মোদিকে নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্রের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের যুদ্ধ
স্মার্টফোনে বিবিসি নিউজ অ্যাপের পর্দার ঘনিষ্ট ছবি। ব্রেট জর্ডানের ছবি। পেক্সেল লাইসেন্সের অধীনে ব্যবহৃত।
২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে ভারতের আয়কর বিভাগের প্রায় দুই ডজন কর্মকর্তা একটি “আয়কর সমীক্ষা” শুরু করার জন্যে রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ব্রিটিশ সম্প্রচার কর্পোরেশন (বিবিসি) এর ভারতীয় দপ্তরে প্রবেশ করে। ভারতের একটি গণমাধ্যম পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান নিউজলন্ড্রি অনুসারে ঐ সময়ে বিল্ডিংয়ে উপস্থিত সংস্থাটির প্রায় ১০০ কর্মীকে তাদের ফোন জমা দিতে এবং অভিযানের সময় প্রাঙ্গনে থাকতে বলা হয়। মুম্বাই বিবিসি অফিসেও একইরকম একটি “জরিপ” শুরু হয়। অনুসন্ধানটি তিন দিন ধরে চলে ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সন্ধ্যায় শেষ হয়।
ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে পরিচিতদের কাছে দেশে অত্যন্ত সাধারণ হয়ে ওঠা একটি ধরন অনুসরণ করায় মঙ্গলবারের খবরটি কোন আশ্চর্যের বিষয় ছিল না। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার উপর বিস্ফোরক তথ্যচিত্রটির কারণে বিগত এক মাস ধরে যুক্তরাজ্যের জাতীয় সম্প্রচারকারী বিবিসি জনসাধারণের আলোচনা ও সংবাদ কভারেজের বিষয় হয়ে ওঠে।
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে মুসলমান সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা তুলে ধরার লক্ষ্যে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বিবিসি “ভারত: মোদি প্রশ্ন” শিরোনামে একটি দুই-খণ্ডের তথ্যচিত্র প্রকাশ করে। ধারাবাহিকটির ২০০২ সালের ভয়াবহ গুজরাট দাঙ্গার উপর প্রথম অংশ ১৭ জানুয়ারি মুক্তি পায়। খণ্ডটি গুজরাট রাজ্যে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকারের বিরুদ্ধে সেই সময়ের মুসলমান সংখ্যালঘু জনসংখ্যার উপর সহিংস হামলায় যথেষ্টভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ করে।
তথ্যচিত্রটি যে তথ্য ভাগাভাগি করেছে তা নতুন কিছু নয় এবং গত দুই দশক ধরে সর্বজনীনভাবে পাওয়া লিখিত রেকর্ড, নথি এবং প্রতিবেদন আকারে বিদ্যমান। ২০২২ সালের নভেম্বরে একটি সমাবেশের সময় বিজেপির একজন বিশিষ্ট নেতা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বিপুল সংখ্যক মানুষ – মূলত মুসলমানদের – প্রাণ হারানো গুজরাট দাঙ্গার কথা স্বীকার করে “তাদের একটি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে” বলে ঘোষণা করেন।
তথ্যচিত্রটি ভারতে অবরুদ্ধ
তথ্যচিত্রটির প্রতি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার এটিকে একটি প্রচারণার অংশ বলে উড়িয়ে দেয়। তথ্যচিত্রটি শুধু যুক্তরাজ্যে বিবিসির অনলাইন স্ট্রিমিং পরিষেবা বিবিসি আইপ্লেয়ারে পাওয়া গেলেও ব্যক্তিগতভাবে একাধিক ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড এবং বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চে ব্যাপকভাবে ভাগাভাগি করা হয়েছে। ভারতে দর্শকদের জন্যে ওয়েবে তথ্যচিত্রটিতে প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার জন্যে সরকার জরুরি আইন তলব করেছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ্য উপদেষ্টা কাঞ্চন গুপ্তা ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে একটি টুইটে উল্লেখ করেন বিবিসি তথ্যচিত্রটির প্রথম পর্ব এবং ইউটিউব ভিডিওগুলির লিঙ্ক ও পঞ্চাশটিরও বেশি টুইটসহ বেশ কয়েকটি ইউটিউব ভিডিও সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিবিসি ২৪ জানুয়ারি তারিখে ২০১৯ সালে পুনঃনির্বাচনের পরে মোদী সরকারের কর্মক্ষমতা পরীক্ষা করা তথ্যচিত্রটির দ্বিতীয় অংশ সম্প্রচার করলেও এটা সেন্সরের কোন আদেশ দেওয়া হয়নি।
টুইটগুলি সরিয়ে ফেলার টুইটারের সিদ্ধান্ত এবং “কঠোরভাবে গবেষণা“লব্ধ বলে দাবি করা বিবিসির তথ্যচিত্রটি সুরক্ষায় পশ্চিমা গণতন্ত্রের সমর্থনের অভাব ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
প্রকাশ্য প্রদর্শনীর উপর দমনাভিযান
মোদি সরকারের তথ্যচিত্রটি দমন এবং এটিকে অনলাইনে দেখা থেকে বিরত রাখার মরিয়া প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভারত জুড়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ভিন্নমত প্রদর্শনের জন্যে প্রকাশ্য প্রদর্শনী পরিচালনা করে।
তবে সরকার এই ছাত্র সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়। তথ্যচিত্রটি প্রদর্শন করা বা দেখা ছাত্রদের কলেজগুলি স্থগিত করে। বিজেপি সমর্থক এবং রাজ্য-নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীগুলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বাইরে বিক্ষোভ করে, এমনকি তথ্যচিত্রটি প্রদর্শন করার জন্যে শিক্ষার্থীদের শারীরিক সহিংসতা ও হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেয়।
উপরন্তু বিজেপি নেতারা বিবিসিকে দুর্নীতিগ্রস্ত আখ্যা দিয়ে তাদের ভারতের সুনামকে “বদনাম” করার অপচেষ্টা রয়েছে বলে অভিযোগ করে। তারা তথ্যচিত্রটিকে প্রচারণা আখ্যা দিয়ে এটিকে ঔপনিবেশিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ বলে নিন্দা করে। তথ্যচিত্রেটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জায়েজ করার জন্যেও এসব সমালোচনা করা হয়।
অভিযানগুলির একটি নির্দিষ্ট ধরন রয়েছে
ঘটনাগুলির এই ধারাবাহিকতা বিবেচনা করে বিবিসিতে সাম্প্রতিক অভিযানটিকে ভিন্ন কারণ উল্লেখ করে সংস্থাটিকে একটি শিক্ষা দিয়ে ভারতে এর কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ বলে মনে হয়। সরকারকে সমালোচনা করার সাহস দেখানো বুদ্ধিজীবী, বেসরকারি ও গণমাধ্যম সংস্থাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে বিজেপি আগে থেকেই আর্থিক অপরাধের তদন্তকারী আইটি (আয়কর) বিভাগ এবং ইডি (আইনপ্রয়োগ বিভাগ) এর মতো রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থাকে নিযুক্ত করেছে বলে অনুমানে করা সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে আইটি বিভাগ অক্সফাম ভারত, নীতি গবেষণা কেন্দ্র (ভারতের সবচেয়ে বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠীর অন্যতম) এবং বিজেপির সমালোচনাকারী ওয়্যার, ক্যারাভান, প্রিন্টের মতো বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম সংস্থাকে তহবিল যোগানো স্বাধীন ও জনমানসিকতার গণমাধ্যম ফাউন্ডেশন (আইপিএসএমএফ) এর দপ্তরে অভিযান চালায়। তদন্তের লক্ষ্য ছিল ভারতে বিদেশী তহবিল নিয়ন্ত্রনকারী বৈদেশিক অবদান নিয়ন্ত্রণ আইনের (এফসিআরএ) কথিত লঙ্ঘন যাচাই করা।
ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে বিদেশী তহবিল গ্রহণকারী সুশীল সমাজ সংস্থাগুলির আরো বিস্তারিত প্রতিবেদন এবং তদন্তের জন্যে বিজেপি এফসিআরএ প্রবিধানকে কঠোর করেছে। সরকার “দেশবিরোধী কার্যকলাপে” জড়িত থাকার কথিত অভিযোগে শত শত বেসরকারি সংস্থার এফসিআরএ লাইসেন্স নবায়ন অস্বীকার করেছে।
২০২১ সালের জুলাই মাসে আইটি বিভাগ কর ফাঁকির অভিযোগে হিন্দি ভাষার ভারতের বিশিষ্ট সংবাদপত্র দৈনিক ভাস্করে একটি অভিযান চালায়। বিরোধীদলীয় নেতা জয়রাম রমেশ টুইট করেন সংবাদপত্রটিকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছিল কারণ:
Through its reporting Dainik Bhaskar has exposed the Modi regime’s monumental mismanagement of the COVID-19 pandemic. It is now paying the price.
An Undeclared Emergency as Arun Shourie has said — this is a Modified Emergency. https://t.co/EVLHGisGTq
— Jairam Ramesh (@Jairam_Ramesh) July 22, 2021
দৈনিক ভাস্কর তার প্রতিবেদনের মাধ্যমে কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ে মোদি সরকারের বিশাল অব্যবস্থাপনা উন্মোচন করেছে। এখন তার মূল্য দিতে হচ্ছে।
একটি অঘোষিত জরুরি অবস্থা, এটিকে অরুণ শৌরি যেমন একটি পরিবর্তিত জরুরি অবস্থা বলেছেন।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থ পাচারের অভিযোগে নয়াদিল্লি এবং উত্তর প্রদেশের স্বাধীন গণমাধ্যম সংস্থা নিউজক্লিকের কার্যালয় এবং এর জ্যেষ্ঠ্য ব্যবস্থাপনার বাসভবনগুলিতে ইডি অভিযান চালায়। ইতোপূর্বে নিউজক্লিক তাদের প্রতিবেদনে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে দেশকে নাড়া দেওয়া কৃষক বিক্ষোভকে ব্যাপকভাবে কভার করে।
এফসিআরএ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারত কার্যালয় ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ইডির অভিযানের মুখে পড়ে। পরবর্তীকালে অ্যামনেস্টির ব্যাংক হিসাব হিমায়িত করার ফলে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে সংস্থাটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়৷ অ্যামনেস্টি সরকারের সমালোচনামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে ভারত সরকারকে ডাইনি শিকারে জড়িত থাকার জন্যে অভিযুক্ত করেছে৷
অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিজেপির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা বা দল সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিবেদন করা গণমাধ্যম সংস্থা বা বেসরকারি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে একই ধনের অভিযান না চালানো বা অনুসন্ধান না করাটা লক্ষণীয়।
মানবাধিকার সমর্থক গোষ্ঠীগুলি ভারতে মানবাধিকার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উদ্বেগজনক অবনমন সম্পর্কে সতর্ক করছে। যুক্তি হিসেবে তারা দেখায় দেশে সরকার সব ধরনের ভিন্নমত ও সমালোচনাকে দমন করতে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে ভারতে একজন স্বাধীন সাংবাদিক হওয়ার মূল্য অনেক বেশি করে চুকাতে হচ্ছে।
ভারতের অনেক মূলধারার গণমাধ্যম চ্যানেল এধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হওয়া এড়াতে সরকারের মুখপত্রের পথ অবলম্বন করে প্রচারণার বাইরে কিছুই ভাগাভাগি না করায় জনগণের পক্ষে নিরপেক্ষ সমালোচনামূলক তথ্য জানা কঠিন হয়ে উঠেছে।
এই পোস্টটি জিভি এডভোকেসী (গ্লোবাল ভয়েসেস অ্যাডভোকেসী) প্রকল্পের, যা বিশ্বব্যাপী বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও অনলাইন সেন্সরশীপের বিরুদ্ধে লড়াই করার নিমিত্তে গঠিত একটি গ্লোবাল ভয়েসেস প্রকল্প। · সবগুলো পোস্ট
