উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যে ২০২৩ সালের মে মাসে প্রাথমিকভাবে দুটি জাতিগত গোষ্ঠী – সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মেইতি সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘু খ্রিস্টান কুকি উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সংখ্যালঘু কুকির মতো সরকারি চাকরি ও শিক্ষা কোটায় একই সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে মেইতিকে “তফসিলি উপজাতির মর্যাদা” প্রদান করা ২০২৩ সালের মার্চের একটি আদালতের রায়ের মাধ্যমে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে।
এই অঞ্চলে চলমান সংঘাতে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ১৮১ জন নিহত ও ৪০০ জন আহত হয়েছে। সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশ বিশৃঙ্খলা দমনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ায় ৬০,০০০রও বেশি মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। ২৬ জুলাই মোরে শহরের মেইতি সম্প্রদায়ের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর নতুন সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে।
মেইতি-নিয়ন্ত্রিত রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু কুকি সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি বাস্তবায়নের অভিযোগ উঠেছে। কুকি অঞ্চলের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে এবং অবৈধ অভিবাসী হিসেবে তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করা এই নীতিগুলিতে জোরপূর্বক উচ্ছেদ জড়িত।
উপত্যকা ও পাহাড়ের মধ্যে সংঘর্ষ
মণিপুরে চলমান সহিংসতার জন্যে রাজ্যের জাতিগত ও ভৌগলিক বিভাজনের ফলে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে জনসংখ্যাগত ভারসাম্যহীনতা ও বৈষম্যকে দায়ী করা যেতে পারে। মণিপুরের জনসংখ্যা উপত্যকা ও পাহাড়ে অবস্থিত জেলাগুলির মধ্যে বিভক্ত। পাহাড়গুলি এলাকাটির ৯০ শতাংশ হলেও জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশের আবাসস্থল যেখানে রাজ্যের ভূমির মাত্র ১০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করা উপত্যকাগুলিতে থাকে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ। জনসংখ্যাগত এই অসঙ্গতি এমন একটি পরিস্থিতির দিকে পরিচালিত করেছে যেখানে হিন্দু মেইতি অধ্যুষিত উপত্যকার জনসংখ্যা রাজ্য বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে ৪০টিই নিয়ন্ত্রণ করে। তাই পার্বত্য অঞ্চলের প্রধানত খ্রিস্টান নাগা ও কুকি-জোমি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব সীমিত।
ধর্ষণের অভিযোগ ও ক্ষতিগ্রস্তদের দুর্দশা
মণিপুরের জাতিগত সহিংসতাকে ধারণ করা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও দুটি গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে অবিরাম সংঘর্ষের ব্যাপক প্রচারিত একটি ভিডিও আসন্ন গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিকে চিত্রিত করে।
দুই কুকি নারীকে নগ্ন করে প্যারেড করিয়ে তাদের একটি জনতার প্রকাশ্যে অপমান করতে দেখানো একটি বিশেষ বীভৎস ভিডিও সামাজিক গণমাধ্যমে চাউর হয়েছে৷ সরকার রাজ্যে ইন্টারনেট বন্ধ প্রয়োগ করার কারণে ৪ মে তারিখের ভিডিওটি শুধু ২০২৩ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে আবির্ভূত হয়। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি জাতীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যাপক নিন্দা উস্কে দেয়। সাংবাদিক তোরা আগরওয়ালা যেমন উল্লেখ করেছেন, বেশ কিছু কুকি নারী জনতার হাতে চরম সহিংসতার শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন ১৯ বছর বয়সী মেয়ে তার যন্ত্রণাদায়ক অগ্নিপরীক্ষার কথা বর্ণনা করলে তা অবশেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মণিপুরের পরিস্থিতি সম্পর্কে তার নীরবতা ভাঙতে বাধ্য করে।
The video footage from Manipur highlights how rape and sexual assault is often weaponised during conflicts, and highlights how social media can both spread misinformation and be used as a tool to push for awareness and accountability.
From our podcast: https://t.co/6UyA72z9OG pic.twitter.com/UlAPD1yxjc
— Himal Southasian (@Himalistan) July 31, 2023
মণিপুরের ভিডিও ফুটেজ তুলে ধরে সংঘর্ষের সময় কীভাবে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন প্রায়শই অস্ত্রে পরিণত হয় এবং কীভাবে সামাজিক গণমাধ্যমও ভুল তথ্য ছড়াতে পারে এবং এটিকে সচেতনতা ও জবাবদিহিতার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আমাদের পডকাস্ট থেকে:
আরেকটি ঘটনায় একটি নার্সিং প্রতিষ্ঠানের দুই কুকি শিক্ষার্থীকে জনতা ধরে নির্দয়ভাবে মারধর করার ফলে তারা গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিছু বেঁচে থাকা ব্যক্তি তাদের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করলেও অনেকে নিরাপত্তার জন্যে পুলিশকে অপরাধের কথা জানাতে ভয় পায়, জানিয়েছে স্ক্রোল।
এই ঘটনাগুলি মণিপুরের মেইতি ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর-মূল বিদ্বেষকে তুলে ধরে পরিস্থিতির গভীরতাকে নির্দেশ করে। এই অঞ্চলের একজন শান্তিকর্মীর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা একটি নিবন্ধে সাংবাদিক বেতওয়া শর্মা এই ৩-মাসের দীর্ঘ সংঘর্ষের সময় পরিবারের দুর্দশার কথা বর্ণনা করেছেন:
In a blow-by-blow account from #Manipur, @harsh_mander tells us about families broken by 3 months of ethnic violence, children drinking rice water in relief camps & the “extreme culpability” of the state and central govts abandoning constitutional duties. https://t.co/WEjXXgYQzZ
— Betwa Sharma (@betwasharma) July 31, 2023
#মণিপুর থেকে আঘাত-পাল্টা আঘাত অ্যাকাউন্টে @হর্ষ_মান্দার ৩ মাসের জাতিগত সহিংসতায় ভেঙে পড়া পরিবার, ত্রাণ শিবিরে শিশুদের ভাতের মাড় পান করা এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব পরিত্যাগ করা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের “চরম দোষ” সম্পর্কে আমাদের বলেছেন।
নীরবতার জন্যে মোদির সমালোচনা
তার নীরবতার জন্যে সমালোচিত হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০ জুলাই, ২০২৩ প্রথমবারের মতো বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে সহিংসতা নিয়ে তার বেদনা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন মণিপুরের দুই কুকি নারীর ঘটনার জন্যে দায়ী অপরাধীরা শাস্তি থেকে রেহাই পাবে না।
ভারতীয় সংবাদপত্র টেলিগ্রাফ মন্তব্য করতে দেরি করায় প্রধানমন্ত্রীকে উপহাস করে তাদের ওয়েবসাইটে “৫৬ ইঞ্চি চামড়া ভেদ করতে ব্যথা ও লজ্জার ৭৯ দিন লেগেছে” ক্যাপশনসহ একটি ক্রন্দনরত কুমিরের একটি চিত্র প্রকাশ করেছে। “৫৬-ইঞ্চি চামড়া” শব্দগুচ্ছটি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের প্রধানমন্ত্রীকে “৫৬ ইঞ্চি বুকের মানুষ” হিসেবে চিহ্নিত করার একটি উল্লেখ।
Front page of The Telegraph says a lot……
“It took 79 days for pain and shame to pierce 56-inch skin.”
Today's #Telegraph front page shows Modi's crocodile tears after 79 days.
79 crocodiles. Brilliant. 😂😂#ManipurViralVideo pic.twitter.com/DsBfXPSmYK
— Younus PT (@younuspt) July 21, 2023
টেলিগ্রাফের প্রথম পাতা অনেক কিছু বলে……
“৫৬-ইঞ্চি ত্বক ভেদ করতে ব্যথা ও লজ্জার ৭৯ দিন লেগেছে।”
আজকের #টেলিগ্রাফের প্রথম পৃষ্ঠায় ৭৯ দিন পর মোদীর কুমিরের কান্না দেখানো হয়েছে।
৭৯টি কুমির। দারুণ। 😂😂#মণিপুরভাইরালভিডিও
বিরোধীরা ২৭ জুলাই, ২০২৩ সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় মণিপুরে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে একটি অসফল অনাস্থা প্রস্তাব আনে।
মূলধারার গণমাধ্যম সংকটকে পর্যাপ্তভাবে তুলে ধরেনি বলেও অভিযোগ উঠেছে।
ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ২০ জুলাই, ২০২৩ তারিখে ৪ মের ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কপিল সিবাল ঘটনার তদন্তের জন্যে একটি স্বাধীন সংস্থা গঠনের জন্যে আদালতকে অনুরোধ করে রাজ্য পুলিশ ও হামলার সাথে জড়িত জনতার মধ্যে “সহযোগিতা“র অভিযোগ করেছেন। সিবাল উল্লেখ করেছেন উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাত থেকে ভুক্তভোগীদের রক্ষা করার পরিবর্তে, পুলিশ তাদের ভিড়ের দিকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়ার ফলে ভিড়ের সহিংসতায় নারীদের পিতা ও ভাইয়ের ক্ষতি হয়েছিল।
লেখক-সাংবাদিক সুশান্ত সিং এই বিষয়ে মুকুল কেশবের মন্তব্য ভাগাভাগি করেছেন:
Mukul Kesavan: The violence in Manipur exhibits two symptoms– The impunity with which Meitei mobs have been allowed to loot police armouries and the instrumental use of rape to announce the end of Kuki citizenship. pic.twitter.com/iL7gye4qOj
— Sushant Singh (@SushantSin) July 30, 2023
মুকুল কেশব: মণিপুরের সহিংসতা দুটি উপসর্গ প্রদর্শন করে – দায়মুক্তিটি মেইতি জনতাকে পুলিশের অস্ত্রাগার লুট করার অনুমতি দিয়েছে এবং কুকি নাগরিকত্বের সমাপ্তি ঘোষণার জন্যে ধর্ষণের সহায়ক ব্যবহার।
ইন্টারনেট বন্ধ
সরকার ৪ মে, ২০২৩ মণিপুরে ইন্টারনেট বন্ধ করার পর ২৫ জুলাই, ২০২৩ তারিখের পরে সীমিত ও শর্তসাপেক্ষ প্রবেশাধিকার দেয়। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ওয়াইফাই ও ভিপিএন (ভার্চুয়াল ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক) ব্যবহার, সামাজিক গণমাধ্যম অ্যাপ্লিকেশনগুলি মুছে ফেলা এবং আরো একটি নেটওয়ার্কে “মাধ্যমিক” ব্যবহারকারীদের জন্যে দায়বদ্ধতা গ্রহণের উদ্যোগ পূরণ করার প্রয়োজনীয়তা ছিল। সর্বোচ্চ আদালত ৯ জুন বারবার ইন্টারনেট বন্ধের বিরুদ্ধে মণিপুরের দুই বাসিন্দার একটি আবেদনের জরুরি শুনানির অনুমতি দিতে অস্বীকার করে।
স্বাধীন ইন্টারনেট পাহারাদার নেটব্লকস জানিয়েছে:
🔥 For 3 months, #Manipur in #India has been in the dark due to an internet shutdown. Network data show that telecoms restrictions in Manipur have been ongoing since 4 May, leaving the region in the midst of a severe information blackout in a time of need.
Impacts:
▪️ Human… pic.twitter.com/nHSdHJzzF5
— NetBlocks (@netblocks) August 4, 2023
🔥 ৩ মাস ধরে, ইন্টারনেট বন্ধের কারণে #ভারতের #মণিপুর অন্ধকারে রয়েছে। নেটওয়ার্ক ডেটা দেখায় মণিপুরে ৪ মে থেকে টেলিযোগাযোগ বিধিনিষেধ চলমান রয়েছে, প্রয়োজনের সময়ে এই অঞ্চলটিকে একটি গুরুতর তথ্য অন্ধকারের মধ্যে ফেলা হয়েছে।
মণিপুর সফর করা শান্তি কর্মী হর্ষ মান্দার ধারা ১৪কে বলেছেন:
আমি আমার ঘাড় অনেক দূর বের করে এর সব শক্তি দিয়ে স্বল্পতম সময়ে সহিংসতা প্রতিরোধ ও এটি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্যে রাজ্য কর্তৃপক্ষের অপরাধমূলক ভূমিকার কথা বলবো। রাজ্য সরকার ন্যায্যতার সাথে কাজ করেছে এটা কুকি সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করতে না পারায় তারা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করে তাদের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধে রাজ্য সরকার সক্রিয়ভাবে পক্ষপাতদুষ্ট।