপের সাথে ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ভারতকে সতর্ক হতে এবং তার বৈদেশিক নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।