তুরস্কে কর্তৃপক্ষ দ্রুতই রাষ্ট্রপতির ছেলের কথিত দুর্নীতি কেলেঙ্কারির একটি প্রতিবেদন ধামাচাপা দিয়েছে

বারমিক্স স্টুডিওর ছবি। আনস্প্ল্যাশ লাইসেন্সের অধীনে মুক্তভাবে ব্যবহারের জন্যে।

রয়টার্স ২৬ জুন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের ছেলে বিলাল এরদোয়ান (42) কে দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে জড়িত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পরের দিন ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘনের কারণে ৪৭টি টুইট, ৪৫টি সংবাদের সংযোগ এবং গল্পটি ভাগাভাগি বা পুনঃপ্রকাশ করা একটি ইউটিউব ভিডিওর প্রবেশাধিকার অবরোধ করা হয়েছে। যোগাযোগ অধিদপ্তর প্রতিবেদনটিকে ভিত্তিহীন বলে নিন্দা করে এটিকে মিথ্যা তথ্য অভিহিত করেছে। বিলাল এরদোয়ান একজন আইনজীবীর মাধ্যমে তদন্তকে “মিথ্যার জাল” বলে অভিহিত করেছেন।

তুরস্কে যথাযথ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বা অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয়বস্তু অবরোধ করার অভ্যাস সাধারণকিছু অনুমান অনুসারে অবরোধ করা খবরের প্রায় অর্ধেক সরাসরি তুর্কি রাষ্ট্রপতি এবং ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন পার্টি (একেপি) নেতা রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান, তার পরিবার বা একেপি মেয়র ও কর্মকর্তাদের সাথে সম্পর্কিত।

উইকিলিকস ২০১৬ সালে একেপি কর্মকর্তাদের মধ্যে তিন লক্ষেরও বেশি ইমেল প্রকাশ করার পরে ডিজিটাল আক্রমণের মুখে পড়ে। আদালতের আদেশে জুন ২০২০-এ ব্যবহারকারী-অবদান-ভিত্তিক সহযোগিতামূলক হাইপারটেক্সট অভিধান জনপ্রিয় ওয়েবসাইট এক্সি সোজলুক (টক অভিধান) ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোয়ানের হার্মিসের হ্যান্ডব্যাগ সম্পর্কিত এন্ট্রিগুলিতে প্রবেশাধিকার অবরোধ করা হয়। “ব্যক্তিগত অধিকারের লঙ্ঘন” বলে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের জামাতা বেরাত আলবায়রাক ও আলবায়রাকের পরিবারের অন্য দুই সদস্য সম্পর্কিত নিবন্ধগুলি ২০২১ সালে অবরোধ করা হয়৷ রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের প্রাক্তন আইনজীবীর অনুরোধে ২০২২ সালে প্রায় ১৩০টি সংবাদ প্রতিবেদনের প্রবেশাধিকার অবরোধ করা হয়। “অর্থনীতিবিদ এরদোয়ান” শিরোনামের একটি গল্পটি “ব্যক্তিগত অধিকারের উপর আক্রমণ” হওয়ার কারণে ২০২২ সালের আগস্টে প্রবেশাধিকার অবরোধ করা হয়। এছাড়াও “ব্যক্তিগত অধিকারের লঙ্ঘন” বলে ২০২২ সালে রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের ব্রাজিলীয় কার্টুনশিল্পী লাতুফের আঁকা ছবিগুলি দেখানো সংবাদ আইটেমগুলির প্রবেশাধিকার অবরোধ করা হয়। এগুলি পরিবার, রাষ্ট্রপতি বা দলের সদস্যদের উল্লেখ করা বিষয়বস্তু সেন্সরের কয়েকটি ঘটনার উদাহরণ৷

তুরস্ক কয়েক বছর ধরে ইউটিউব, উইকিপিডিয়া ও টুইটারের মতো জনপ্রিয় মঞ্চগুলিতেও প্রবেশাধিকার অবরোধ করেছে। সম্প্রতি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতেও মঞ্চগুলি অবরোধ করার চর্চা অব্যাহত রয়েছে

এদিকে দুর্নীতি বা সরকার-সম্পর্কিত তদন্ত প্রকাশকারী সাংবাদিকরা প্রায়ই কারাদণ্ড ও নিপীড়নের মুখোমুখি হয়। রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের পরিবারের সদস্যদের উল্লেখ করে কথিত দুর্নীতি কেলেঙ্কারির পরিকল্পনা সম্পর্কে রয়টারের প্রতিবেদনে দুর্নীতির গল্পে রাষ্ট্রপতির ছেলের কথা উল্লেখ এবারই প্রথম নয়। বিলাল এরদোয়ানের নাম এর আগে ২০১৬ সালে একটি দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে আসে৷ সেই সময় তার নাম ইতালিতে অর্থ-পাচারের তদন্তে যুক্ত ছিল৷ বিলালের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের অভাবে শেষ পর্যন্ত বাদ দেওয়া হয়। বিলাল ও তার পিতার মধ্যে ২০১৪ সালে ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিংয়ের যে ধারাবাহিকে নগদ লক্ষ লক্ষ বিদেশী মুদ্রা নিষ্পত্তি নিয়ে আলোচনা হয়, তাও জাল বলে খারিজ করা হয়। যেসব ফাউন্ডেশনে বিলাল এরদোয়ান বোর্ডের সদস্য সেগুলিও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নজরে রয়েছে।

একেবারে সাম্প্রতিক অভিযোগ

রয়টার্সের সাম্প্রতিক তদন্তে “চালক মদ্যপ অবস্থায় গাড়ির ইগনিশন আটকে দেওয়া ড্যাশবোর্ড ব্রেথলাইজার” বিক্রয়কারী মার্কিন কোম্পানি ডিগনিটা সিস্টেমস এবির একটি সুইডিশ সহযোগীকে ঘিরে আবর্তিত। তুরস্কে পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর জন্যে বিলাল এরদোয়ান তার পিতার প্রশাসনকে দেন-দরবার করতেন। বিনিময়ে কোম্পানিটি “একটি শেল কোম্পানির মাধ্যমে বিলাল এরদোয়ান যার বোর্ড সদস্য এমন দুটি প্রতিষ্ঠান ইবনে হালদুন বিশ্ববিদ্যালয় ও তুগভা যুব ফাউন্ডেশনকে দেন-দরবার খরচ কোটি কোটি ডলার প্রদান করবে।” তদন্ত অনুসারে চুক্তিটি কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি।

তুগভা ২০২১ সালে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে জড়িত হয়ে পড়ে। গল্পটি উন্মোচনকারী সাংবাদিক মেতিন সিহান ও নথিগুলি ফাঁস করে তথ্যদাতা রামাজান আয়দোগদুকে তাদের অভ্যন্তরীণ নথি ফাঁসের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হয়প্রতিবেদন অনুসারে “সংস্থার মধ্যেকার করা ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশ নথিপত্রগুলির মধ্যে সংস্থাটিকে সরকার প্রদত্ত ব্যাপক সহায়তা ও সম্পত্তি প্রদানসহ ফাউন্ডেশনের সদস্যদের উচ্চ-পদস্থ, উচ্চ-বেতনের সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকা রয়েছে।” চলমান বিচারে বিদেশে থাকা সিহান ছয় বছর এবং আয়দোগদু সাড়ে দশ বছর কারাদণ্ডের মুখোমুখি হচ্ছে।

উদার সরকারি ভর্তুকি থেকে উপকৃত বলে কথিত সরকারের সাথে সংযুক্ত অন্যান্য ফাউন্ডেশনের মধ্যে তুগভা রয়েছে বলে জানা গেছে। ২০১৩ সালে তৈরি তুগভাকে ২০১৬ সালের অক্টোবরে করমুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয়।

বিলাল এরদোয়ান আরেকটি ফাউন্ডেশন তুরস্কের যুব ও শিক্ষা পরিষেবা ফাউন্ডেশন (তুর্গেভ) বোর্ডের সদস্য। কয়েক বছর ধরে ফাউন্ডেশনটির নাম গণমাধ্যমের নজরের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে। অতি সম্প্রতি ২০২২ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতির সাথে যুক্ত ফাউন্ডেশনগুলিকে বিদেশে অর্থ পাচারে রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করার অভিযোগ আনা হয়। ইস্তাম্বুল পৌরসভা ২০১৯ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যাতে তুগভা   এবং তুর্গেভ ইস্তাম্বুল শহরের প্রশাসনের বাজেট থেকে যথাক্রমে – এক কোটি ১৩ লক্ষ ইউরো (প্রায় ১৩৩.১২ কোটি টাকা) এবং ৮০ লক্ষ ইউরো (প্রায় ৯৪.২৪ কোটি টাকা)  – উদার অর্থ পেয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত নবনির্বাচিত ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোলু যখন একটি টেলিভিশন চ্যানেল সিএনএন তুর্কে এই ঝামেলাটি মোকাবেলার চেষ্টা করার সময় তার সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়

সত্য যেখানে, ভুল তথ্যও সেখানে

তুরস্কের প্রদেশগুলিতে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আঘাত হানা বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পরে ভূমিকম্প-আক্রান্ত এলাকায় ক্ষমতাসীন সরকারের অপর্যাপ্ত প্রতিক্রিয়ার পরে রাষ্ট্র সমালোচনা নিয়ন্ত্রণ করতে গ্রেপ্তারের উন্মাদনাইন্টারনেট বিধিনিষেধের আশ্রয় নেয়। এসবের মধ্যে জনসাধারণকে যোগাযোগ অধিদপ্তর তাদের চালু করা “গুজবের অভিযোগ পরিষেবা” অ্যাপটি ডাউনলোড করতে, “কারচুপিমূলক” সংবাদ ও সামাজিক গণমাধ্যম পোস্টের অভিযোগ জানাতে উৎসাহিত করে।

তুরস্কের আইনপ্রণেতারা ২০২২ সালের অক্টোবরে বিভ্রান্তির উপর একটি খসড়া আইন অনুমোদন করে যাকে স্থানীয় নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলি অসন্তোষ ও সমালোচনা দমনের জন্যে ব্যবহৃত গোপন সেন্সর হিসেবে বর্ণনা করেছে। বাধ্যতামূলক বিষয়বস্তু অপসারণ, ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা লঙ্ঘন, অধিকতর মঞ্চ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং আরো অনেক কিছুসহ খসড়া আইনটিতে বেশ কয়েকটি নতুন বিধিনিষেধ রয়েছে —— যদিও সবচেয়ে উদ্বেগজনক ধারার একটি ২৯ ধারা অনুসারে ” সমাজে উদ্বেগ, ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্যে কেউ প্রকাশ্যে মিথ্যা তথ্য বিতরণ করে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা ও কল্যাণ বিঘ্নিত করলে এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সম্মুখীন হতে পারে।

তুরস্কে সেন্সরের বর্তমান পরিবেশ ও অবশিষ্ট স্বাধীন গণমাধ্যমকে নীরব করার চলমান প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে যোগাযোগ অধিদপ্তরের প্রধান ফাহরেত্তিন আলতুনের রয়টার্সের প্রতিবেদনটিকে তড়িঘড়ি করে “গুজব” এবং “ধারণাভিত্তিক কাজ” বলে অভিহিত করা প্রতিক্রিয়ায় অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। একটি দীর্ঘ টুইটে আলতুন রয়টার্স ও এর প্রতিবেদনকে “একটি ১৭১ বছর বয়সী গণমাধ্যম সংস্থা প্রকাশ্যে নিজেকে অপমান করার একটি করুণ উদাহরণ” হিসেবে বর্ণনা করেন। এছাড়াও তিনি রয়টার্সের “সাংবাদিকতার মান” ও নেটওয়ার্কটির “সাংবাদিকতার নৈতিকতা” নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

আমরা এই মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের জন্যে রয়টার্সের নিন্দা জানাই কারণ তারা আবারো সমগ্র বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে যে গুজবের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জাতি ও আন্তর্জাতিক জনমত যাতে কারচুপি হতে না পারে সেজন্যে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে আমরা দিনরাত কাজ করে যাবো।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .