আজকের তুরস্কে দশ লক্ষ লিরা জেতা খুব বেশি অর্জন না হলেও তা উদযাপন করার মতো

ছবি: আরজু গেবুলায়েভা

রাবিয়া বিরসেন গুভারচিন (২৪) ১১ সেপ্টেম্বর “কে কোটিপতি হতে চায়?” তুরস্কের জনপ্রিয় প্রশ্নভিত্তিক গেম শোতে ১০ লক্ষ তুর্কি লিরা (প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা) জেতার পরে ইতিহাসে নাম লেখান। তুর্কি টেলিভিশনে ২০১১ সালে শোটির প্রথম প্রদর্শনীর সময় এই পরিমাণটি অনেক হলেও ২০২৩ সালে জীবনযাত্রার বর্ধিত ব্যয়, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং ২০ শতাংশ কর কর্তনের পর খুব বেশি নয়।

গত কয়েক বছর ধরে ক্রমবর্ধমান খাদ্য ও জ্বালানী খরচ এবং বছরের শেষে আনুমানিক ৬৫ শতাংশে পৌঁছানো মূল্যস্ফীতি তুরস্ককে অর্থনৈতিক পতনের দিকে নিয়ে গেছে। সংক্ষেপে, বারো বছর আগে খেলাটি জিতলে গুভারচিনের ক্রয় ক্ষমতা অনেক বেশি হতো।

রাবিয়া বিরসেন গুভারচিন “কে হতে চায় কোটিপতি” জিতেছেন।

➤ প্রথমবারের মতো ২০১১ সালে শোটি প্রচারের সময় ইস্তাম্বুলে ৬টি ফ্ল্যাট কেনা যেতো।

➤ আজ ইস্তাম্বুলে একটি ফ্ল্যাট কিনতে একজনকে খেলাটি চারবার জিততে হবে।

ডিকেন সংবাদপত্রের ভাগাভাগি করা ভিডিওতে তারা উল্লেখ করে ২০১১ সালে ১০ লক্ষ তুর্কি লিরা প্রায় ৬.৪৮ কোটি টাকা হলেও ২০২৩ সালে সেই একই পরিমাণ ৪০ লক্ষ টাকার কিছু বেশি। ২০১৯ সালে শেষবার প্রশ্নের খেলাটি জিতে ১০ লক্ষ তুর্কি লিরার সমমান প্রায় ১.৯২ কোটি টাকা পাওয়া যায়।

আরেকটি অনলাইন সংবাদ মঞ্চ ফেইন স্টুডিও গাড়ি দিয়ে পুরস্কারের ক্রয়ক্ষমতার তুলনা করেছে। মঞ্চটি অনুসারে, প্রতিযোগিতার একজন বিজয়ী ২০১১ সালে ৩টি ফেরারি কিনতে পারলেও ২০২৩ সালে সেই অর্থ শুধু একটি নতুন ফিয়াট ইজিয়া বা একটি ব্যবহৃত ২০২২ সুজুকি সুইফট কিনতে পারবে৷

জয়ের পরপরই প্রদর্শনীটি নতুন মরসুমে পুরস্কারের পরিমাণ ১০ লক্ষ তুর্কি লিরা থেকে ৫০ লক্ষ তুর্কি লিরা (প্রায় ২.০৪ কোটি টাকা) করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে

তুরস্কের আর্থিক অবনতি

তুরস্কের পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, তুরস্কের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বর্তমানে দারিদ্র্য বা সামাজিক বর্জনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ইউরোনিউজের সাথে কথা বলার সময় দেশের বৃহত্তম বিরোধীদল প্রজাতান্ত্রিক জনদলের (সিএইচপি) দারিদ্র্য সংহতি দপ্তর সমন্বয়কারী হাজার ফোগো বলেছেন, “আমি ২২ বছর ধরে দারিদ্র্য নিয়ে কাজ করলেও কখনো এতো খারাপ পরিস্থিতি দেখিনি।”

মে মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের আগে তুরস্কের অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, দুই অঙ্কের বেকারত্ব, মুদ্রা সংকট ও জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নির্বাচনের আগে জনসমর্থন জোগাড় করতে ক্ষমতাসীন দল “জ্বালানি ভর্তুকি, ন্যূনতম মজুরি দ্বিগুণ করা ও ২০ লক্ষেরও বেশি তুর্কিকে তাৎক্ষণিক অবসরের অনুমতিসহ বার্ষিক বাজেটের প্রায় ১.৪ শতাংশের মতো রেকর্ড পরিমাণ সামাজিক সহায়তা ব্যয় করেছে,“ জানিয়েছে রয়টার্স। কিন্তু সুদের হার সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের অপ্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির মতোই এই ধরনের গণভর্তুকির অস্থায়ী সমাধান রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চাপ সৃষ্টি করবে মাত্র। সেই সময়ে এফটি প্রতিবেদন অনুসারে, তুরস্কের গগনচুম্বী মুদ্রাস্ফীতি “গ্রীষ্মের বেতন বৃদ্ধি হজম করে ফেলবে।”

এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত। তুর্কি শ্রমিক ইউনিয়নের কনফেডারেশন (তুর্ক-ইস) এর জুলাইয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, চারজনের একটি পরিবারের খাদ্যব্যয় ন্যূনতম মজুরি ছাড়িয়ে গেছে

সাধারণ নির্বাচনের পরে এরদোয়ান একটি নতুন মন্ত্রিসভা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান নিয়োগ করলে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলার জন্যে জুন মাসে দেশটি সুদের হারে উল্টোচলা শুরু করে। তারপর থেকে জাতীয় মুদ্রা “মূলত এই অবমূল্যায়নের কারণে ২৫ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে এবং বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি গত মাসে ৫৯ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছায়,” রয়টার্স জানিয়েছে

ব্লুবে সম্পদ ব্যবস্থাপনার উদীয়মান বাজার বিশেষজ্ঞ টিমোথি অ্যাশের মতে, একটি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি ফিচ রেটিংস , তুরস্কের রেটিং নেতিবাচক থেকে স্থিতিশীল করার পরেও অর্থনৈতিক দৃশ্যপট চ্যালেঞ্জপূর্ণ রয়ে গেছে।

একইভাবে বৈদেশিক নীতির সাথে একটি সাক্ষাৎকারে স্বাধীন অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা সোনমেজ বলেছেন সরকারি যুক্তির পরিবর্তন জনগণের উদ্বেগ কমাতে পারেনি। “অনেক পরিবারের আয় মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় অপর্যাপ্ত — দরিদ্রতা এখন আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যার একটি। আমরা অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতি দেখছি, এবং জনগণ উদ্বিগ্ন ও হতাশ,” সোনমেজ বলেছেন

গম্ভীর বিশ্লেষণ সত্ত্বেও এরদোয়ান নিশ্চিত “দেশের জন্যে উজ্জ্বল দিন অপেক্ষা করছে।” জি২০ শীর্ষ সম্মেলন থেকে যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় রাষ্ট্রপতি দেশকে “একক-অঙ্কের মুদ্রাস্ফীতি”, “সুষম নীতি ও কাঠামোগত সংস্কার” এবং “মূল্যের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার” প্রতিশ্রুতি দেন।

রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান ৬ সেপ্টেম্বর একটি মধ্যমেয়াদী অর্থনৈতিক কর্মসূচি দেন, যাকে ব্যাপকভাবে “সুদের হার না বাড়িয়ে অর্থনীতিকে সমগতিতে রাখতে নিয়মের একটি প্রবাহ চালু করা প্রাক-নির্বাচন যুগের একটি বিরতি হিসেবে প্রতিবেদন করা হয়েছে,” জানিয়েছে ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন। ব্লুমবার্গ অর্থনীতিবিদরা সন্দিহান। বাহার বাজিকির মতে, “এমনকি সর্বোত্তম উদ্দেশ্যে প্রথাগত নীতিতে সরে গেলেও পূর্ববর্তী কর্মকাণ্ডের ক্ষতিপূরণে তুরস্কের দীর্ঘ সময় লাগবে।”

এদিকে গুভারচিনের তার জেতা অর্থ ব্যবহারের নিজস্ব পরিকল্পনা ও স্বপ্ন রয়েছে৷ তিনি বলেছেন তিনি সবসময় পশুদের দেখাশোনা করার একটি খামারের স্বপ্ন দেখতেন। তার অন্য স্বপ্নটি ছিল একটি নান্দনিক কৃত্রিম হাত পাওয়া। গত বছর তার দোকানদার বাবাকে সাহায্য করার সময় মাংস পেষানো যন্ত্রের দুর্ঘটনায় গুভারসিন তার হাতের একটি অংশ হারান। আর মনে হচ্ছে তার দ্বিতীয় ইচ্ছেটা পূরণ করা হয়েছে। টেলিভিশনে গুভারসিনকে দেখা ৬০টি দেশে কৃত্রিম সামগ্রী রপ্তানি করা একজন ব্যবসায়ী তার কৃত্রিম হাতের স্বপ্নের কথা শুনে সমস্ত খরচ বহনের প্রতিশ্রুতি দেন। এখন তার একটি খামারের পরিকল্পনাটি দেখাই বাকি।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .