হাস্যরস গ্রেপ্তার: সেন্সর মামলায় আটক কৌতুকাভিনেতা নুর হাজ্জার

মঞ্চ কৌতুকাভিনেতা নুর হাজ্জার। এমটিভি লেবাননের একটি পডকাস্ট ভিডিও থেকে নেওয়া পর্দাছবি। ন্যায্য ব্যবহার।

একটি বিষয়বস্তু ভাগাভাগির চুক্তির আওতায় এসএমইএক্সে ৩০ আগস্ট, ২০২৩ প্রথম প্রকাশিত সাফা আইয়াদের এই লেখাটির একটি সম্পাদিত সংস্করণ এখানে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে৷

মতামত ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর লেবাননের দমনাভিযান হ্রাসের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী ও এমনকি আইনজীবীদের দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্যবস্তু করা হলেও রাষ্ট্র আপাতদৃষ্টিতে কৌতুক অভিনেতা নুর হাজ্জারের মতোএকটি নতুন লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছে।

শুক্রবার ২৫ আগস্ট মঞ্চ কৌতুকাভিনেতা নুর হাজ্জারকে আল-রিহানিয়েতে সামরিক পুলিশ ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ১১ ঘন্টারও বেশি সময় আটকে রাখে। একটি সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে লেবাননে জীবিকা নির্বাহের জন্যে ডেলিভারি ড্রাইভার হিসেবে কাজ করা সেনা সদস্যদের সম্পর্কে তার একটি রসিকতা এই আটকটি উস্কে দেয়। হাজ্জার সমালোচনা করেন কীভাবে সরকার তার সামরিক কর্মীদের বেতন দিতে কষ্ট করায় তাদের প্রয়োজন মেটাতে তারা একাধিক চাকরি নিতে বাধ্য হয়।

সেইদিনই হাজ্জারকে মুক্তি দেওয়া হলেও মামলাটি চালু থাকায় জামিনের মুচলেকায় সই করতে কয়েকদিন পরে তাকে সামরিক পুলিশ সদর দপ্তরে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে কৌতুক অভিনেতার বিরুদ্ধে সহিংসতা উস্কে দেওয়ার একটি অনলাইন প্রচারণা শুরু হয়েছে।

মঙ্গলবার ২৯শে আগস্ট হাজ্জার সামরিক পুলিশ সদরদপ্তরে এলে নির্দেশ অনুসারে অপরাধ তদন্ত বিভাগে অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে পাঠানো হয়। লেবাননের সরকারি প্রসিকিউটর বিচারক ঘাসান ওয়েদাত তার আইনি প্রতিনিধিকে না জানিয়েই হাজ্জারকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন।

সেখানে হাজ্জারকে তার ২০১৮ সালের মঞ্চ পরিবেশনার আরেকটি কৌতুক ক্লিপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এটি হাজ্জারের দ্বিতীয় তলব।

দ্বিতীয় গ্রেপ্তারটি একটি মুসলমান জানাজায় তার মায়ের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে হাজ্জারের মজা করা আরেকটি পাঁচ বছরের পুরনো কৌতুক নিয়ে লেবাননের সুন্নি মুসলমান কর্তৃপক্ষ দার আল-ফতোয়ার দায়ের করা দুটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করা হয়। হাজ্জারের বিরুদ্ধে “ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ উস্কে দেওয়া, কোরআনকে উপহাস ও জাতীয় ঐক্যকে ক্ষুন্ন করার” অভিযোগ আনা হয়।

বিচারক ঘাসান ওয়েদাত হাজ্জারকে তার অবস্থান সম্পর্কে আদালতকে অবহিত করার শর্তে সাত ঘন্টা আটক রাখার পর মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে হাজ্জার এখনো বিচারের মুখোমুখি হবেন বা আরো জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে তাকে ডাকা হবে অথবা তিনি বিতর্কিত কৌতুক ভিডিওগুলি সরিয়ে দিয়ে ক্ষমা চেয়ে অভিযোগ এড়াতে সক্ষম হবেন কিনা সেটা অস্পষ্ট।

মানবাধিকার কর্মীরা ও হাজ্জারের সমর্থকদের অনুমান সম্ভাব্যভাবে গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যুক্ত ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা শুক্রবারের তদন্তের পরে ২০১৮ সালের ভিডিওটি উন্মোচন করে। এটি তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ন্যায্যতা ও কৌতুক অভিনেতার বিরুদ্ধে সমর্থন জোগাড়ের চেষ্টা হতে পারে।

হাজ্জারের আটকের প্রতিক্রিয়ায় সুশীল সমাজের গোষ্ঠী, সাংবাদিক, মানবাধিকার আইনজীবী ও হাজ্জারের সহ-কৌতুক অভিনেতারা তার মুক্তির দাবিতে মঙ্গলবার বিচারালয়ের বাইরে জড়ো হয়

হাস্যরস কোনো অপরাধ নয়

এসএমইএক্সের সাথে এক সাক্ষাৎকারে হাজ্জারের আইনজীবী দিয়ালা শেহাদের মতে “হাজ্জারকে জড়িত করা ভিডিও ক্লিপটি পাঁচ বছরের পুরনো বলে তাকে জনগণের অধিকার সংক্রান্ত আইনি বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত।”

শেহাদে লেবাননের বিচার বিভাগকে সামাজিক ও সমাজঘটিত “প্রবণতা”য় উদ্বুদ্ধ ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রভাবিত না হওয়ারও আহ্বান জানান। পরিবর্তে তিনি বিচার বিভাগের হাজ্জার ও অন্যান্য শিল্পীদের কাজের প্রেক্ষাপট বোঝার গুরুত্বের উপর জোর দেন।

শেহাদে বলেন কটাক্ষ ও হাস্যরসের জন্যে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয় এবং রসিকতার সাথে সহজাত কোনো অপরাধ যুক্ত নেই। তিনি আরো উল্লেখ করেন কোনো কাজ ধর্মীয় আচারের ক্ষতি করলেই কেবল তা অপরাধ বিবেচিত হতে পারে। বিশেষ করে প্রসঙ্গটি খণ্ডিত ও অস্পষ্ট বলে ২০১৮ কৌতুকটি সতর্কতার সাথে বিবেচনা করা উচিত।

কৌতুকটির অপরাধ বনাম শতাব্দীর অপরাধ

নুর হাজ্জারের মামলা লেবাননের জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক সৃষ্টি করায় সমর্থক ও বিরোধীদের মতামত বিভক্ত।

তবে ক্রমবর্ধমান উস্কানি নিয়ে উল্লেখযোগ্য অসম্মতি রয়েছে। হাজ্জারের ব্যঙ্গাত্মক বিষয়বস্তুর নিন্দা করে প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের প্রকাশিত বিবৃতি ও ভিডিও পরোক্ষভাবে সম্ভাব্য সহিংসতাও আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার অভিপ্রায়ের ইঙ্গিত করে।

লেবাননের বিভিন্ন আঞ্চলিক মানবাধিকার সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী লেবাননের মতামত ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা জোট ৩১ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে সরকারি পাবলিক প্রসিকিউটরের পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে।

জোটটি বিশেষ করে বর্তমান উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের কাছে কৌতুক ও ব্যঙ্গের জন্যে জোরালো আইনি সুরক্ষা প্রদানের আবেদন করেছে। লেবাননের গভীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটটি বর্তমানে চতুর্থ বছরে পদার্পণ করেছে।

উল্লেখযোগ্যভাবে, একটি বড় দুর্নীতির পরিকল্পনায় সহায়তার দায়ে অভিযুক্তির বিষয়ে ব্যাঙ্ক দু লিবানের প্রাক্তন গভর্নর রিয়াদ সালামেহর ব্যক্তিগত সাক্ষ্যদানের সম্ভাব্য সেই একইদিনে বিচারালয়ের বাইরে বিক্ষোভটি ঘটে।

সালামেহের ব্যবস্থাপনাকালে বিশেষ করে অব্যবস্থাপনা ও একটি অর্থ পাচার প্রকল্পের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাঙ্ক দু লিবানে লেবাননের ব্যাপক সম্পদের চুরি হয়। কয়েক দশক ধরে চলা এই চুরিটি ২০১৯ সালে শুরু হওয়া আর্থিক সঙ্কটের দিকে নিয়ে যাওয়া বছরগুলিতে তীব্র হয়৷ “শতাব্দীর অপরাধ” হিসেবে কিছু সমালোচক এটিকে আখ্যা দিয়েছে

তবে সালামেহ উপস্থিত হননি, তার আইনজীবীরা বলেছে বর্তমান বাসস্থান না জানায় তারা সালামেহের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। লেবাননের কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির সন্দেহভাজনদের জেল ও তদন্ত এড়াতে দিলেও শিল্পী ও রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার করে বলে এতে বিক্ষোভকারীরা ক্ষুব্ধ হয়।

লেবাননে কৌতুক বিপদে রয়েছে

কৌতুক কখনো কখনো বিতর্ক তৈরি করলেও মানুষের উপর এর প্রভাব ব্যাপক।

এসএমইএক্সের সাথে একটি আলাপে কৌতুক অভিনেতা মোহাম্মদ বালবাকি হাজ্জারের সাথে সংহতি প্রকাশ করে উল্লেখ করেছেন ডিজিটাল যুগে কৌতুক দেখা ও ভাগাভাগি করা খুব সহজ হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার সম্ভাব্যভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে বিস্তৃত দর্শকদের জন্যে দরজা খুলে দিয়েছে৷

লেবাননে কৌতুক সবসময়ই দেশের চ্যালেঞ্জপূর্ণ পরিস্থিতিতে হাস্যরস খুঁজে পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত সৃজনশীল স্বাধীনতা ও ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা এখন “সেন্সরের কাঁচির” সম্মুখীন হয়েছে। কৌতুক অভিনেতারা এখন বিচার ও গ্রেপ্তারের বিষয় বলে বালবাকি সতর্ক করেছেন।

বালবাকি দাবি করেছেন বিশেষ করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এর বিস্তারের কারণে কৌতুকর ভূমিকা বিস্তৃত হচ্ছে। অস্বাভাবিকভাবে নিরাপত্তা পরিষেবাগুলি আরো বিপজ্জনক অপরাধীদের দিকে মনোযোগ না দিয়ে প্রভাবশালী শিল্পীদের নজরদারি করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে মনে হয়।

এটি কি লেবাননের বিচার বিভাগের কৌতুক অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক কণ্ঠের উপর আত্ম-সেন্সর আরোপ প্রচেষ্টার আরেকটি উদাহরণ?

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .