জর্জিয়ার ইইউ সদস্যপদের দিকে যাত্রা শুরু

ছবি: আরজু গেবুলায়েভা

এক মাসেরও সামান্য সময় আগে ইউরোপীয় কমিশন ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জর্জিয়া প্রার্থীর মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ করে। তারপর ১৪ ডিসেম্বর ইইউ পর্ষদের বৈঠকের সময় অবশেষে জর্জিয়াকে এই মর্যাদা দেওয়া হয়। ইইউ সদস্য দেশগুলোর নেতাদের নিয়ে গঠিত পর্ষদ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। তারা জানিয়েছে ইইউ সহকর্মী পূর্বদিকের অংশীদারি সদস্য ইউক্রেন ও মলদোভার সাথে যোগদানের আলোচনা শুরু করে ব্লকে তাদের প্রবেশকে জর্জিয়ার থেকে এক ধাপ এগিয়ে রাখবে।

এই সিদ্ধান্ত উদযাপন করতে হাজার হাজার জর্জীয় রাস্তায় নেমে আসে

ইইউ প্রার্থীতার মর্যাদা অনুমোদনের পরে জর্জিয়া উদযাপন করেছে – এটি দেশটিকে ২৭-জাতি ব্লকে যোগদানের পথে নিয়ে যাচ্ছে।

জর্জীয় প্রধানমন্ত্রী ইরাকলি গারিবাশভিলি ইইউ প্রার্থীর মর্যাদা পাওয়ার জন্যে জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, আর জর্জীয় রাষ্ট্রপতি সালোমে জুরাবিশভিলিও ইইউ’র ১৪ ডিসেম্বরের সিদ্ধান্তকে “জর্জিয়া এবং আমাদের ইউরোপীয় পরিবারের জন্যে একটি বিশাল মাইলফলক” হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন!

জর্জিয়া ৩ মার্চ, ২০২২ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যপদের জন্যে আবেদন করলে প্রধানমন্ত্রী ইরাকলি গারিবাশভিলি এটিকে “জর্জিয়ার ইউরোপীয় একীকরণের পথে আরেকটি মাইলফলক” বলে অভিহিত করেছিলেন।

একই দিনে সরকারের ওয়েবসাইটে পোস্ট করা একটি বিবৃতিতে গারিবাশভিলি বলেন, “[এ]টি আমাদের ইতিহাসে একটি নতুন পৃষ্ঠা উল্টে দেওয়ার মতো একটি মঞ্চ, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের জর্জিয়াকে ইউরোপীয় পরিবারের একটি সাধারণ হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখে।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের জন্যে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখে আবেদনের সিদ্ধান্তের পরে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের মধ্যে জর্জীয় সরকার ২ মার্চ সদস্যতার জন্যে আবেদনের অভিপ্রায় ঘোষণা করে

এই পদক্ষেপটি ক্ষমতাসীন জর্জীয় স্বপ্ন পার্টির জন্যে একটি উল্টো হাঁটার প্রতিনিধিত্ব করে, যারা এখনো পর্যন্ত সদস্যতার আবেদনের প্রাথমিক সময়রেখাকে ২০২৪ সাল থেকে ত্বরান্বিত না করার উপর জোর দিয়েছে

জর্জিয়ার উদারপন্থী কর্মী গোষ্ঠী, লজ্জা আন্দোলন ও অন্যান্য গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীর “ইউরোপীয় পছন্দ ও পশ্চিমা মূল্যবোধের প্রতি জর্জীয় জনগণের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শনের জন্যে” সংগঠিত “ইউরোপের জন্যে মিছিল“-এর অংশ হিসেবে রাস্তায় নেমে আসা হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের চাপ বৃদ্ধির কারণে এই পরিবর্তনটি মূলত চালিত হয়েছে।

জর্জিয়ার প্রার্থীতার মর্যাদা ২০২২ সালের জুনে প্রত্যাখ্যান করে তাদের আবেদন পুনঃপরীক্ষার আগে জর্জিয়াকে ১২টি শর্ত পূরণের একটি তালিকা দেওয়া হয়।

জর্জিয়ার ক্ষমতাসীন সরকার ও পশ্চিমা মিত্রদের পাশাপাশি ১২টি অগ্রাধিকার ক্ষেত্র বা শর্ত পূরণে সরকারের ব্যর্থতার কথা বলা স্থানীয় সুশীল সমাজ গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিবাদের মধ্যেই ১৪ ডিসেম্বরের সিদ্ধান্তটি আসে৷

এসব শর্তের মধ্যে ছিল রাজনৈতিক মেরুকরণ কমানো, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার, কার্যকর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করা, অভিজাততন্ত্রায়নসহ দুর্নীতি বিরোধী ব্যবস্থা জোরদার করা এবং আরো কিছু।

একটি সংবাদ ব্যাখ্যায় ৮ নভেম্বর ইইউ পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল বলেছেন, প্রার্থীতার মর্যাদার জন্যে জর্জিয়া এখন পর্যন্ত বারোটি “অগ্রাধিকার”-এর মধ্যে – লিঙ্গ সমতা ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই, আদালতের রায়ে মানবাধিকারর বিবেচনা এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় একজন সরকারি সুরক্ষক নিয়োগ – মাত্র এই তিনটি পুরণ করেছে। “প্রথমে রাজনৈতিক জীবনের, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অভিজাততন্ত্রায়ন বন্ধ, বিচারব্যবস্থা সংস্কার, নির্বাচনী সংস্কার, গণমাধ্যমে বহুত্ববাদ এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে হবে। অন্য কোন সোজা পথ নেই,” বোরেল উল্লেখ করেন।

কমিশনের ৮ নভেম্বর প্রকাশিত জর্জিয়ার উপর প্রথম বার্ষিক পরিবর্ধন প্রতিবেদনে এসব ও আরো বিষয়ে রূপরেখা দেওয়া হয়।

জর্জিয়ার প্রধানমন্ত্রী গারিবাশভিলি ও ক্ষমতাসীন জর্জীয় স্বপ্ন পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্যরা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে ফেলার কথা জোর দিয়ে বলেছে।

পণ্ডিতরা বলছে সিদ্ধান্তটি ভাল ও খারাপ উভয়ই। ভাল কারণ এটি দেশের সদস্যপদ নিয়ে জর্জীয়দের ব্যাপক সমর্থনকে প্রতিফলিত করে, আর খারাপ কারণ এটি “২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে ইউরোতে-কম-উৎসাহী শাসক দলকেও সাহায্য করতে পারে,” বিশ্লেষণে লিখেছেন জর্জিয়ার তিবিলিসিস্থ ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ও রেশম পথ বিশেষজ্ঞ এমিল আভদালিয়ানি।

ইউরোনিউজের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে তিবিলিসির নিরাপত্তা পাঠের আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নাতিয়া সেসকুরিয়া বলেছেন, জর্জিয়া পূর্ণ সদস্য হতে কয়েক বছর সময় লাগলেও এই সিদ্ধান্তে “প্রচুর প্রতীকি বিষয়” রয়েছে। বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে দেশের পাশাপাশি অঞ্চলটিতে রাশিয়ার প্রভাবের সাথে প্রতীকি বিষয়গুলি যুক্ত। সেসকুরিয়া ইউরোনিউজকে বলেছেন ইইউর ইউক্রেন ও মোল্দোভার সাথে সদস্যপদ আলোচনা শুরু ও জর্জিয়াকে প্রার্থীর মর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত “রাশিয়ার জন্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সের সাথে কথা বলা এক ইইউ কর্মকর্তা ১৪ ডিসেম্বরের সিদ্ধান্তের পরে বার্তাটি রাশিয়ার উদ্দেশ্যে ছিল বলে নিশ্চিত করেছেন। “ইইউ’র পরবর্তী পদক্ষেপ ভারসাম্য খোঁজা,” কারণ এটি মস্কোর নিয়ন্ত্রণের দিকে ঝুঁকে থাকা দেশটিকে বিচ্ছিন্ন না করার চেষ্টা করে, কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করেছেন।

রাশিয়াও সিদ্ধান্তটি খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন এই পদক্ষেপটি “রাজ্নৈতিক” এবং লক্ষ্য ” এই দেশগুলিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে রাশিয়াকে আরো বিরক্ত করা।”

জর্জীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক চিন্তাবিদ কর্নেলি কাকাচিয়ার মতো অন্যান্যরা জর্জিয়ার সদস্যপদ আলোচনা তুরস্কের সাথে আলোচনার মতো হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তুরস্ককে ১৯৯৯ সালে প্রার্থীর মর্যাদা দিলেও তারপর থেকে সদস্যতার দিকে সামান্য অগ্রগতি হয়েছে। “আমি মনে করি বিশেষ করে যদি গণতন্ত্রের প্রেক্ষিতে জর্জিয়া পিছিয়ে যাওয়া অব্যহত থাকলে এবং নীতি বা বৈদেশিক নীতির কোন পরিবর্তন না হলে ঝুঁকিটি রয়েছে,” কাকাচিয়া রয়টার্সকে বলেছেন

জর্জিয়া একটি চলমান রাজনৈতিক সংকটে প্রবেশ করলে ৩১ অক্টোবর, ২০২০ একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সংসদীয় ভোট অনুষ্ঠানের পর থেকে ক্ষমতাসীন জর্জীয় স্বপ্ন সরকার স্বাধীনতা ও মানবাধিকার বিষয়ে উল্টোপথে হাঁটছে। তারপর থেকে দেশটি বিক্ষোভের সহিংস বিচ্ছুরণ, স্বাধীন গণমাধ্যমের উপর হামলা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের ভেতর বেড়ে যাওয়া ফাটল প্রত্যক্ষ করেছে।

ক্ষমতাসীন দল ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটির রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়

স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিষয়ে দেশটির পথচলার ইতিহাসের অবনতি ঘটছে। ক্ষমতাসীন জর্জীয় স্বপ্ন পার্টি তার এলজিবিটিকিউ+ বিরোধী অবস্থানের জন্যে সমালোচনার মুখে পড়লেও ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকেই রাশিয়ার সাথে সখ্য গড়ে তুলছে

তবে জর্জিয়ার জনগণের জন্যে ১৪ ডিসেম্বরের সিদ্ধান্তটি একটি স্বপ্ন যা একদিন সত্যি হতে পারে। রাজধানী তিবিলিসির একজন উদযাপনকারী ১৪ ডিসেম্বর রয়টার্সকে বলেছেন, “জর্জিয়াকে ইউরোপীয় পরিবারের অংশ হিসেবে দেখাটাই সম্ভবত আমার স্বপ্ন।”

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .