অপসৃয়মান তারকাচিহ্ন: কসোভোর প্রতি ইইউ’র দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন

কসোভোর প্রাক্তন মুখ্য আলোচক এদিতা তাহিরির উদ্ধৃতির কার্টুন ভাষ্য, যে তারকাচিহ্নটি তুষারকণার মতো গলে যাবে। আর্টিস্ট/এসবাংকার চিত্রিত, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

গ্লোবাল ভয়েসেস মূলত এসবাংকার প্রকাশিত মিলোস পাভকোভিচের এই গল্পটির একটি সম্পাদিত সংস্করণ অনুমতি নিয়ে পুনরায় প্রকাশ করেছে।

কসোভোর ২০০৮ সালে স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আইনি অবস্থান অস্পষ্ট। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপীয় দেশটি শুধু আংশিকভাবে স্বীকৃত ও জাতিসংঘের মতো বিশিষ্ট আন্তঃসরকারি সংস্থার সদস্য নয়।

তাছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পাঁচটি সদস্য রাষ্ট্র (সাইপ্রাস, গ্রীস, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও স্পেন) একে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে কসোভোর সাথে ইইউ’র আচরণে এর প্রভাব পড়েছে।

আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব চুক্তি ২০১২ সালে গৃহীত হওয়ার পর থেকে, ইইউ সহায়তাকৃত বেলগ্রেড-প্রিস্টিনা সংলাপ কাঠামোর অধীনে সকল ইইউ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা চুক্তির অংশ হিসেবে ধারাবাহিকভাবে পাদটীকাসহ একটি তারকাচিহ্ন কসোভোকে উল্লেখ করেছে।

পাদটীকায় বলা হয়েছে:

“অবস্থান নির্বিশেষে এই উপাধিটি ইউএনএসসিআর ১২৪৪/১৯৯৯ এবং কসোভোর স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে আইসিজের মতামতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।”

কসোভোতে ১৯৯৮-১৯৯৯ যুদ্ধের পরে জাতিসংঘের ১৯৯৯ সালের ১০ জুনের প্রস্তাব ১২৪৪/১৯৯৯ একটি আন্তর্জাতিক বেসামরিক ও সামরিক উপস্থিতির অনুমোদনসহ কসোভোতে জাতিসংঘের মিশন (ইউএনএমআইকে) প্রতিষ্ঠা করে যা ক্ষুদ্রতর ভূমিকায় হলেও এখন পর্যন্ত কর্মরত।

আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের (আইসিজে) উপদেষ্টা মতামত জানিয়েছে কসোভোর স্বাধীনতার একতরফা ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে না। তবে আদালত সার্বিয়া থেকে কসোভোর বিচ্ছিন্নতার বৈধতা সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো উত্তর প্রদান না করায় তা এর স্বাধীনতাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে।

প্রাথমিকভাবে ২০১২ সালে সম্মত চর্চাটি কসোভোর এখন অপছন্দ সত্ত্বেও নথি লেখার ক্ষেত্রে তারকাচিহ্ন/ পাদটীকার ব্যবহারে উদ্ভূত জটিলতা সত্ত্বেও ওয়েবসাইট তৈরি ও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ইইউ এই নীতি চালিয়ে যাচ্ছে।

আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব চুক্তি (২০১২) স্বাক্ষরের মুহুর্তে কসোভোর প্রাক্তন প্রধান আলোচক এদিতা তাহিরি বলেছিলেন তারকাচিহ্নটি তুষারকণার মতো গলে যাবে:

“Ajo fusnotë është si fjollë bore, do të shkrihet me kalimin e dimrit.”

“এই পাদটীকাটি একটি তুষারকণার মতো, শীত পেরুলে গলে যাবে।”

ইইউ প্রতিষ্ঠানগুলি কসোভোকে উল্লেখ করার সময় ২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। আনুষ্ঠানিক নীতি হলেও তারা নথি ও সভায় পাদটীকা/ তারকাচিহ্ন ব্যবহার থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। কসোভো ও সার্বিয়ার মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের পথে সর্বশেষ ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তাদের সম্মত চুক্তি এবং এর বাস্তবায়ন সংযুক্তি এই পদ্ধতিতে একটি আনুষ্ঠানিক পরিবর্তন চিহ্নিত করতে পারে। ইইউ’র আনুষ্ঠানিক অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও কোনো নথিতেই কসোভোকে তারকাচিহ্ন/ পাদটীকাসহ নির্দেশ করা হয়নি।

ইউরোপীয় সংসদ আর পাদটীকা/তারকাচিহ্ন দিয়ে কসোভোকে উল্লেখ করে না

ইউরোপীয় সংসদ (ইপি) তারকাচিহ্নসহ কসোভোকে উল্লেখ বন্ধ করা প্রথম ইইউ প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ব্যবহারের পরে ২০১৫ সালে একটি ইপি সিদ্ধান্তে কোনো তারকাচিহ্ন/ পাদটীকা ছাড়া কসোভোকে উল্লেখ করায় তা প্রথম স্পষ্ট হয়৷ ইপি’র প্রায় সকল নথিতে ২০১৫ সালে কসোভোকে তারকাচিহ্ন/ পাদটীকা ছাড়া উল্লেখ করা হলেও মনে রাখা দরকার ইপির সিদ্ধান্তগুলি আইনত বাধ্যতামূলক নয় এবং সংস্থাটি সাধারণত ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) তুলনায় বিভিন্ন বিষয়ে আরো উদারপন্থী। সুতরাং পদ্ধতির এই পরিবর্তনটি আশ্চর্যের কিছু নয়।

উপরন্তু ইপি কসোভোর রাষ্ট্রপতি ভিয়োসা ওসমানিকে ২০২৩ সালের জুনে পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার আহ্বান জানালে তিনি ইপিতে বক্তৃতা দেওয়া প্রথম কসোভো কর্মকর্তা হন। তার অধিভুক্তি তারকাচিহ্ন/ পাদটীকা ছাড়াই উল্লেখ করা হয়।

আনুষ্ঠানিকভাবে কসোভোর অবস্থানের বিষয়ে নিরপেক্ষতার নীতি পরিত্যাগ করায় ইপি’র অবস্থান কমিশনের থেকে আলাদা। সর্বশেষ প্রতিবেদনে ইপি পুনরায় নিশ্চিত করেছে স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াটি পারস্পরিক স্বীকৃতিকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত।

কসোভোর উল্লেখে ইউরোপীয় কমিশনের অসঙ্গতি

ইপি’র বিপরীতে ২০১২ সালের আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব চুক্তির নির্দেশিকা অনুসরণ করার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় কমিশনের একটি কঠোর পন্থা ছিল। কসোভো সম্পর্কে ২০১৫ সালে তার প্রাথমিক প্রতিবেদনের পর থেকে, ইসি তার ওয়েবসাইটে ও অর্থায়নকৃত প্রকল্পগুলিতে কসোভোর উল্লেখের সময় ধারাবাহিকভাবে ২০১২ চুক্তির বিধানগুলি মেনে চলছে।

উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম বলকানগুলির জন্যে ইইউ আঞ্চলিক যোগাযোগ কর্মসুচি ধারাবাহিকভাবে তারকাচিহ্ন/ পাদটীকা নীতি প্রয়োগ করে। ইইউ ও আঞ্চলিক সহযোগিতা পরিষদ (আরসিসি) সমর্থিত সাধারণ আঞ্চলিক বাজার উদ্যোগের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। উপরন্তু, কসোভোতে ইইউ দপ্তরের আনুষ্ঠানিক ওয়েবসাইটে একটি তারকাচিহ্ন এবং পাদটীকাও রয়েছে।

তবে মাঝে মাঝে কিছু কমিটি ও সংস্থায় অসঙ্গতি দেখা যেতে পারে।

পদ্ধতির পরিবর্তন হচ্ছে

বিভিন্ন ইসি সংস্থার কাজে অংশগ্রহণের জন্যে কসোভোকে অসংখ্য অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই সংস্থাগুলি সর্বজনীনভাবে পাওয়া সভার কার্য-বিবরণী বা সরবরাহকৃত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কসোভোকে পাদটীকা/ তারকাচিহ্ন ছাড়াই উল্লেখ করা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, একই আকাশ কমিটির ৮৫তম সভায় কসোভো অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সমানভাবে অংশগ্রহণ করে। ইউরোপের দিগন্ত কর্মসুচি কমিটির ১০ম সভায় একই ঘটনা ঘটে। ইউরোপের দিগন্তের একটি সভায় কসোভোকে সার্বীয় সিরিলিক ভাষায় “Република Косово” (কসোভো প্রজাতন্ত্র) হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যা এর বহুজাতিক চরিত্রের স্বীকৃতি এবং বাস্তবে দেশটিতে সার্বীয় ও আলবেনীয় এই দুটি সরকারি ভাষা রয়েছে। স্থানীয় বলে প্রথমটি ৯৩ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা এবং দ্বিতীয়টি সংখ্যালঘু ২ শতাংশ নাগরিকের ভাষা। এই দৃষ্টান্তগুলিতে যা সাধারণ তা হলো তারকাচিহ্ন/ পাদটীকা ব্যবহার করা হয়নি।

অন্যদিকে, কাস্টমস কর্মসুচি কমিটিতে কসোভোর অংশগ্রহণ আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব চুক্তি (২০১১) এর মান মেনে চলে।

কসোভো তিনটি ইইউ সংস্থায় অংশগ্রহণ করে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক ইউরোপীয় সংস্থা (ইইউ -ওএসএইচএ)  কসোভোর প্রতি অন্যান্য পশ্চিম বলকান প্রার্থীদের মতোই আচরণ করে। একই কথা কসোভোকে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির মতো উল্লেখ করা জীবন ও কর্ম পরিবেশ উন্নয়নের ইউরোপীয় ফাউন্ডেশনের (ইউরোফাউন্ড) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বিপরীতক্রমে, ইউরোপীয় ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রকের (বিইআরইসি) সাথে কসোভোর জড়িত থাকার কারণে এই সংস্থায় কসোভোর অংশগ্রহণ অস্বীকারের জন্যে স্পেনে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই সংস্থায় কসোভোর সদস্যপদকে ঘিরে বিতর্কের কারণে, তারকাচিহ্ন/ পাদটীকাটির উপস্থিতি অবাক হওয়ার কিছু নয়।

ইইউ প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, কমিটি এবং সংস্থাগুলির আনুষ্ঠানিক ক্ষমতায় কসোভোর উল্লেখে অভিন্নতার লক্ষণীয় অভাব থাকলেও তারকাচিহ্ন ও পাদটীকা ধীরে ধীরে বিবর্ণ হওয়া সূক্ষ্মভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এই প্রবণতা সভাপতিত্বকারী কমিটি, সারাংশ প্রতিবেদনের খসড়া ও সভার কার্যবিবরণী নথিবদ্ধ করা কর্মীদের মাধ্যমে প্রভাবিত বলে মনে হয়।

এসব ঘটতে থাকায় এদিতা তাহিরির “তারকাটি তুষারকণার মতো গলে যাবে” ভবিষ্যদ্বাণীটি ক্রমেই সঠিক প্রতীয়মান হচ্ছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .