নেপালের অভিবাসী সেনার কবর তার পরিবারের সদস্যদের মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করেছে

Rupak Karki was killed on 30 June after joining the Russian Army to fight on the Ukraine front. A photo appearing to show is grave has been published on a memorial site

২০২৩ সালের ৩০ জুন-এ রুপক কারকি নিহত হয়। তিনি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে লড়ছিলেন। ছবিতে ইউক্রেনে নিহত রুশ সেনাদের জন্য নির্ধারিত এক কবরস্থানে রুপকের কবর দেখা যাচ্ছে। ছবি নেপালি টাইমস-এর। অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে।

জীবরাজ চালিশের এই প্রবন্ধটি নেপালি টাইমসে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। কন্টেন শেয়ারিং চুক্তির অধীনে সম্পাদিত এই সংস্করণ গ্লোবাল ভয়েসেসে-এ পুনরায় প্রকাশ করা হল।

২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে দশাইন উৎসবের সময় সরলা থাপা পশ্চিম নেপালের কপিলাবস্তু জেলায় অবস্থিত তার পিতার বাসগৃহে যান। এবার তাকে তার ভাই রুপককে ছাড়াই উৎসব পালন করতে হচ্ছিল, যে কীনা রাশিয়ায় গেছে।

কিন্তু তাদের এই উৎসব বেদনায় পরিণত হয় যখন বানগানা পৌর এলাকায় অবস্থিত তাদের বাসায় তিনজন ব্যক্তি এসে উপস্থিত হয় এটা জানানোর জন্য যে সেখান থেকে প্রায় ৯০০০ কিলোমিটার দূরে ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে গিয়ে রুপক নিহত হয়েছে।

এরপর থেকে পরিবারটি মেনে নিতে পারছে না যে রুপক আর নেই। ২৮ বছর বয়স্ক রুপক দুই বছর আগে স্টুডেন্ট ভিসায় রাশিয়ায় গিয়েছিলো এবং অন্য অনেক নেপালির মতো রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো।

সরলা বলছেন “চার মাস আগে তার ভাই বলেছিল যে রুশ সেনাবাহিনীর ছয় মাসের সেই প্রশিক্ষণের সময় সে আর বাসায় কথা বলতে পারবে না, যখন প্রশিক্ষণ শেষ হবে তখন সে আবার কথা বলবে। এখনো তো ছয় মাস পার হয়নি”।

স্থানীয় ওয়ার্ড প্রধান সাঞ্জু সারু মাগার কাঠমন্ডু থেকে রুপক সম্বন্ধে এক ফোন কল রিসিভ করেছিলেন। উক্ত ফোনকলে জানানো হয় যে ইউক্রেন যুদ্ধে রুপক মারা গেছে। ফোনে তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তি তাদেরকে অনুরোধ করেন যেন তারা রুপকের পরিবারে কাছে এই সংবাদটি জানিয়ে দেয়, তবে উক্ত ব্যক্তি এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি জে রুপকের দেহ নেপালে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কী না।

যারা নভেম্বরের শুরুতে রুপকের বাসায় তার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন ওয়ার্ড মেম্বার রাজকুমার থারু। এটা ছিল রুপকের বাসায় এই মৃত্যু সংবাদ জানানোর দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। ওয়ার্ড মেম্বার থারু, যার বাড়ি কীনা রুপকের বাড়ির সাথে তিনি বলছেন যে রুপকের পিতা মান বাহাদুর ও তার মা লক্ষী এখনো মেনে নিতে পারছে না যে তাদের সন্তান যুদ্ধে নিহত হয়েছে।

থারু বলছে তারা এখনো নিশ্চিত যে তাদের সন্তান ট্রেনিং শেষে তার বাবামাকে ফোন করবে। যারা এই সংবাদ বয়ে এনেছে, তাদের ক্ষেত্রে এই কাজটি কঠিন, কারণ রুপকের মৃত্যু নিয়ে আর কোন বিস্তারিত সংবাদ নেই।

ওয়ার্ড সভাপতি মাগার বলছেন যে যে ব্যক্তি এই সংবাদ প্রদান করেছিল সে নিজেকে রুশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা বলে নিজের পরিচয় প্রদান করে, কিন্তু ট্রু কলার নামের অ্যাপে সেটা যাচাই করার পর দেখা গেছে উক্ত ফোন নাম্বারটি বিদেশী এক কোম্পানির নামে নিবন্ধিত। এদিকে অসমর্থিত সূত্রে পাওয়া রুপকের মৃত্যুর সংবাদ নেপালের কপিলাবস্তু জেলায় ছড়িয়ে পড়ে যা কিনা গৌতম বুদ্ধের জন্মভুমি।

মাগার বলেছেন এই সংবাদ পাওয়ার পর আমরা বেশ কয়েকবার সেই নাম্বারে ফোন করার চেষ্টা করি, কিন্তু আমরা সেই নাম্বারে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। রুপকের মৃত্যুর বিষয়ে যে সামান্য তথ্য আমরা পেয়েছি সেটাই আমরা রুপকের পরিবারকে জানানোর চেষ্টা করেছি।

৪ ডিসেম্বর ২০২৩-এ নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছয় জন নেপালি নাগরিকের নাম প্রকাশ করে যারা রুশ সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। প্রকাশিত এই তালিকায় দ্বিতীয় নামটি রুপক কারকির।

অন্য যে সকল নেপালি নাগরিক এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে তারা হলেন গোর্খা জেলার সন্দীপ থাপালাইয়া, পোখরা জেলার দেওয়ান রাই, সায়ানঞ্জ এলাকার প্রিতম কারকি, দোলাখা এলাকার রাজ কুমার রোকা ও ইলাম অঞ্চলের গঙ্গা রাজ মোকতান।

Sandip Thapaliya, who died on 28 June, is said to be buried in the same gravesite as Rupak Karki.

জানা গেছে ২৮ জুন মারা গেছে বলে ধারণা করা সন্দীপ থাপালিয়াকেও সেই কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে যেখানে রুপককে কবর দেওয়া হয়েছে। ছবি নেপাল টাইমসের, অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিশ্চিত হওয়ার পর স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা সহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়ে লুম্বিনির প্রাদেশিক সংসদ সদস্য বিষ্ণু পান্থি পরের দিন সকালে রুপকের বাসায় গিয়ে হাজির হয় অনুষ্ঠানিক ভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য।

কিন্তু সরকারী কর্মকর্তারা পরিবারটিকে কেবল এই সংবাদটি দিতে পেরেছে যে রুপক রুশ-ইউক্রন যুদ্ধে নিহত হয়েছে। কিন্তু কখন ও কী ভাবে সে নিহত হয়েছে সেটা তারা জানাতে পারেনি।

গৌতম বলছে এখনো এখানে অনেক আঘাত ও সংশয় রয়ে গেছে। রুপকের পিতামাতা বিশ্বাস করতে পারছে না যে তাঁদের একমাত্র সন্তান মারা গেছে।

রুপকের পিতা মুরগী পালন করে, আর তার মা স্থানীয় এক ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করে। পরিবারে রুপক ছাড়াও সরলা নামে এক বড় বোন র‍য়েছে যার বিয়ে হয়ে গেছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়ার জন্য রুপক নিজেও কোরিয়ান ভাষা শিখেছিল, কিন্তু সে ও তার প্রতিবেশী যুবরাজ পৌডেল ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এই বিষয়টি জানার পর যে রাশিয়ায় খুব সহজেই স্টুডেন্ট ভিসা ও কাজ পাওয়া যায়। কাঠমন্ডু ভিত্তিক এক বিদেশী রিক্রুটিং কোম্পানির এজেন্সির এই দুজন রাশিয়ায় গিয়েছিল।

এক বছর পর রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিশেষ এক সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য রুপক রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রানালয়ের এক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে। রুপকের সাথে রাশিয়ায় যাওয়া যুবরাজ পৌডেলও রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল।

রুশ ওয়েব সাইট বুক অফ মেমোরিজ অফ ইভানোভা এক বিবৃতি প্রদান করেছে, তাতে উল্লেখ করা আছে যে রুপক কারকি ৩০ জুন ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে এক বিশেষ অভিযানে নিহত হয়। এই ওয়েব সাইটে ইভানোভা ওব্লাস্ট এর নভো তালিস্তয়ে অবস্থিত একটি কবরের ছবিও র‍য়েছে যেটাতে সিরলিক (রুশ) ভাষায় রুপকের নাম খোদাই করা রয়েছে। ইভানোভা ওব্লাস্ট রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে ৩২৪ কিলোমিটার উত্তরপূর্বের এক প্রশাসনিক এলাকা।

রাশিয়ার আরেকটি ওয়েবসাইট কারসিভ, ইভোনোভা অঞ্চলের এক স্মৃতি সংগ্রহশালার বই থেকে ঊদ্ধৃতি প্রদান করেছে — সেখানে বলা হয়েছে যে সন্দীপ থাপালিয়া ও অন্য এক ব্যক্তির কবর সেই একই কবরস্থানে রয়েছে যেখানে রুপক কারকির কবর রয়েছে। অন্য সেই ব্যক্তিটি কোন দেশের নাগরিক সেটা নিশ্চিত করা যায়নি।

জানা গেছে যে জুলাই মাসে ইউক্রেনের বাখমুত শহরে যুদ্ধ করতে গিয়ে সন্দ্বীপ থাপালিয়া মারা গেছে আর তার যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে কবর দেওয়া হয়েছে। উক্ত কবরস্থানের প্রাপ্ত সুত্র অনুসারে সন্দীপ ২৮শে জুন এক যুদ্ধে মারা যায়।

ছবিতে যে এপিটাফ বা কবরে নাম খোদাই করা রয়েতছে সেখানে রুপক ও সন্দ্বীপের নাম ও জন্ম তারিখ খোদাই করা রয়েছে, তাঁদের কবরের উপরে পুস্প স্তবকও রাখা আছে।

ইউক্রেন সামরিক বাহিনীর হাতে যুদ্ধ বন্দী হয়ে রয়েছেন এমন এক নাম পরিচয়হীন নেপালী নাগরিক তার পরিবারের কাছে এক অশ্রুপূর্ণ ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন, সেই বার্তায় তিনি বলছেন যেন তার পরিবার তাকে নেপালে ফিরিয়ে আনে। উক্ত নেপালি বন্দি জানিয়েছেন যে ইউক্রেনে এ রকম আরো নেপালি বন্দী র‍য়েছে।

নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রী নভেম্বর ২০২৩ –এ জানিয়েছেন যে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীতে যুদ্ধ করা বারাদি অঞ্চলের বিবেক খাতরি নামের এক নেপালি নাগরিক ইউক্রেন যুদ্ধে বন্দী হিসেবে কারাগারে আটকে আছে আর সরকার তার কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে তাঁকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।

৫ ডিসেম্বর, নেপালি পুলিশ দশজন বিদেশী নাগরিককে আটক করে যারা অবৈধভাবে নেপালি নাগরিকদের ভিজিটর ভিসায় রাশিয়ায় পাঠাতো যাতে তারা রুশ সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়। সংবাদে জানা গেছে যে অন্তত ২০০ জন নেপালি নাগরিককে তারা রাশিয়ায় পাঠিয়েছে যাদের রুশ নাগরিকত্ব ও বেশী বেতনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .