বিপদসঙ্কুল মধ্যএশীয়দের আমেরিকার স্বপ্নের পথ

কিরগিজ অভিবাসী আসান বাগিশেভ যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে মেক্সিকীয় শহর তিজুয়ানায় তাদের সংগ্রামের একটি গল্প ভাগাভাগি করছেন।আজাত্তিক ইউটিউব চ্যানেল থেকে নেওয়া পর্দাছবি। ন্যায্য ব্যবহার।

রেডিও মুক্ত ইউরোপ/ রেডিও লিবার্টির কিরগিজ শাখা, রেডিও আজাত্তিক ৪ সেপ্টেম্বর লাতিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্য এশীয়দের অভিবাসন সম্পর্কে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে। সাংবাদিকদের একটি দল কাজাখস্তান ২০২৩ সালের গ্রীষ্মে কিরগিজস্তান ও উজবেকিস্তানের একদল লোকের পিছু নিয়ে মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের স্বপ্ন পূরণের পুরো বিপজ্জনক যাত্রাটি অন্বেষণ করে। তথ্যচিত্রটি কেন লোকেরা তাদের নিজ দেশ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা কোন পথ অনুসরণ করে এবং ভ্রমণের সময় তাদের মুখোমুখি হওয়া অসুবিধা ও বিপদ ব্যাখ্যা করে। কতোজন মধ্য এশীয় যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে তার সঠিক তথ্য না থাকলেও এটি স্পষ্ট যে তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

এখানে মধ্যেশীয়দের লাতিন আমেরিকা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন সম্পর্কে তথ্যচিত্র রয়েছে।

মধ্য আমেরিকা ও মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে

মধ্যএশীয়রা চার-পাঁচ বছর আগে লাতিন আমেরিকা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে শুরু করে। তারপর থেকে তাদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে এবং ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়া মধ্যএশিয়ার কয়েক লক্ষ অভিবাসী শ্রমিকের আবাসস্থল, যাদের অনেকেই আমলাতন্ত্র ও বৈষম্য এড়াতে রাশিয়ার নাগরিকত্ব অর্জন করে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রুশ কর্তৃপক্ষ যুদ্ধের জন্যে মধ্যএশীয়দের নিয়োগ করতে শুরু করে।

যুদ্ধের কারণে সামরিক সমাবেশ ও অন্যান্য ধরনের রাজনৈতিক দমন-পীড়নের হুমকির কথা উল্লেখ করে অনেক রুশ, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চেয়েছে। যারা মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন তারা তাদের সামাজিক গণমাধ্যম অ্যাকাউন্টে তাদের ভ্রমণের নথিভুক্ত করেছে। মধ্যএশীয়রা রুশ পাসপোর্টসহ যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী মর্যাদা খুঁজছে। তথ্যচিত্রটিতে শিকাগোর একজন নামহীন কিরগিজ অভিবাসী কীভাবে তিনি শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছিলেন তা ভাগাভাগি করেছেন। আগে একটি রুশ পাসপোর্ট নিয়ে তিনি মস্কোতে থাকতেন।

রুশ নাগরিকত্ব মধ্যএশীয়দের একটি শক্তিশালী কেস ফাইল ছাড়া আরো কিছু প্রদান করে। রাশিয়া ও মেক্সিকোতে ভিসা-মুক্ত ব্যবস্থা থাকায় তারা তৃতীয় কোন দেশের ব্যবহার ছাড়াই রুশ পাসপোর্টসহ সরাসরি মেক্সিকোতে আসতে পারে। রুশ পাসপোর্ট প্রদত্ত এই লজিস্টিক এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য মধ্যএশীয়দের মধ্যে এর চাহিদা বাড়িয়েছে। সাংবাদিকরা ৩,০০০ ডলারে বিনিময়ে একটি জাল রুশ পাসপোর্টের প্রতিশ্রুতি দেওয়া ইস্তাম্বুলের একজনের সাথে যোগাযোগ করে। এই পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন মেক্সিকীয় কর্তৃপক্ষ জাল রুশ পাসপোর্ট নিয়ে দেশে প্রবেশের চেষ্টা করা বেশ কয়েকজন উজবেকিস্তানিকে প্রত্যাবাসিত করেছে।

রুশ পাসপোর্ট মধ্যএশিয়ার পাঁচটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া দীর্ঘ, আরো বিপজ্জনক এবং আরো ব্যয়বহুল। ভিসা ছাড়া প্রবেশ সুবিধার জন্যে তারা ইস্তাম্বুল, তারপর মাদ্রিদ ও বোগোটা (কলোম্বিয়া) হয়ে পানামা বা মানাগুয়া (নিকারাগুয়া) যান। যাত্রার পরবর্তী পথটি পায়ে, নৌকায় ও গাড়িতে চলতে থাকে এবং হন্ডুরাস ও গুয়াতেমালা পেরিয়ে মেক্সিকীয় শহর তাপাচুলাতে তাদের পাচার করা হয়।

এই পথে ভ্রমণের বিপদের মধ্যে রয়েছে অন্তর্বর্তী দেশগুলিতে গোষ্ঠীগুলির হাতে ছিনতাই বা জিম্মি, বন্যপ্রাণী আক্রান্ত হওয়া এবং ক্যারিবীয় সাগরে ডুবে যাওয়া। তথ্যচিত্রটিতে একজন কাজাখ অভিবাসী সমুদ্র পেরুনোর সময় রাতে ডুবে যাওয়া তিনজনের একটি কিরগিজ পরিবারের একটি দুঃখজনক গল্প ভাগাভাগি করেছেন। দামির নামে একজন কিরগিজ অভিবাসী তার পাচারকারীর কাছে একদিনের জন্যে জিম্মি হওয়ার গল্প ভাগাভাগি করেছেন। তার বন্ধুরা ১,০০০ ডলার মুক্তিপণ দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনে। যারা তার মতো যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে চান তাদের প্রতি তার পরামর্শ হলো: “দু’বার ভাবুন।”

একইধরনের অনুভূতি ব্যক্ত করেন বেশ কয়েকমাস ধরে মেক্সিকীয় শহর রেনোসাতে বসবাসকারী ৭০ বছর বয়সী উজবেক অভিবাসী রাখিম বাবাজানভ। টাকা ও, থাকার জায়গা না থাকা স্বত্ত্বেও কান্না চাপানোর চেষ্টা করে তিনি বলেন: “আমি আমার জন্যে কী অপেক্ষা করছে জানলে, তারা আমাকে সোনা দিলেও আমি আসতাম না।”

একটি সাক্ষাৎকার অথবা সীমান্ত পেরুনোর জন্যে অপেক্ষা

মেক্সিকোতে পৌঁছে মধ্যএশিয়ার অভিবাসীদের কাছে দুটি বিকল্প থাকে। প্রথমত শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে ইচ্ছুকদের ব্যবহৃত সিবিপি১ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে নিবন্ধন করা এবং মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তের একটি চেক পয়েন্টে তাদের সাক্ষাৎকারের জন্যে কয়েক মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করা। মার্কিন সীমান্তের কাছে রেইনোসাতে তাদের সাক্ষাৎকারের জন্যে অপেক্ষারত উজবেকিস্তান থেকে আসা বেশ কিছু অভিবাসী সাংবাদিকদের সাথে দেখা করার সময় তাদের চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি এবং অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ায় রাস্তায় বসবাস করার হতাশা প্রকাশ করে।

দ্বিতীয় বিকল্পটি অভিবাসীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে প্রবেশ করতে সহায়তাকারী কয়োটদের সাহায্যে সীমান্ত অতিক্রম করা। শরণার্থী মর্যাদা প্রাপ্তির জন্যে অস্পষ্টতা ও দীর্ঘ অপেক্ষায় কালক্ষেপনের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এই বিকল্পটি এখনো মধ্যএশীয়দের মধ্যে জনপ্রিয়। এর সবচেয়ে বড় নেতিবাচক দিক হলো প্রত্যাবাসন ও পরবর্তী পাঁচ বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি।

তথ্যচিত্রটিতে প্রাচীর টপকে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকারী উজবুক অভিবাসী মার্কিন ভিসার জন্যে নয়বার আবেদন করার কথা বলেছেন। অন্যান্য অনেকেরই মার্কিন ভিসা আবেদনে বেশ কয়েকটি প্রত্যাখ্যানের একইরকম গল্প রয়েছে। এই পদ্ধতিটি বেছে নেওয়া অন্য একজন উজবুক অভিবাসী জানিয়েছেন ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সকল মধ্যএশিয়াদের ৯০ শতাংশই অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করলেও তাদের সব প্রচেষ্টা সফল হয় না। মেক্সিকো থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় চারজন উজবুক নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়

রুশ পাসপোর্টধারীদের তুলনায় নিজ দেশে একই ধরনের রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মুখোমুখি হতে না পারা মধ্যএশিয়ার নাগরিকদের মামলার ফাইলও দুর্বল। প্রকৃতপক্ষে, তথ্যচিত্রটিতে শুধু একজন অভিবাসী (কাজাখস্তানের) তার নিজের দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্যে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কথা উল্লেখ করেছেন। বেশ কিছু উজবুক অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী হতে চাওয়ার কারণ হিসেবে উজবেকিস্তানে সমকামিতার অপরাধমূলক বিচারকে উদ্ধৃত করেছে।

নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্যান্যরা যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার মাধ্যমে ধনী হওয়ার ও তাদের সন্তানদের উন্নত জীবনের সুযোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখে। একজন উজবুক রাজনৈতিক শরণার্থী তথ্যচিত্রতে বলেছেন মধ্যএশিয়ার অনেক অভিবাসী আশ্রয় প্রার্থনা করার সময় মার্কিন সীমান্ত কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করার জন্যে তাদের মামলার ফাইল কিনে নেয়। এই কেস ফাইলগুলির দাম ২,০০০ ডলার এবং একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা যায়।

তথ্যচিত্রের বিশেষজ্ঞরা একমত এই অভিবাসন সংকটের সমাধান হলো মধ্যএশিয়ার দেশগুলিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রদেয় সরকারি শ্রম কোটা। তবে এই ধরনের বিষয়গুলি এই অঞ্চল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতার আলোচ্যতে অনুপস্থিত। আরেকটি সম্ভাব্য সমাধান হলো ট্রানজিট দেশগুলিতে কূটনৈতিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করা। কিরগিজস্তান বর্তমানে মেক্সিকোতে একটি দূতাবাস খোলার কথা ভাবছে।

মেক্সিকোতে কিরগিজ দূতাবাস খোলার বিষয়ে চলমান আলোচনার বিষয়ে একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রস্থ কিরগিজস্তানের রাষ্ট্রদূত।

এটা স্পষ্ট যে বিদ্যমান ঝুঁকি ও হুমকি, এমনকি সম্ভাব্য মৃত্যুও এই অভিবাসন কমাতে সক্ষম নয়। আসা এবং দেশে ফিরে যাওয়ার পরে কারো কারো মোহভঙ্গ হলেও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া মধ্যএশীয়দের অনেকের একটি চূড়ান্ত ও আদর্শ স্বপ্ন হিসেবে রয়ে গেছে। তথ্যচিত্রটিতে পরিষ্কার সেটাই দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত মধ্যএশীয়দের আরো ভাল সিদ্ধান্ত নিতে ও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার বিষয়ে বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা নির্ধারণ করতে সাহায্য করার জন্যে এই ধরনের আরো উদ্যোগের প্রয়োজন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .