ব্রাজিল ও ভারতে বিভিন্ন ডিজিটাল মঞ্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে

ছবির সৌজন্যে আমেয়া নাগরাজন

বিগত দশকে সামাজিক গণমাধ্যমের মঞ্চগুলি ভারত ও ব্রাজিলের গণতন্ত্রকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। দেশগুলিতে তাদের উপস্থিতি, তাদের ব্যাপক অভিযোজন এবং পরবর্তীতে এসব স্থান এবং সরঞ্জামের সম্মিলিত ব্যবহার ক্ষতিকর প্রভাবক হিসেবে মৌলিক অধিকারগুলিকে স্থানচ্যুত করেছে। ব্রাজিলে মনে রাখার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন হলো ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচন প্রক্রিয়া যেখানে জাইর বলসোনারোর প্রচারণায় তার ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিপক্ষ সম্পর্কে ভুল/বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যে হোয়াটসঅ্যাপের গণবার্তা সরঞ্জাম ব্যবহার উন্মোচিত হয়।

একইভাবে, গণপ্রচারণার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলির হোয়াটসঅ্যাপ মঞ্চের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে ভারতের ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন “হোয়াটসঅ্যাপ নির্বাচন” হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বছরের পর বছর ধরে বিশেষভাবে ফেসবুকের মতো এসব মঞ্চের প্রভাব বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে প্রকাশিত ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে যে ফেসবুক এবং ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে একটি কায়েমী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে যে সেদেশে কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থের প্রতি আঘাত এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের কর্মচারীদের বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে এবং পার্টিটির বিরুদ্ধের জাল খবর প্রচারকারী পৃষ্ঠাগুলি সরিয়ে দিতে বলেছিলেন।

অন্যদিকে, টুইটারের সাথে ভারত সরকারের সম্পর্ক টালমাটাল। ২০২১ সালের বিভিন্ন সময়ে সামাজিক গণমাধ্যম দৈত্যটি অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যে ক্ষতিকর বিবেচনায় সরকারের নিয়ম এবং আইনিভাবে বিষয়বস্তু সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ মেনে চলেনি। জবাবে সরকার অবজ্ঞা, আইনি নোটিশ এবং টুইটারের অফিস বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিয়েছে। অতি সম্প্রতি, ২০২২ সালের জুলাই মাসে ভারত সরকারের বিষয়বস্তু সরিয়ে নেওয়ার আদেশের বিরুদ্ধে টুইটার আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে

ভারত ও ব্রাজিলের নেতা নরেন্দ্র মোদী এবং জাইর বলসোনারোর স্বৈরাচারী শাসনের ধরনের মিলের কারণে প্রায়ই তুলনা করা হয়ে থাকে। দেশদুটিতে গণতন্ত্রকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে সামাজিক গণমাধ্যমের ভূমিকাও এদের তুলনা করার জন্যে উপযুক্ত করে তোলে। উপরন্তু, উভয় দেশই কিছু কিছু সামাজিক গণমাধ্যম দৈত্যদের অন্যতম বৃহত্তম বাজার

প্রযুক্তি নীতির বিবেচনায় এটাও লক্ষণীয় যে দেশ দুটিতে গত কয়েক বছর ধরে মঞ্চগুলি ক্ষতিকারক এবং প্রায়শই সমন্বিত প্রভাবকদের পরিষেবার ক্ষতিকারক ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করলেও তা নেতিবাচক প্রভাবগুলি নিয়ন্ত্রণের জন্যে এখনো যথেষ্ট নয়।

ব্রাজিলে বিষয়বস্তু নামিয়ে ফেলা, দলগত স্থগিতকরণ এবং অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধকরণের মতো মঞ্চের নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডের ক্রমবর্ধমান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত প্রভাবকগুলো রাষ্ট্রপতি বলসোনারোর পাশে দাঁড়িয়ে তার সমর্থকদের মধ্যে একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছে। একটি উদাহরণ হলো সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে মঞ্চ থেকে বের করে দেওয়া অতি-ডান ব্লগার অ্যালান দোস সান্তোস বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক। এছাড়াও, গত দুই বছরে মঞ্চগুলি tসরাসরি সম্প্রচার নামিয়ে এবং সম্ভাব্য মিথ্যা প্রকাশনা অপসারণসহ বলসোনারোর বিরুদ্ধে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আরেকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হলো, ২০২২ সালে সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাবনা থাকায় সর্বোচ্চ নির্বাচনী আদালত (টিএসই) দেশে কর্মরত সামাজিক গণমাধ্যম কোম্পানিগুলির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে বিভিন্ন সহযোগিতা চুক্তি করেছে৷ বলসোনারো টিএসই-কে একটি প্রতারণাপূর্ণ অবৈধ প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করেন এবং তিনি এর বিরুদ্ধে। এর অর্থ হলো তিনি এই চুক্তিটিকে তাঁর এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত হিসাবে দেখেন, যা বাস্তবে সত্য নয়। নির্বাচনী ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার একটি কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই সহযোগিতা চুক্তিটি করা হয়েছে।

একটি তাৎক্ষণিক প্রভাব হলো কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধার করার জন্যে কোন একটি নির্দিষ্ট দেশের মধ্যে মঞ্চগুলির কাজ করার প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য সরকারি হস্তক্ষেপ। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণাত্মক বক্তব্যকে নিয়ন্ত্রণ না করে ফেসবুকের ক্ষমতাসীন দলের পক্ষাবলম্বনের অভিযোগের এর দৃষ্টান্ত দেখা যায়। দেশে মিথ্যা/ভুল তথ্য একটি প্রধান সমস্যা এবং এমনকি প্রাণহানিরও কারণ হয়েছে। সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার করে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের পক্ষে যে কোনো মেরুকরণ বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং সার্বিকভাবে সমাজের উপর বিপজ্জনক প্রভাব ফেলতে পারে।

আরেকটি সম্ভাব্য প্রভাব হলো এই পেছনে ঠেলা এবং মঞ্চগুলির বিরুদ্ধে লড়াই শেষ পর্যন্ত সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা বা জরিমানাসহ অর্থনৈতিক জগতে প্রবেশ করে, যা মঞ্চগুলিকে এই কর্তৃত্ববাদী নেতাদের অনুরোধ মেনে নিতে বাধ্য করে বাক স্বাধীনতা ও নাগরিকদের অনলাইন গোপনীয়তার উপর প্রভাব ফেলবে।

সাধারণ নির্বাচনের আগে মঞ্চগুলির সাড়া দেওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্রাজিল সরকার এগুলোকে পিছিয়ে দিচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে জোরালো। ব্রাজিলে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় বার্তা অ্যাপটি ২০২২ সালের অক্টোবরে নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তার কমিউনিটি ফিচার/ বৈশিষ্ট্য চালু স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেপ্টেম্বরে সারাবিশ্বে চালু হতে যাওয়া এই বৈশিষ্ট্যটি সম্প্রচার তালিকার মাধ্যমে কমিউনিটি অ্যাডমিনদের ২,৫০০ জনের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি গ্রুপগুলিতে ব্যবহারকারীর ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে। ২০২২ সালের এপ্রিলে বলসোনারো হোয়াটসঅ্যাপ প্রতিনিধিদের সাথে একটি বৈঠকের অনুরোধ করেছিলেন যেখানে তিনি নির্বাচনের আগেই সংস্থাটিকে বৈশিষ্ট্যটি চালু করতে বলেন। সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, তার কথাটি ছিল যে “টিএসই যদি হোয়াটসঅ্যাপের সাথে একটি চুক্তি করতে পারে, তবে আমি নিজেও একটি করতে পারি।” তার যুক্তি অনুসারে, হোয়াটসঅ্যাপকে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করতে হবে, কারণ এই বৃহত্তর গোষ্ঠীগুলি থেকে তার প্রচারণা উপকৃত হবে।

ভারতের ক্ষেত্রে, ভুল/তথ্য আসলেই উদ্বেগজনক এবং পর্দাফাঁসকারীদের অ্যাকাউন্টগুলি বারবার নির্দেশ করে যে কীভাবে দেশের শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মৌলিক অধিকার পদদলিত করে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে এসব মঞ্চ ব্যবহার করেছে। বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ নীতি নিয়ে এসব মঞ্চ এবং ভারত সরকারের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই আরো প্রকাশ্যভাবে দৃশ্যমান। সামাজিক গণমাধ্যম দৈত্যদের উপর বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা আরোপ করে ভারত সরকার আইটি বিধি ২০২১ প্রবর্তন করার পর এটা দেখা গিয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপ এবং টুইটারসহ বেশ কয়েকটি প্রভাবক ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেট স্বাধীনতাকে পরিবর্তন করতে পারার মতো সরকারি বাড়াবাড়ি হিসেবে এসব নিয়মের সমালোচনা করে। হোয়াটসঅ্যাপ আইনিভাবে একটি ধারাকে চ্যালেঞ্জ করেছে যার জন্যে কোম্পানিকে কার্যত এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন ভেঙ্গে একটি বার্তা যে শুরু করেছে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রতিবেদন অনুসারে সংস্থাটি যুক্তি দিয়েছে যে এধরনের প্রয়োজনীয়তাগুলি ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। টুইটার ভারত সরকারের আইটি বিধির বিরোধিতা করার ফলে এসব মেনে না চললে “মধ্যস্থতাকারী” হিসেবে তার মর্যাদা হারানোর হুমকি পেয়েছে। ২০২১  সালের জুনে টুইটার তার মধ্যস্থতাকারী মর্যাদা হারিয়েছে, নিয়ম মেনে চললেই কেবল তারা সেটা ফিরে পাবে।

উপরন্তু, সরকারের নামিয়ে ফেলার অনুরোধ মেনে চলা নিয়ে ক্ষমতার লড়াইও দৃশ্যমান। ভারতে সারাবিশ্বের সবচেয়ে বেশি নামিয়ে ফেলার অনুরোধের হার রয়েছে এবং এটি প্রায়শই সমালোচনা থামানোর একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে রাজনৈতিকভাবে অভিযুক্ত প্রতিবাদের সময় টুইটার নামিয়ে ফেলার অনুরোধগুলি মেনে না চলায় সরকারের পালটা প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়। ২০২২ সালে গণমাধ্যম প্রতিবেদন করেছে যে টুইটার সরকারের আদেশকে “ক্ষমতার অপব্যবহার” বলে উল্লেখ করে বেশ কয়েকটি টুইট সরিয়ে নেওয়ার আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে সামাজিক গণমাধ্যম ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদের যুদ্ধক্ষেত্রগুলির অন্যতম। তাই আমরা বিশ্বজুড়ে মঞ্চগুলির দখল আরো সংহত হওয়ার সাথে সাথে  রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় কুশীলবদের সাথে তাদের আরো বিরোধ দেখার আশা করতে পারি।


পরাধীনতা পর্যবেক্ষক থেকে আরো খবর পেতে অনুগ্রহ করে প্রকল্পটির পাতা দেখুন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .