অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যে জর্দানের লড়াই

উইকিমিডিয়া সাধারণ থেকে জ্যাকের একটি প্রকাশ্য ডোমেইন ছবি ভিত্তিক মারিয়াম এ-এর ছবি

সুশীল সমাজের তীব্র বিরোধিতার মধ্যেই জর্দানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ ১২ আগস্ট, ২০২৩ তারিখে বিতর্কিত “সাইবার অপরাধ আইন” এর অনুমোদন দিয়ে একটি ডিক্রি জারি করেন। এই সিদ্ধান্তটি দেশের ভেতরে ডিজিটাল অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সম্ভাব্য হুমকির বিষয়ে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অধিকার গোষ্ঠীগুলির মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

সংসদের উভয় কক্ষে অনুমোদনের পর রাজকীয় ডিক্রি দেশের মধ্যে আইন প্রণয়নের সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। আইনটি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হওয়ার জন্যে সরকারি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে হবে।

জর্দানের কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে ৪১টি ধারা সম্বলিত  ২০১৫ সাইবার আইনের সাম্প্রতিক সংশোধনী স্বাধীনতা খর্ব করার জন্যে পরিকল্পিত নয়। তারা দাবি করে এই পরিবর্তনে “বিভ্রান্তি”, “ঘৃণাত্মক বক্তৃতা” ও “অনলাইন মানহানি” সম্পর্কিত উদ্বেগ মোকাবেলার জন্যে করা হয়েছে৷ রয়টার্স জানিয়েছে “সরকার ভিন্নমতকে দমন করার চেষ্টাকে অস্বীকার করলেও আইনটি ইন্টারনেটে ব্ল্যাকমেল থেকে মানুষকে রক্ষার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।”

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) মতে বিরোধী আইন প্রণেতারা যুক্তি দেন আইনের এই সংশোধনী গণমাধ্যমের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে প্রসারিত করবে এবং সরকারের প্রতি ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরকে শাস্তি প্রদান করবে। বিরোধী আইন প্রণেতা সালেহ আল-আরমোইতি এপিকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, “এই আইনটি বিপর্যয়কর এবং জর্দানকে একটি বড় কারাগারে পরিণত করবে।”

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ২২টিরও বেশি সংস্থা সমর্থিত একটি বিবৃতি অনুসারে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যে প্রবেশাধিকারের অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে এই আইনটি ডিজিটাল অধিকারের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ হুমকি তৈরি করে৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তুলে ধরেছে “আইনটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যের অধিকারসহ ডিজিটাল অধিকারগুলিকে হুমকির মুখে ফেলবে এবং শেষ পর্যন্ত ‘বিভ্রান্তি,’ ‘ঘৃণাত্মক বক্তৃতা’ এবং ‘অনলাইন মানহানি’ মোকাবেলায় জর্দান সরকারের ঘোষিত লক্ষ্যগুলি অর্জনে ব্যর্থ হবে।’

আইনটি অধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড উপেক্ষা করে

জর্দান নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদন করলেও সংশোধনীটির ভেতরের কিছু ধারা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মান ও নীতিমালা মেনে চলে না।

আমরা সাইবার অপরাধ খসড়া আইনটি পড়েছি, তাই আপনাকে পড়তে হবে না। আমাদের রায়? এটা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করা উচিত।

ইন্টারনেট স্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করা সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করা ধারাগুলির দিকে নজর দেওয়া যাক: (১/৮)

গুরুতর জরিমানা আরোপ করা আইনটিতে সম্ভাব্য ৫ বছর কারাদণ্ড এবং ৭০,০০০ জর্দানি দিনার (প্রায় ১.০৮ কোটি টাকা) পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে যা এক তৃতীয়াংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা এবং প্রতি মাসে ন্যূনতম ২৮৬ জর্দানি দিনার (প্রায় ৪৪,০০০ টাকা)) মজুরির একটি জনগণের জন্যে অসামাঞ্জস্যপূর্ণ। সাধারণ সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারীদের জন্যেও এই শাস্তিগুলি প্রযোজ্য হওয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।

গণমাধ্যম আইন বিশেষজ্ঞ অঞ্চলটিতে ডিজিটাল অধিকার প্রচারকারী লেবাননের একটি বেসরকারি সংস্থা ইয়াহিয়া চৌকেয়ার এসএমইএক্সকে বলেছেন:

যেকেউ সাইবার অপরাধ আইনের ১৫, ১৬ ও ১৭ ধারার বিধানগুলি পড়ে বুঝতে পারবেন ৭০,০০০ জর্দানি দিনারে (কোটি টাকার উপরে) পৌঁছানো গুরুতর জরিমানা মতামত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়।

সংশোধনীগুলিতে ব্যবহৃত অস্পষ্ট ও অসংজ্ঞায়িত পরিভাষার মধ্যে রয়েছে “ভুয়া খবর”, “অনৈতিকতার প্রচার, প্ররোচনা, সহায়তা বা উস্কানি”, ” অনলাইনে ব্যক্তিত্ব হত্যা”, “বিবাদের প্ররোচনা”, “জাতীয় ঐক্যকে ক্ষুন্ন করা,” এবং “ধর্মের অবমাননা।” এটি জনগণকে তাদের মত প্রকাশের অধিকার প্রয়োগের জন্যে শাস্তি দেওয়ার একটি সম্ভাব্য উপায় তৈরি করে এবং ব্যাখ্যার অনেক জায়গা ছেড়ে দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি নাগরিকদের দোষী সাব্যস্ত করতে বিচারকদের বাধ্য করতে পারে

নতুন আইনটিতে সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চের কোম্পানিগুলিকেও জর্দানে অফিস খুলতে হলে বিদেশী সংস্থার মালিকানাধীন মঞ্চগুলির এক লক্ষেরও বেশি ব্যবহারকারী থাকতে হবে৷ এই বিধানটির লক্ষ্য কোম্পানিগুলির দেশের অভ্যন্তরে দেশীয় বিচার বিভাগীয় ও সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুরোধ ও বিজ্ঞপ্তিগুলিতে সাড়া দেওয়া সহজ করে তোলা।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধের একটি প্রচলিত ধরনের প্রচেষ্টা

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জর্দানের কর্তৃপক্ষ জাতির মধ্যে শান্তিপূর্ণ ভিন্নমতকে লক্ষ্যবস্তু করার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা প্রদর্শন করেছে। এই সাম্প্রতিকতম বিকাশটি একটি বৃহত্তর ধরন তুলে ধরে এবং এটি একটি চলমান প্রবণতার প্রতিনিধিত্ব করে৷

মানবাধিকার_পর্যবেক্ষক ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে জর্দানের কর্তৃপক্ষ বক্তৃতা, সমিতি ও সমাবেশকে অপরাধী করতে ঢিলেঢালাভাবে ফৌজদারি আইন ও বিধান ব্যবহার করে:

“[বিধানগুলি] কর্তৃপক্ষকে অপরাধমূলক অন্যায়ের সাথে কোন স্পষ্ট সংযোগ ছাড়াই অভিযোগগুলি অনুসরণ করার উল্লেখযোগ্য সুযোগ দেয়, যা মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর একটি শীতল প্রভাব ফেলে।”

এই সাধারণ প্রবণতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংবেদনশীল বিষয়গুলির ব্যাপ্তি সীমিত করতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও ব্যবহৃত হয়। দক্ষিণ জর্দানের মা'ন শহরে ট্রাক ও গণপরিবহণ চালকদের বিক্ষোভ  দেখানো সরাসরি ভিডিওর বিস্তারকে সীমিত করার লক্ষ্যে ২০২৩ সালের শুরুতে টিকটকের উপর নিষেধাজ্ঞাটি এই প্রবণতার উদাহরণ হিসেবে কাজ করে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আরব বিশ্বের দৈনন্দিন জীবনের একটি বিখ্যাত ভাষ্য যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক জর্দানি পুরস্কার বিজয়ী রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যঙ্গ ম্যাগাজিন আল-হুদুদ এর উপর সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার সাথে জড়িত। পত্রিকাটি যুবরাজের ব্যয়বহুল বিয়ের একটি সরকারি প্রচারণা নিয়ে মজা করে। জর্দানে বেশিরভাগ জনগণ টিকে থাকতে লড়াই করছে এমন অর্থনৈতিক সমস্যার সময় প্রচারণাটি অনুষ্ঠিত হয়। পরে ম্যাগাজিনের সাইটে প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ করা হয়। নিউলাইনস ম্যাগাজিনের একটি নিবন্ধে আলহুদূদের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইসাম উরাইকাত ব্যাখ্যা করেছেন:

কেন আমরা অবরুদ্ধ হয়েছিলাম সেটা নিশ্চিত না হলেও কয়েক সপ্তাহ আগে আমাদের করা বছরের অনুষ্ঠান – জর্দানের রাজকীয় বিয়ের বিশেষ কভারেজ এর কারণ হতে পারে।

জর্দান বিতর্কিত “সাইবার অপরাধ আইন” সমর্থন করে বলে অনলাইনে বাক স্বাধীনতা ও ডেটা গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে৷ এটি ভিন্নমত ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করার একটি সমস্যাজনক ধারার মাধ্যমে দেশের নিরাপত্তা ও মৌলিক স্বাধীনতার মধ্যে চলমান সংঘাতের উপর জোর দেয়। ক্রমবর্ধমান বিরোধিতা সত্ত্বেও এই শক্তিগুলির মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য জর্দানের ভবিষ্যতের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .