পাকিস্তানে নির্বাচনের প্রাক্কালে ভিন্নমত দমনের নতুন আইন প্রবর্তন

The parliament house building in Islamabad, Pakistan. Image by Mhtoori via Wikipedia. CC BY_SA 4.0

পাকিস্তানের ইসলামাবাদে সংসদ ভবন। উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে মহতুরির ছবি। সৃজনী সাধারণ অনুমতি একইরকম ভাগাভাগি ৪.০

নভেম্বরের মাঝামাঝি একটি সাধারণ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করার জন্যে ৯ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের পরামর্শে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভি জাতীয় পরিষদ (সংসদের নিম্নকক্ষ) ভেঙ্গে দেন। গত ৫ আগস্ট পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর এই বিলুপ্তিটি ঘটে। এ ছাড়াও ৮ আগস্ট, নির্বাচন কমিশন খানকে পাঁচ বছর প্রতিদ্বন্দ্বিতার  জন্যে অযোগ্য ঘোষণা করে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ – যথেষ্ট জনপ্রিয় ইমরান খানের সাথে ব্যক্তিগত শত্রুতার কথা অস্বীকার করলেও সরকার তাড়াহুড়ো করে নাগরিক স্বাধীনতা সীমিত, জনগণের কণ্ঠস্বর ও সমালোচনা দমন এবং সামরিক কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করা কয়েক ডজন খসড়া আইন পাস করেছে।

সমালোচনা বা সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করা আইন

পাকিস্তান বা এর সশস্ত্র বাহিনীর নিরাপত্তা ও স্বার্থের জন্যে ক্ষতিকর তথ্য প্রকাশকারী ব্যক্তিদের অপরাধী করার উদ্দেশ্যে ১ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে পাকিস্তান সেনা অ্যাক্ট (সংশোধনী) খসড়া আইন, ২০২৩ পাস করা হয়। একইদিনে অভিযান পরিচালনা এবং সমন ছাড়াই এমনকি আইনি লঙ্ঘনের সন্দেহের ভিত্তিতেও বেসামরিক ব্যক্তিদের আটক করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলিকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়ার জন্যে পরিকল্পিত সরকারি গোপনীয়তা অ্যাক্টের সংশোধনী (১৯২৩) জারি করা হয়।

ব্লাসফেমি বা ধর্মদ্রোহের জন্যে জেলদণ্ড দশ বছর বৃদ্ধি করতে ৮ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে ফৌজদারি আইনের (সংশোধন) খসড়া আইন ২০২৩ এবং পাকিস্তান দণ্ডবিধির (পিপিসি) ধারা ২৯৮-ক-তে একটি সংশোধনী আনা হয়। এই আইনগুলি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়াতে পারে

সাংবাদিক আরিফ রফিক এক্সে (আগেকার টুইটারে) পোস্ট করেছেন:

তার মেয়াদের শেষ দিনগুলিতে পাকিস্তানের জোট সরকার (মিশ্র ফলাফলসহ) তড়িঘড়ি করে আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছে যা নাগরিক স্বাধীনতাকে আরো সীমিত করবে এবং সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষমতা বাড়াবে।

(কিন্তু) কেন?

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ডিজিটাল অধিকার সীমিত করার আইন

অপ্রত্যাশিতভাবে ৯ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে সিনেট পাকিস্তান ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (পিইএমআরএ) আইনের সংশোধনী পাস করে, যা সাংবাদিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলির উপর সেন্সর তীব্র করবে। প্রবল বিরোধিতার পর মাত্র কয়েকদিন আগে এই খসড়া আইনটি প্রত্যাহার করা হয়।

মন্ত্রিসভা সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলিতে বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে ২৬ জুলাই, ২০২৩ তারিখে ব্যাপক বিতর্কিত ই-সুরক্ষা খসড়া আইন ২০২৩ অনুমোদন করেছে। খসড়া আইনটি ৯ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে যাচাইয়ের জন্যে আইন মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়

এছাড়াও ২৬ জুলাই, ২০২৩ তারিখে ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষা খসড়া আইন ২০২৩ ইলেকট্রনিক ডেটা লঙ্ঘন বা প্রচেষ্টার জন্যে যথেষ্ট জরিমানার মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে

বিপরীতক্রমে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের প্রত্যাবর্তনের পথ প্রশস্ত করা এবং আসন্ন নির্বাচনে শেহবাজ শরীফের মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে বাড়িয়ে তোলার মতো সর্বোচ্চ আদালত (বিচার ও আদেশের পর্যালোচনা) আইন, ২০২৩ এর মতো বেশ কয়েকটি খসড়া আইন বাতিল করা হয়।

ইমরান খান এবং শেহবাজ শরীফ উভয়ের প্রশাসনের মেয়াদে পাকিস্তানের ১৫তম সংসদে পাঁচ বছরে মোট ২৭৯টি খসড়া আইন পাস করে। উল্লেখযোগ্যভাবে শেহবাজ শরীফ সরকারের মেয়াদের শেষ তিন সপ্তাহে ৭০টিরও বেশি খসড়া আইন পাস হয়। রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর ছাড়াই ১৩টি খসড়া আইন ফেরত দিয়ে সংসদকে পুনর্বিবেচনা করতে বলেন।

নিবর্তনমূলক সাইবার আইন

তড়িঘড়ি করে ক্যাবিনেটে অনুমোদিত ই-সুরক্ষা খসড়া আইন ২০২৩ এবং ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষা খসড়া আইন ২০২৩ এর পাশাপাশি সামাজিক গণমাধ্যম নেটওয়ার্কগুলির বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের বর্তমান ইলেকট্রনিক অপরাধ প্রতিরোধ আইন ২০১৬ (পিইসিএ) সহ অন্যান্য সাইবার আইনগুলি পুরোপুরি কার্যকরী হলে তা নাগরিকদের ডিজিটাল অধিকারের পাশাপাশি ই-বাণিজ্য ও ডিজিটাল অর্থনীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।

ডেটা সুরক্ষা খসড়া আইনটির মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যবহারকারীদের ডেটা সুরক্ষিত এবং পাকিস্তানে অনলাইন পরিষেবা, কোম্পানি ও সামাজিক নেটওয়ার্কের ওয়েবসাইটে গ্রাহকদের তথ্যের অবৈধ ব্যবহার রোধ করা। প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের একটি খসড়া নাগরিক সমাজ ও ডিজিটাল আইনজীবীসহ জনসাধারণের কাছে মতামতের জন্যে পাঠানো হয়। একটি অধিকার-ভিত্তিক সংস্থা ডিজিটাল অধিকার ফাউন্ডেশন তার অনুমান এবং সুপারিশগুলির রূপরেখা দিলে খসড়াটির গুণমান উন্নত করতে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তাদের উদ্বেগের মধ্যে আইনটির কিছু অনুচ্ছেদে স্বচ্ছতার অভাব, বিশেষ করে, সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হওয়া ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষার জন্যে জাতীয় কমিশনের স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং বৈশ্বিকভাবে ডেটা সার্ভার অপারেশনের মাত্রা ও তরলতার প্রেক্ষিতে অবনতিশীল বিবেচিত “গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত ডেটা” স্থানীয়করণের — অর্থাৎ পাকিস্তানে অবস্থিত সার্ভারগুলিতে সংরক্ষণ করার — বিষয়টি রয়েছে।

উদ্যোগ পুঁজিবাদী ফয়সাল আফতাব এক্সে (পূর্বের টুইটার) বলেছেন:

আমরা পাকিস্তানের উদ্যোগ মূলধন সমিতি (#ভিসিএপি) 🇵🇰 #পাকিস্তানের ডিজিটাল প্রতিবেশে ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষা খসড়া আইনের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। জাতীয় নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ব্যাপক পরামর্শের আহ্বান জানাই. ..

ই-সুরক্ষা খসড়া আইনটি সকল ওয়েবসাইটের সামনের দিকে নজরদারি, লঙ্ঘন লক্ষ্য করতে এবং সম্ভাব্য জরিমানা আরোপের জন্যে পরিকল্পিত। উপরন্তু, ওয়েবসাইট, ওয়েব চ্যানেল, ইউটিউব চ্যানেল ও গণমাধ্যম সংস্থাগুলির প্রতিষ্ঠিত অনলাইন মঞ্চের নিবন্ধন ও নজরদারি তদারকি করতে ই-সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ নামে একটি নতুন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে৷ তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তির একটি ডিজিটাল মঞ্চ সবার জন্যে বাইটস নিবর্তনমূলক আইন অভিহিত করে ই-সুরক্ষা খসড়া আইনের তীব্র সমালোচনা করেছে। তাদের উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে “পাকিস্তানের ইসলামি মূল্যবোধ ও আদর্শ,” “ক্ষতিকর তথ্য” এবং “উস্কানি”র মতো শর্তাবলীর অস্পষ্ট ও ব্যাপক সংজ্ঞা এবং এই আইনের অধীনে গৃহীত পদক্ষেপগুলি আদালত বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাপক দায়মুক্তির আওতায় পড়ে। প্রবিধানের বিষয়ে আইনটি পরামর্শ দেয় কোনো ব্যক্তি বা সত্তা কর্মরত বা সামাজিক নেটওয়ার্ক মঞ্চ চালাতে ইচ্ছুকদের পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধিত হতে হবে।

এই খসড়া আইনগুলি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ডিজিটাল কর্মী ও সংস্থার মধ্যে শঙ্কা জাগিয়েছে৷ তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এই পদক্ষেপগুলি  কার্যক্রমের ব্যয় বাড়াতে, সম্ভাব্যভাবে পাকিস্তানে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য করতে এবং নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে সম্ভাব্যভাবে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

এক্সে (আগেকার টুইটার) সাংবাদিকদের সুরক্ষা কমিটি আবেদন করেছে:

#পাকিস্তানের আইন প্রণেতাদের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করার মতো চারটি খসড়া খসড়া আইন প্রত্যাখ্যান বা সংশোধন করা এবং খসড়া আইনগুলিকে ভোটে দেওয়ার আগে একটি স্বচ্ছ পর্যালোচনা প্রক্রিয়ায় সাংবাদিক ও অন্যান্য অংশীজনের সাথে পরামর্শ করা উচিত।

গ্লোবাল নেটওয়ার্ক উদ্যোগ এক্সে (আগেকার টুইটার) পোস্ট করেছে:

পিডিপিবি বৈশ্বিক ডেটা সুরক্ষা আইন জুড়ে দেখা ডেটা স্থানান্তরের উপর সবচেয়ে সীমাবদ্ধ ও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যা পাকিস্তানের আইনটিকে তার সমস্ত আঞ্চলিক প্রতিবেশীর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।

পাকিস্তানকে বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে বলে ডেটা সুরক্ষা ও ই-সুরক্ষা খসড়া আইন পাস করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে এশিয়া ইন্টারনেট জোট প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফকে একটি চিঠিও লিখেছে

সক্রিয় কর্মী উসামা খিলজি এক্সে (পূর্বের টুইটার) উল্লেখ করেছেন:

ইন্টারনেট কোম্পানিগুলি @সিএমশেহবাজকে একথা বলার জন্যে লিখেছে যে বর্তমান চেহারায় পিডিএম ই-সুরক্ষা খসড়া আইন এবং ডেটা সুরক্ষা খসড়া আইন পাস করলে @এশিয়া_এআইসি কোম্পানিগুলি পাকিস্তানি নাগরিকদের পরিষেবা দান চালু রাখতে পারবে না৷

পিডিএম কি আদৌ পাকিস্তানের অর্থনীতির কথা চিন্তা করে না?

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .