বাকস্বাধীনতার সীমানা বিচরণ: নাইজেরিয়ার টুইটার নিষেধাজ্ঞা

ছবি সৌজন্যে জিওভানা ফ্লেক

দ্রষ্টব্য: নিষেধাজ্ঞার সময় এখনকার এক্স নামের কোম্পানিটিকে টুইটার বলা হতো, তাই এই নিবন্ধে এক্স-কে টুইটার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী সরকারগুলি নাগরিকদের অধিকার রক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতের মধ্যে ভারসাম্য বজায়ের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। নাইজেরিয়া সরকারের ২০২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে টুইটার নিষিদ্ধের পরিস্থিতিটি এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ।

নাইজেরিয়ার ৫০ শতাংশ ইন্টারনেট অনুপ্রবেশ নিয়ে ২০২১ সালে ১০.৪৪ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী থাকা ইন্টারনেটের গুরুত্ব নিশ্চিত করে। নাইজেরীয়রা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও দেশের অভ্যন্তরে আর্থ-সামাজিক কার্যকলাপে নিয়োজিত ও শাসন বিষয়ে মতামত প্রকাশের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে নাইজেরিয়ার টুইটার নিষেধাজ্ঞার মতো কিছু কিছু সরকারের বিভিন্ন উপায়ে নাগরিকদের ডিজিটাল অধিকার লঙ্ঘনের কারণে এই ডিজিটাল স্বাধীনতা নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে।

নাইজেরিয়ার টুইটার নিষেধাজ্ঞা বোঝা

নাইজেরিয়ার বাসিন্দারা ৫ জুন, ২০২১ থেকে ১৩ জানুয়ারি, ২০২২ পর্যন্ত টুইটারে প্রবেশ করতে পারেনি। মঞ্চের নীতিমালা লঙ্ঘন করেছে বলে মনে হলে টুইটার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদু বুহারির পোস্ট করা একটি টুইট মুছে ফেলার পরে এটি ঘটে। নাইজেরীয় সরকার দাবি করেছে টুইটার নিষিদ্ধ করার কারণগুলির মধ্যে বাস্তব বৈশ্বিক ফলাফলের জন্যে মঞ্চে ভুল তথ্য ও মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দেওয়া রয়েছে। সরকার দাবি করেছে তারা নাইজেরিয়ার অস্তিত্ব ক্ষুন্ন করতে মঞ্চটির ক্রমাগত ব্যবহার চিহ্নিত করেছে।

টুইটার নিষেধাজ্ঞা সরকারের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যের অবাধ প্রবেশাধিকার উভয়ই সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। তবে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা ও লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের মুখেও তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সংরক্ষণে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে নাইজেরীয়রা মঞ্চে যুক্ত থাকে এবং নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তাদের ভিন্নমত প্রকাশ করে।

বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব

ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলি কার্যকরভাবে অফলাইন কর্মকাণ্ডগুলির সাথে অনলাইন আলোচনার সেতুবন্ধন রচনা করে নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক সক্রিয়তা, ভিন্নমত ও নাগরিক সম্পৃক্ততার দৃশ্যপট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে৷ উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০২০ সালের #এসআরএসথামাও বিক্ষোভকারীদের একত্রিত ও সমন্বয় করে তাদের কণ্ঠস্বর প্রসারিত ও আর্থিক সহায়তা সুরক্ষার মতো কারণটির আন্তর্জাতিক মনোযোগ অর্জনে টুইটারের গভীর প্রভাব প্রমাণ করেছে। টুইটার নিষেধাজ্ঞা নাইজেরীয় নাগরিকদের বিশ্বব্যাপী তাদের মতামত প্রকাশ, তথ্য প্রচার ও জনসাধারণের বক্তৃতায় সম্পৃক্তির সম্ভাব্য একটি শক্তিশালী মঞ্চ থেকে বঞ্চিত করেছে।

একটি সাম্প্রতিক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে প্যারাডাইম উদ্যোগের একজন জ্যেষ্ঠ্য কর্মসুচি কর্মকর্তা ইহুয়েজ নওবিলর গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছেন “নিষেধাজ্ঞাটি নাইজেরিয়ার সরকারের জনগণের অধিকার ক্ষুন্নকারী স্বৈরাচারী প্রকৃতি ও বাড়তি ক্ষমতার ব্যবহার প্রদর্শন করে।”

#এসআরএসথামাও আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী নাইজেরীয়দের বিষয়ে ডেটা গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ক্ষমতার এই অপব্যবহার আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অসংখ্য বিক্ষোভকারী তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে বিধিনিষেধের শিকার ও তাদের ফোন কথোপকথনে আড়িপাতা হয় এবং জিপিএস অনুসরণের অভিযোগ ওঠে। এই চর্চাগুলি গোপনীয়তার মৌলিক নীতিগুলিকে ক্ষুন্ন করা ছাড়াও আইনসম্মত ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে জড়িত নাগরিকদের নাগরিক স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করে।

ডিজিটাল ক্ষেত্রে আরোপিত বিধিনিষেধমূলক ব্যবস্থাগুলি গণতান্ত্রিক আদর্শকে ক্ষুন্ন করা ছাড়াও নাগরিকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে। সরকার মুক্ত আলোচনা উৎসাহিত করা অনলাইন স্থানগুলিকে অবরুদ্ধ করে গণতান্ত্রিক বক্তৃতার ধারণাকে ক্ষুন্ন করে জনসাধারণের অংশগ্রহণকে দমিয়ে রাখার একটি শীতল প্রভাব তৈরি করে। এটি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি বাকস্বাধীনতা সুরক্ষা ও ভিন্নমতের অধিকারের হতাশাজনক চিত্র এবং এদের ক্ষয় এই নীতিগুলি সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে দেশের প্রতিশ্রুতির একটি সমস্যাজনক পশ্চাদপসরণকে নির্দেশ করে৷

সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি

নওবিলরের মতে, টুইটার নিষেধাজ্ঞার ফলে নাইজেরিয়া সম্পর্কে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। তিনি আরো বলেন টুইটারের স্থগিতাদেশের সাথে সাথে নাইজেরীয় উদ্যোক্তা ও কোম্পানিগুলি তাদের লক্ষ্যবস্তু শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে ও বৈশ্বিক ডিজিটাল অর্থনীতিতে অংশ নিতে লড়াই করেছে। উদাহরণস্বরূপ, অংশীজন ও সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে যোগাযোগের জন্যে প্রচুরভাবে টুইটারের উপর নির্ভরশীল প্যারাডাইম উদ্যোগকে নিষেধাজ্ঞাটি এড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে হয়েছে। দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় সামাজিক গণমাধ্যম বিপণনের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল ছোট ব্যবসাগুলির বৃদ্ধি ও লাভ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবসা প্রচারের সক্রিয়ভাবে টুইটার ব্যবহারকারী খাদ্য পরিষেবা ব্যবসায়ী মূল্যবান ওকেমে ডেইলি ট্রাস্টকে তার ব্যবসায়িক লড়াই ভাগাভাগি করেছেন: “[টু]ইটারে নিষেধাজ্ঞার পর থেকে আমি আমার গ্রাহকের কাছে প্রচারকে ১০-এর মধ্যে ৩ দিতে পারি যা আগে ৭ ছিল। লোকেরা খুব কম মঞ্চে যায় বলে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো কঠিন।” উপরন্তু, নিষেধাজ্ঞাটি বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়ে খোলামেলা সংলাপ হ্রাস ও সমালোচনামূলক বিশেষত প্রান্তিক সম্প্রদায়ের লোকদের কণ্ঠস্বর নিঃশব্দ করে বিচ্ছিন্নতা ও বর্জনের অনুভূতি বৃদ্ধি করে তুলছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব

নাইজেরিয়ার টুইটার নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর এড়ায়নি। এটিকে বাক স্বাধীনতার নীতি ও ডিজিটাল অধিকারের লঙ্ঘন বিবেচনা করে বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা, বিদেশী সরকার ও প্রযুক্তি সংস্থা এই পদক্ষেপের নিন্দা করেছে। তাদের যুক্তি, সরকারগুলি সরাসরি নিষেধাজ্ঞার পথে না গিয়ে আনুপাতিকভাবে আরো কম সীমাবদ্ধ উপায়ে ভুল তথ্য ও উস্কানি সংক্রান্ত উদ্বেগের সমাধান করতে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে পারে। সম্ভাব্যভাবে বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট স্বাধীনতার উপর আরো বিধিনিষেধ অনুপ্রাণিত করে এই নিষেধাজ্ঞাটি একইরকম সমস্যার ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার নজির সৃষ্টির উদ্বেগ উত্থাপন করেছে। অধিকন্তু, নিষেধাজ্ঞাটি ২০০ দিনে নাইজেরিয়ার অর্থনীতি প্রায় ৫০ হাজার কোটি নায়ারা (৭,০৮৩ কোটি টাকা) হারিয়েছে এবং বিদেশী বিনিয়োগ ও সহযোগিতাকেও প্রভাবিত করেছে

বিকল্প ও সমাধান মূল্যায়ন

সরকারগুলির বিভ্রান্তির বিস্তার মোকাবেলা ও অনলাইন নিরাপত্তা প্রচারণার একটি বৈধ স্বার্থ থাকলেও সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলির উপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আরো কার্যকর সমাধান রয়েছে। কিছু সমাধানের প্রস্তাব দিয়ে নওবিলর বলেছেন, “তথ্যের বিস্তার পরিচালনার নৈতিকতা ও শিষ্টাচার সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের সংবেদনশীল করার প্রয়োজন রয়েছে। কার্যকরভাবে করা হলে এটি স্ব-নিয়ন্ত্রণের দিকে পরিচালিত করবে এবং ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন মঞ্চে অনুমোদিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে আরো সচেতন হবে।”

তিনি আরো বলেন “সরকারি নীতিমালায় অবশ্যই পরিভাষাগুলির একটি সুস্পষ্ট সংজ্ঞা থাকতে হবে। সরকারগুলিকে জনগণের তথ্যের অধিকার ও বাকস্বাধীনতা সীমাবদ্ধ না করে স্বচ্ছ বিষয়বস্তু সঞ্চালন নীতিমালা বিকাশের জন্যে প্রযুক্তি কোম্পানি, নাগরিক সমাজ সংস্থা, ডিজিটাল অধিকার সংস্থা ইত্যাদির মতো বহু-অংশীজন পদ্ধতি ব্যবহার করে আইন প্রণয়ন নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বজায় ও ক্ষতিকারক বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিভিন্ন উদ্বেগ মোকাবেলার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে টুইটার ডিজিটাল অধিকার আইন বা নীতি প্রবর্তন সম্পর্কে একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে নাইজেরীয় কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করতে পারে।”

এছাড়াও দায়িত্বশীল ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে নাগরিকদের শিক্ষিত করতে বিভিন্ন গণমাধ্যম সাক্ষরতা কর্মসূচি উৎসাহিত করা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ব্যবহারকারীদের সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতায় সজ্জিত করলে তারা আরো ভালভাবে ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তি সনাক্ত করে বিচরণ করতে পারবে। উপরন্তু, সরকারি প্রতিনিধি, প্রযুক্তি কোম্পানি ও সুশীল সমাজের মধ্যে সংলাপের পথ তৈরি করা অপরিহার্য। এই মঞ্চগুলি নীতিনির্ধারকদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার সাথে সাথে নাগরিকদের অধিকারকে সম্মান করার মতো সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়ে অনলাইন বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে গঠনমূলক আলোচনায় সক্ষম করে।

নাইজেরিয়ার টুইটার নিষেধাজ্ঞা এই ডিজিটাল যুগে বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত উপস্থাপন করে। নাইজেরিয়া ইন্টারনেট শাসনের জটিলতার মধ্যে বিচরণ করে বলে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখার পাশপাশি জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় ভারসাম্য বজায় রাখার মতো সমাধান খুঁজে বের করা অপরিহার্য।

নাইজেরিয়া ও অন্যান্য দেশ যাতে তাদের নাগরিকদের অধিকারকে সম্মান করে ইন্টারনেটের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে সেজন্যে উন্মুক্ত সংলাপ, অন্তর্ভুক্তি ও গণতান্ত্রিক নীতিমালার প্রতি প্রতিশ্রুতি অনলাইন স্থানগুলি নিয়ন্ত্রণের নীতিমালা প্রণয়নের পথ দেখাবে। শুধু সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা ও ডিজিটাল অধিকারের প্রতি অঙ্গীকারের মাধ্যমে আমরা সংবেদনশীলতা ও প্রজ্ঞার সাথে বাকস্বাধীনতার সীমানা বিচরণ করা একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে পারি। নাইজেরিয়ার টুইটার নিষেধাজ্ঞার পাঠ থেকে শেখার মাধ্যমে আমরা স্বাধীন মতপ্রকাশ, অন্তর্ভুক্তি ও বৈশ্বিক সংযোগ উৎসাহিত করা একটি ইন্টারনেট দৃশ্যপট তৈরির চেষ্টা করতে পারি।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .