এখানে গ্লোবাল ভয়েসেসের সাথে একটি বিষয়বস্তু ভাগাভগি চুক্তির অংশ হিসেবে মূলত শ্রীলঙ্কার একটি পুরস্কারপ্রাপ্ত নাগরিক গণমাধ্যম ওয়েবসাইট গ্রাউন্ডভিউতে প্রকাশিত অধ্যাপক হিরোশান হেত্তিয়ারাচ্চির নিবন্ধের একটি সম্পাদিত ও সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা ৭০-এর দশকের শেষের দিকে তার অর্থনীতি উন্মুক্ত করার সময় আমার বয়স ছিলো মাত্র কয়েক বছর। আমার মনে থাকা তাৎক্ষণিক কয়েকটি দৃশ্যমান পরিবর্তনের মধ্যে দ্বীপে প্লাস্টিকের আগমন ছিল একটি। তখনকার সময়ে আমাদের ধাতু বা কাঠের তৈরি জিনিসের তুলনায় প্লাস্টিক সস্তা, হালকা ও আকর্ষণীয় (অন্তত রঙিন) ছিলো। তার অনেক আগেই অনেক ঐতিহ্যবাহী কাঠের ও ধাতব গৃহস্থালির জিনিসপত্র প্লাস্টিকে প্রতিস্থাপিত হয়। সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণের মধ্যে রয়েছে ব্যাগ, কাপ, প্লেট, আলংকারিক জনিস ও আসবাবপত্র (কয়েক বছর পরে)। এটি শুধুমাত্র শ্রীলঙ্কায় দেখা পরিবর্তন নয়; ১৯৭০ এর দশকে প্লাস্টিক বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে এই নতুন উপাদানটি আমাদের বর্জ্য স্রোতে কী করবে সে সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা ছিল না। বর্জ্য স্রোত কী? তখন জীবন অনেক সহজ ছিল; লোকেদের ছুঁড়ে ফেলার মতো তেমন কিছুই না থাকলেও জীবিকা নির্বাহের জন্যে সংগৃহীত কাগজ ও কাচের বোতল এবং ধাতব জিনিসপত্র পুনর্ব্যবহারের পরে অবশিষ্ট সামান্য আবর্জনার বেশিরভাগই জৈব-অবচনযোগ্য। অন্যদিকে সেসময়ে সহজে ক্ষয় অযোগ্য প্লাস্টিকের কোনো দ্বিতীয় বাজার ছিলো না।
বছরের পর বছর ধরে বর্জ্যের সংমিশ্রণে ব্যাপক পরিবর্তন বয়ে আনা জনপ্রিয় প্লাস্টিকের পরিবেশগত দূষণের বিষয়টি বুঝতে বিশ্বের আরো দুই দশক সময় লাগে। এই দূষণ দুই স্তরের: যা বৃহত্তর স্তরের পাশাপাশি ক্ষুদ্র স্তরেও ঘটে। স্থলে বা আমাদের সমুদ্র ও অন্যান্য জলাশয়ে জমে থাকা বড় অব্যবস্থিত প্লাস্টিক আইটেমগুলির বৃহত্তর সমস্যা হলো দৃশ্যমান ক্ষতি, যা সঠিক ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঠিক করা যেতে পারে। ক্ষুদ্রতর সমস্যাটি প্লাস্টিকের ছোট আকারের (বর্তমান সংজ্ঞা অনুসারে ৫ মিমি বা তার ছোট) টুকরো সৃষ্ট। কিছু কিছু মাইক্রোমিটারের মতো ছোট (১ মিলিমিটারের ১/১,০০০ ভাগ) বা আরো ছোট (১ ন্যানোমিটার = ১/১,০০০ মাইক্রোমিটার) পরিমাপ করতে আপনাকে ন্যানোস্কেল ব্যবহার করতে হতে পারে। একটি ভাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্বত্ত্বেও এমন আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলাকে অত্যন্ত কঠিন করে তোলে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ আসলে কী? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে, আমি আপনাকে ১৯৭০ এর দশকের শেষের দিকে আমার মায়ের রান্নাঘরে নিয়ে যাবো। শিশু হিসেবে আমি সবচেয়ে বেশি পর্যবেক্ষণ করেছি চপিং বোর্ডটিকে। শীঘ্রই আমার মায়ের কাঠের চপিং বোর্ডটি প্লাস্টিকে প্রতিস্থাপিত হয়। প্রতিটি ছুরির আঘাত কাঠের বা প্লাস্টিকের যেকোনো চপিং বোর্ডে সবসময় দাগ কাটে এবং সময়ের সাথে সাথে আমরা এর পৃষ্ঠের ছোট ছোট টুকরোগুলি হারাতে থাকি। একটি কাঠের একটি স্থির হারে নষ্ট হলেও সময়ের সাথে সাথে প্লাস্টিকের বিচ্ছিন্নতা আরো খারাপ।
আসল প্রশ্ন প্লাস্টিকের বিচ্ছিন্ন এই ছোট ছোট টুকরোগুলির কী হয়। সহজ উত্তর তারা হয় আমাদের খাবারে নয়তো বাড়ির উঠোনের সাধারণ আবর্জনার স্তূপে গিয়ে থামে। অন্য কথায়, আমরা নিজেদেরকে এবং বাড়ির উঠোন থেকে আমাদের পরিবেশের মাটি ও জলাশয়কে মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি খাওয়াচ্ছি। দেশ প্লাস্টিক জিনিসপত্রে সলাব হয়ে গেলেও আমরা কখনোই প্লাস্টিকের সীমাবদ্ধতা জানতাম না এবং আমাদের কখনোই বলা হয়নি যে আমাদের একই প্লাস্টিকের জিনিস বেশিদিন ব্যবহার করা উচিত নয়। আমরা একা নই প্রায় ২০ বছর আগে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের পরিমাণ আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত সারাবিশ্ব এই বিষয়ে অন্ধকারে ছিল।
আমাদের জীবনযাত্রার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠায় আমরা এখন মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণে অবদান রাখা হাজার হাজার প্লাস্টিকের জিনিসে বেষ্টিত। এগুলি টুকরো, ফাইবার, প্যালেট, ফোম, ফিল্ম ও আরো বিভিন্ন উপকরণ/রঙ দিয়ে তৈরি নানা আকারে আসতে পারে। পরিহার্য পাত্র, জলের বোতল, স্টাইরোফোমের কাপ ও পাত্র, স্বাস্থ্যবিধির পণ্য, কিছু ডিটারজেন্ট, পোশাক, গাড়ির টায়ার ও সিগারেটের গোড়া এরকম কয়েকটি উদাহরণ।
সমস্যাটিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে অব্যবস্থিত প্লাস্টিক বর্জ্য। বেশিরভাগ মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয় বড় প্লাস্টিককে ভেঙে ছোট করে, যা কয়েক ন্যানোমিটারের মতো ছোট হতে পারে। এর অর্থ আমাদের পরিবেশের বেশিরভাগ মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। এগুলি জল ও বর্জ্য জল শোধন ব্যবস্থাতেও সনাক্ত করা এবং থামানো যায় না। ফলে আমাদের বেশিরভাগ পানীয় জলে (বোতলজাত জলসহ) কিছু মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের মানুষ ও প্রাণীর দেহে প্রবেশের সহজ পথ হলো জল ও খাদ্য। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা মানবদেহের প্রায় প্রতিটি অঙ্গে এমনকি মায়ের দুধেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে।
এই আণুবীক্ষণিক কণাগুলি আমাদের ও পরিবেশের ঠিক কী ক্ষতি করতে পারে? এককথায় এগুলি সকল জীবের জন্যে বিষাক্ত। একবার পাকস্থলী বা শ্বাসে গৃহীত হলে মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি অন্ত্রনালীতে ঘুরে বেড়াতে এবং ১৫০ মাইক্রোমিটারের চেয়ে ছোট প্লাস্টিকগুলি রক্তপ্রবাহে ছড়িয়ে পড়ে সম্ভাব্যভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাহত করতে পারে। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে ৫০ ন্যানোমিটার বা তার চেয়ে ছোট পলিস্টাইরিন কণাগুলির মানুষের মস্তিষ্কে প্রবেশের ক্ষমতা রয়েছে। পরিবেশের মাইক্রোপ্লাস্টিক মাটির উর্বরতা ও এতে বসবাসকারী মাটির জীবকে প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মাইক্রোপ্লাস্টিকের কেঁচোর বিকাশ ও মৃত্যুহারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত।
প্লাস্টিক এতোটা খারাপ হলে আমাদের কি এটি তৈরি করা বন্ধ করা উচিত নয়? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সহজ কোন উপায় নেই। প্লাস্টিক একটি খুব দরকারী, সাশ্রয়ী মূল্যের ও বহুল ব্যবহৃত উপাদান হয়ে উঠেছে। বিকল্প খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে এর স্থান থাবে এবং অন্তত নিকট অতীতে এর জায়গা দখলের অন্য কোন প্রার্থীও নেই।
স্বাভাবিকভাবেই আমরা মনে করি একটি সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা (সংগ্রহ, শোধন ও বর্জ্যের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি) আমাদের অন্য যেকোনো ধরনের বর্জ্যের মতো মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিরুদ্ধেও লড়াইয়ে সাহায্য করতে করতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত বিষয়টা তা নয়। শুধু (অব্যবস্থিত) প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপন্ন হয় না বলে এর শুধু একটি আংশিক সমাধান হতে পারে। ইচ্ছাকৃত না হলেও তাদের তৈরি ও পরিবেশে ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরাও দায়ী।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের অনিচ্ছাকৃত উৎপাদন ধাঁধাটির সবচেয়ে জটিল অংশ। চপিং বোর্ডের উদাহরণ, কাপড় ধোয়া ও শুকানোর সময় লিন্ট সেড এবং গাড়ির টায়ারের ক্ষয় ও ছিঁড়ে যাওয়া আমাদের অনিচ্ছাকৃত উৎপাদনের কিছু উদাহরণ। আমরা এখনো পুরো সম্পূর্ণ গল্পটি জানি না বলে এমনকি মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরির সকল সম্ভাব্য উপায় তালিকাভুক্ত করা সম্ভব নয়। তবে আমরা যা বুঝতে ও থামাতে পারি আমাদের অন্তত সেই চেষ্টাগুলি করা উচিত। প্লাস্টিক প্রতিস্থাপনের বা মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি ভাল সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত অবশ্যই প্লাস্টিকের নির্বিচার ব্যবহার এড়ানো আমাদের জীবনে সাধারণ চর্চা হওয়া উচিত।