কয়েক দশকের পুরনো দাগ আর আঘাতের ছায়ায়

ছবি: আরজু গেবুলায়েভা

ফরাসি ভাষায় লে টেম্পসে প্রথম প্রকাশিত আরজু গেবুলায়েভার গল্পটির ইংরেজিতে মূল লেখাটি গ্লোবাল ভয়েসেসে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

আমার দ্বিতীয় বাসস্থানের শহরে মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেও দুই সাংবাদিক বন্ধুসহ আমি গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ সম্পর্কে উত্তপ্ত আলোচনায় নিমগ্ন। লোকজনে জায়গাটি গমগম করছে, পটভূমিতে বাজছে মৃদু জ্যাজের তাল। শুধু আমাদের টেবিলেই আর্মেনিয়া, জর্জিয়া ও আজারবাইজান থেকে আঞ্চলিক সাংবাদিক হিসেবে আসা আমরা যা ঘটছে তা বুঝতে এবং আমাদের জীবদ্দশায় কভার করা প্রচুর যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে সাম্প্রতিক অতীতের সমান্তরাল আঁকতে চেষ্টা করছি।

দুই ঘন্টা ধরে বিপর্যস্ত আমরা দু'জন এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে – ক্ষমতা বঞ্চিতদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে থাকা ক্ষমতাবান কিছু লোকের পরিচালিত বিশ্বব্যবস্থাটিই দেখতে পাচ্ছি। জবাবদিহিতা ও মানুষের জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ ভ্রূক্ষেপহীন নেতৃ্ত্বের আছে শুধু “ইজম” ও অজুহাত।

আমাদের তৃতীয় বন্ধু তবুও বলে — আমাদের নিছক অস্তিত্ব ও আমাদের বড় কিছু দেখার ক্ষমতা এখনো ভাল থাকাটা  একটি ভাল ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমাদের মধ্যে সর্বোপরি পরস্পরকে বোঝার ক্ষমতা, নম্রতা ও সমবেদনা রয়েছে।

একটি সাধারণ বিশ্বে – এখন এর মানে আপনি যাই বুঝুন না কেন – এই গুণগুলি গর্ব করার মতো বৈশিষ্ট্য হলেও বর্তমানে পৃথিবীতে এগুলিকে একটি বোঝার মতো মনে হয়। কারণ, এই পৃথিবীতে, আপনি “অন্যদেরকে” অমানবিক না করে থাকলে আপনি আপনার শেকড়ের যোগ্য নন, বরং একজন বিশ্বাসঘাতক।

তাহলে পরোয়া করছেন কেন? ভুল তথ্যে নিমজ্জিত কেউ যখন শুনতে চায় না আর ক্ষমতালিপ্সু নেতৃত্ব যখন নিয়ন্ত্রণে, তখন কারো কাছে কিছু প্রমাণের দরকারই বা কি?

এই উন্মাদনার গভীর ক্ষত ও কয়েক দশকের আঘাত কি নিরাময়যোগ্য?

আমি গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের কভারেজ দেখা, পড়া আর শোনার সময় এই প্রশ্নটি ভাবতে থাকি প্রসঙ্গ ও ইতিহাসকে উপেক্ষা করে অনুপাতের এমন অমানবিককরণের মাধ্যমে বিশ্বকে “আমাদের বনাম তাদের” আরেকটি আখ্যানে বিভক্ত করা হয়েছে, যা বিশ্ব আগে কখনো দেখেনি।

তাহলে কি আমরা কখনো সেরে উঠবো? খোলাখুলি বললে আমরা সেরে উঠবো না। ১৫ বছর আগে প্রথমবার দ্বন্দ্ব রূপান্তর ও সমঝোতার কাজে জড়িত হওয়ার সময় কেউ আমাকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করলে আমি বলতাম, হ্যাঁ, আশা আছে। কিন্তু আমার শিকড়ের দিকে ফিরে দেখি কীভাবে আমার দেশের সরকার সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষত সারাতে ব্যর্থ হয়ে সহিংসতা, ঘৃণাপোষণ ও যুদ্ধ বেছে নিয়েছে বলে মনে হয় এর নিরাময় হবে না। আমরা ৩০ বছরে পারিনি এবং এবারেও পারবো না।

আশাহীন হলেও এটাই সত্য।

প্রথম কারাবাখ যুদ্ধে আজারবাইজানের পরাজয়ের পর বাস্তুচ্যুতি, যুদ্ধাপরাধ ও নৃশংসতার জন্যে প্রতিশোধই একমাত্র উত্তর ভেবে ভেবে কয়েক প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে।

সেই প্রতিশোধ এসেছে ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর  দ্বিতীয় কারাবাখ যুদ্ধের মাধ্যমে।

সেই সময়ে একটি ব্যক্তিগত নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম, “আমরা যুদ্ধের একটি প্রজন্ম, যারা যুদ্ধের বাগাড়ম্বর, ক্ষোভ, হতাশা এবং এই যুদ্ধ কখন শেষ হবে – এমন একটি উন্মুক্ত প্রশ্নে বড় হয়েছি। কয়েক দশক ধরে উভয় রাজনৈতিক পক্ষগুলিকে আমরা নিজেদের লাভের জন্যে এই সংঘাতকে ব্যবহার ও অপব্যবহার করতে দেখেছি। আমরা আজারবাইজানে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত আজারবাইজানিদের অবনমিত ও অমানবিক পরিস্থিতিতে বসবাস করতে বাধ্য হতে দেখেছি। সমাধান খোঁজা নেতারা আলোচনায় ব্যবহারের জন্যে দর কষাকষির একটি গুটি হারাবে এই কারণে তাদের একটি ভাল জীবন দেওয়া হয়নি। প্রতি বছর ক্ষমতায় সেসব নেতারা আরো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই নেতারা বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও কখনোই তা পূরণ করতে পারেনি।”

অবশেষে ২০২০ সালে ৪৪ দিনের যুদ্ধের সময় তারা হাজার হাজার সৈন্যের লাশের ব্যাগসহ ভূমি ফেরতের প্রতিশ্রুতি দেয়।

দ্বিতীয় কারাবাখ যুদ্ধের কোনো এক সময় যুদ্ধের প্রতিবেদনরত সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল দলের সাথে কাজ করতে গিয়ে আমি মানুষের ক্ষতি ও জীবনের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলার চেষ্টা ছেড়ে দিই। ক্রিস হেজেসের সাথে একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে নরম্যান ফিঙ্কেলস্টেইনের ভাষায়, “এটি অর্থ ও উদ্দেশ্যহীন বলে মনে হয়।” আমি যুদ্ধ, সমাজের উপর এর প্রভাব এবং এর ফেলে যাওয়া নৈতিক ধ্বংস সম্পর্কে লেখা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলাম।

জনগণ ভেবেছিল সম্ভবত এই শেষবার প্রিয়জনরা যুদ্ধে যাচ্ছে। হায়, তা আর হয়নি। দৃশ্যপটে কোনো শান্তি চুক্তি না থাকায় সহাবস্থানের ফাঁপা প্রতিশ্রুতি ও নিরর্থক কূটনৈতিক বৈঠকের কারণে আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়। এরপর আসে লাচিন করিডোর অবরোধতথাকথিত পরিবেশবাদীদের একটি দলের নয় মাসব্যাপী দখল। ধীরে ধীরে কারাবাখের আর্মেনিয়ানরা প্রয়োজনীয় চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে বিশ্বের চোখের সামনে ঘটে এই মানবিক সংকট। আর ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩-এ কারাবাখে ২৪ ঘন্টার ব্লিৎজক্রিগ অভিযানে তিন দশক ধরে চলা একটি সংঘাতের অবস্থা পরিবর্তন ঘটে।

একসময়ের উল্লিখিত নাগর্নো-কারাবাখ আর নেই। আজারবাইজান সরকারকে বিশ্বাস করতে না পেরে কারাবাখের ১,২০,০০০ আর্মেনীয়দের প্রায় সবাই পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম যুদ্ধের হাজার হাজার আজারবাইজানি বাড়ি ছেড়ে পালানোর সময় তরুণ হলেও এবার আমি একইরকম পলায়ন দেখেছি।

আমরা জীবনে অনপনেয় দাগ রেখে যাওয়া যুদ্ধের ছায়ায় বসবাসকারী একটি প্রজন্ম। আমাদের জীবদ্দশায় আমরা সেরে উঠবো না। কারণ কিছুই বদলায়নি।

আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার জনগণের বিশ্বাস পরিবর্তন করতে ত্রিশ বছরে কিছুই হয়নি।

জন স্টেইনবেক একবার বলেছিলেন, “সকল যুদ্ধই চিন্তাশীল প্রাণী হিসেবে মানুষের ব্যর্থতার লক্ষণ।” সিদ্ধান্ত গ্রহণের আসনে বসে থাকা আজকের বিশ্বব্যবস্থার চিন্তাশীল প্রাণীর জন্যে বিশেষ করে অন্য পক্ষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বিবেচনায় আগের চেয়ে বেশি শক্তি ও সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত সহজ।

আজারবাইজানীয় বা আর্মেনীয় কেউই এর মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। একইভাবে তারা সম্ভবত একদিন পরিবর্তন হলেও প্রজন্মান্তর ধরে চলমান পরস্পরের প্রতি শত্রুতা ও ঘৃণা নিয়ে বেড়ে উঠতে, বেঁচে থাকতে ও বৃদ্ধ হতে পারে না।

আমি প্রায়ই আমাদের মতো দেশের জন্যে একটি ভিন্ন দৃশ্যকল্প খুঁজে বেড়াই যেখানে শান্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, প্রকৃত আন্তর্জাতিক সমর্থনসহ জটিল ভৌগলিক, আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে বিচরণ করা ক্ষমতা দখলের চেয়ে জনগণের বিশ্বাসকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া শক্তিশালী নেতৃবৃন্দ রয়েছে। সেই ইচ্ছামাফিক চিন্তা বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমি বুঝতে পেরেছি একটি ভাল ভবিষ্যত চাওয়া ও আমাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া ক্ষমতায় থাকা লোকদের মধ্যে পার্থক্য হলো আমরা অতীতের ভূতদের আমাদের যন্ত্রণা দিতে দিলেও তারা তা করে না। তবে কয়েক দশকের পুরনো দাগ ও আঘাতের ছায়ায় অতীতের যন্ত্রণা নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .