খুব ভোরে বেক নদীর পাশে নিজেদের তাঁবু ছেড়ে দক্ষিণ-পূর্ব ক্যামেরুনের বুম্বা বেক জাতীয় উদ্যান ক্লিয়ারিংয়ের একটিতে যাওয়া ১২ জন পুরুষের একটি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডোনাতিয়েন আমেন্দো (৩০)।
অনুসরণকারীদের থামার জন্যে হাত নেড়ে আমেন্দো হঠাৎ থেমে গেলেন। সতর্কভাবে দূরের থেকে কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে তিনি ফিসফিস করে বলেন, “গরিলা।” দলটি চারটি গরিলার জঙ্গলের আরো গভীরে যাওয়া পর্যবেক্ষণ করে। আমেন্দো বুম্বা ও বেক নদীর মধ্যবর্তী অবস্থান থেকে নামের এই পার্কে কাজ করে তিন বছর কাটিয়েছেন। কণ্ঠস্বর শুনে তিনি বলতে পারেন যে দলটিকে শিকারীদের মোকাবেলা, নাকি গরিলা ও হাতির মতো প্রজাতির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। আমেন্দো তার কাজ ব্যাখ্যা করেন:
আমি একজন বাকা, প্রাণীদের পথ অনুসরণ করার জন্যে বাস্তুতন্ত্র-রক্ষীদের সাথে বনে কাজ করি। আমরা আমাদের সামনে কিছু দেখলে থেমে দেখি কেউ বা কোনো প্রাণী পাশ দিয়ে যাচ্ছে কিনা। আমরা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে যাওয়ার পথে পাশ দিয়ে যাওয়া প্রাণীদের নাম টুকে রাখি।
তিনি গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেন, “আমাদের বন ও প্রাণীদের উপর দক্ষতা থাকায় আমরা প্রাণীদের কণ্ঠস্বর, পায়ের ছাপ বা মল থেকে তাদের সনাক্ত করতে পারি।”
আমেন্দো জৈব-পর্যবেক্ষণ দলের একজন স্থানীয় কর্মী, যার বাস্তুতন্ত্র-রক্ষী ছয় সদস্যের পাঁচজন এলাকার এবং একজন বৈশ্বিক প্রকৃতি তহবিলের (ডব্লিউডব্লিউএফ) কর্মচারী। জৈব-পর্যবেক্ষণ হলো বন্যপ্রাণীর গতিশীলতা নিরীক্ষণের জন্যে ক্যামেরা ফাঁদ ব্যবহার করে মানুষের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির একটি ব্যবস্থা। উদ্যানে করা কাজে প্রতিটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি অনুভবের জন্যে বনের লোকদের স্থানীয় জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব ও স্পর্শ নিশ্চিত করার জন্যে সর্বদা দুটি আদিবাসীর প্রতিনিধি — দুজন বাকা ও তিনজন বান্টু — উপস্থিত থাকে।
জৈব পর্যবেক্ষণে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তাৎপর্য অপরিহার্য। তারা নির্দেশ দেয় কিভাবে মানুষ বনে কাজ করে। তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে নড়াচড়ার মাধ্যমে প্রাণীর ধরন ও চোরা শিকারীদের চিনতে পারে। বনরক্ষীদের একজন ঙ্গাওয়া মুনা বলেছেন, “তাদের ছাড়া, আমরা বনে ঢুকতে পারিনা, এবং কিছু কিছু এলাকায় আমাদের পথ হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।”
পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে যাওয়ার পথে ডেটা সংগ্রহ করার জন্যে প্রতিদিন সকাল ৭:০০ টায়, দলটি ক্যাম্প থেকে ক্লিয়ারিংয়ের দিকে রওনা হয়। “স্থায়ী উপস্থিতি জৈব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা” নামে পরিচিত অত্যাধুনিক ব্যবস্থা জৈব-পর্যবেক্ষণ ও নজরদারির জন্যে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ব্যবহৃত হয়। ২০১৭ সালে শুরু উদ্ভাবনী ব্যবস্থাটি প্রাথমিক অসুবিধাগুলি কাটিয়ে ২০২১ সালে দুই সপ্তাহ থেকে মাসে ২৫-৩০ দিনে উন্নীত করা হয় যাতে সম্পদের অভাব ও প্রকল্পের অংশ হতে ইচ্ছুক কিছু আদিবাসী ও স্থানীয় সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত। উদ্যান সহকারী রেনে মেইগারি ব্যাখ্যা করেন, “ক্যামেরা ফাঁদ ব্যবহার করে প্রাণীদের নজরদারির জন্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং তিনটি ক্লিয়ারিং রয়েছে। মাসিক ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ নিশ্চিত করতে দুটি দল ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।”
মেইগারির মতে ক্লিয়ারিংগুলি হলো প্রাণীর ঘনত্বের একটি অঞ্চল যেখানে তারা খাদ্য খুঁজে পেতে ও পুনরুৎপাদনের জন্যে একত্রিত হয়। দলটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে তাদের দেখা প্রাণীগুলি, তাদের আগমনের সময়, প্রাণীদের বিভিন্ন ধরনের আচরণের উপর নজর রাখে। সব প্রাণী ক্লিয়ারিংয়ে প্রবেশ করে না বলে তাদের কণ্ঠস্বর দিয়ে চেনা এবং অন্যান্য প্রাণীদের দেখার জন্যে ক্যামেরা ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। মেইগারি আরো বলেন:
প্রাণীদের উচ্চ ঘনত্বের অঞ্চল হিসেবে এটি চোরা-শিকারীদের প্রলুব্ধ করে; ক্রমাগত উপস্থিতিযুক্ত পর্যবেক্ষণ অঞ্চলটিকে সুরক্ষিত করে চোরা-শিকারিদের প্রতিরোধ ও বন্যপ্রাণীর বৃদ্ধি বা স্থিতিশীলতায় অবদান রাখে।
ক্যামেরার ফাঁদ থেকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ ও চিত্র বিশ্লেষণ করা জৈব-পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি থেকে পাওয়া তথ্যে প্রমাণিত হয়েছে লক্ষণীয়ভাবে চোরা-শিকার হ্রাস ও ক্লিয়ারিংয়ে বন্যপ্রাণী উপস্থিতির ঘটনা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে,”
মেইগারি বলেছেন ২০১৭ এবং ২০২১ সালের মধ্যে বুম্বা বেকে বন্যপ্রাণী দেখার সংখ্যা ৮,৫৬২ থেকে বেড়ে ১০,৪০২ হয়েছে, যা নিরাপত্তার অনুভূতি প্রদর্শন করে: “২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত, চোরাচালান ও অন্যান্য বেআইনি মানবিক কার্যকলাপ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, যেখানে ঘটনার সংখ্যা ১৮ থেকে ০-তে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে ক্লিয়ারিংয়ের মধ্যে বা কাছাকাছি কোনো অবৈধ মানব কার্যকলাপের কোনো ইঙ্গিতও নেই।”
আয়ের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস তাদের চোরাশিকারে জড়িত হতে বাধা দেয় বলে উদ্যানের সংরক্ষণে অংশ নেওয়ার পর থেকে বাকা ও বান্টু জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও সামগ্রিক সুস্থতার উন্নতি হয়েছে। মেইগারির মতে, আরো বেশি স্থানীয়রা এখন জৈব-পর্যবেক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে, যা ২০১৭ সালের ২৮ থেকে ২০২১ সালে ৬০-এ উন্নীত হয়েছে।
উদ্যানের উপর চাপ
বুম্বা বেক জাতীয় উদ্যান ২,৩৮,০০০ হেক্টর (২,৩৮০ বর্গ কিলোমিটার) এলাকা জুড়ে হাতি, মহিষ, চিতাবাঘ, শিম্পাঞ্জি, গরিলা ও অন্যান্য ছোট প্রাণীসহ নানা বন্যপ্রাণীতে সমৃদ্ধ ইয়োকাদৌমা, সালাপুম্বে ও মৌলৌন্দু এই তিনটি বিভাগে অবস্থিত।
বিভিন্ন সাইট সুরক্ষিত করা পশুর ঘনত্বের বিভিন্ন দলকে সুরক্ষিত এবং বাস্তুতন্ত্র-রক্ষীদের উপস্থিতি উদ্যান থেকে চোরা-শিকারীদের নিরুৎসাহিত করে। তবে এটা বাকি ২৭টি ক্লিয়ারিংয়ে প্রসারিত করাটা চ্যালেঞ্জের। মেইগারি বলেছেন ৩০টি ক্লিয়ারিংয়ের সব সাইটে দলগুলি চালু করা গেলে সুরক্ষিত এলাকাটি সম্পূর্ণভাবে আচ্ছাদন করা হবে।
সংরক্ষিত এলাকা বুম্বা বেকের কার্যক্রম পরিচালনার উপায় খুবই সীমিত। মেগারি বলেছেন পুরো এলাকাটি পাহারা দেওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব থাকায় উদ্যানের উপর চাপ রয়েছে:
ইয়োকাদৌমা থেকে উদ্যানে যাওয়ার জন্যে দল ও তাদের পরিবারের জ্বালানী, খাদ্য ও অর্থের প্রয়োজন ছাড়াও চোরা-শিকারীদের অনুসরণের উপাদান, ক্যামেরা ফাঁদ ও যানবাহন, জিপিএস এবং প্রশিক্ষণ বাস্তুতন্ত্র-প্রহরা চালু, একটি ভাল ক্যাম্প তৈরির উপাদানের এবং এসবের জন্যে প্রচুর অর্থের অভাব রয়েছে।
বেক নদীর সীমাবদ্ধ দক্ষিণ অংশে মানুষ বসবাস না করায় এখানে উদ্যানের উপর চাপ কম। শিকারীদের দূরে রাখতে নদী একটি আশীর্বাদ। কিন্তু উত্তরাংশটি গ্রামের কাছাকাছি থাকায় খাবারের সন্ধানে আসা জনসংখ্যার চাপের শিকার, মেইগারি বলেছেন। তিনি প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্যে আন্তর্জাতিক ইউনিয়নের (ইউআইসিএন) মান পূরণে বর্তমানে ১০ হাজার হেক্টরে একজন বাস্তুতন্ত্র-রক্ষী্র পরিবর্তে প্রতি পাঁচ হেক্টরে একটি বাস্তুতন্ত্র-রক্ষীর জন্যে অতিরিক্ত কর্মীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। ব্যবস্থাপনা স্থানীয় জনসংখ্যার মধ্যে আগ্রহ তৈরি এবং উদ্যান থেকে সুবিধা প্রদা্নের মাধ্যমে তাদেরকে কার্যকলাপে জড়িত করে সম্প্রদায়ের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে।
বুম্বা বেকের ভবিষ্যৎ
সরকার বাস্তুতান্ত্রিক পর্যটনে বিনিয়োগ করলে প্রধানমন্ত্রীর আদেশে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বুম্বা বেক জাতীয় উদ্যানের উত্তরাঞ্চল চোরা-শিকারের হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। বন ও বন্যপ্রাণী মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এবং বুম্বা বেক সংরক্ষক জর্জেস কে. আজাঙ্গু কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে “বাস্তুতান্ত্রিক ঘর ও রাস্তা তৈরি করে দর্শকদের অনুকূল পরিবেশে প্রাণী দেখার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করেছেন।”
ব্যবস্থাপনার উদ্যানের প্রবেশ পথ তৈরি করার পরিকল্পনা থাকলেও আপাতত উদ্যানের চারপাশের কাঠের ব্যবহার ও অন্যান্য অংশীদারদের ছাড় দিয়ে ইতোমধ্যে বিদ্যমান রাস্তাটিকে যানবাহনযোগ্য করে তুলতে কাজ করছে। প্রযুক্তিগত অংশীদার হিসেবে ডাব্লিউডাব্লিউএফ পরিবেশগত পর্যবেক্ষণ ও চোরা-শিকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে উদ্যানটিকে সমর্থন করছে। উপরন্তু, সরকার ক্যামেরুনে সংরক্ষিত অঞ্চলগুলির একটি জাতীয় কর্মসূচি তৈরি করছে যা আজাঙ্গুর মতে একটি সুরক্ষিত এলাকা হিসেবে বুম্বা বেকের জন্যে সুবিধাজনকই হবে।