মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক অলাভজনক সংরক্ষণ মঞ্চ মঙ্গাবে ২০২২ সালের জুলাই মাসে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে জানিয়েছে যে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সুন্দরবন এবং বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি সাতক্ষীরার গ্রামগুলিতে লবণাক্ত জল দ্রুত অভ্যন্তরীণ এবং মিঠা জলের উৎসগুলিতে ঢুকে গিয়ে অঞ্চলগুলিতে স্বাদু জলের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। এলাকার নারী ও তরুণীদের জন্যে একটি মর্মান্তিক পরিণতি হলো মাসিকের সময় ব্যবহৃত ন্যাকড়া পরিষ্কার করার জন্যে এই নোংরা লবণাক্ত জল ব্যবহার করার ফলে তারা সংক্রমিত এবং অসুস্থ হচ্ছে। ফলে এসব এলাকার নারী ও মেয়েরা তাদের মাসিক বন্ধ করতে প্রায়ই বিবাহিত নারীদের কাছ থেকে চুরি করে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন করছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সুপেয় জলে প্রবেশাধিকার
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের একটি বাংলাদেশ জালের মতো নদী বিভক্ত একটি নিচু ব-দ্বীপ। প্রতি বছর সাত থেকে আট মিলিমিটার (এক ইঞ্চির এক চতুর্থাংশের বেশি) সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সম্মুখীন দেশটিতে বন্যার কারণে লক্ষ লক্ষ জনগণ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল ভবিষ্যদ্বাণী করেছে বর্তমান হারে বৈশ্বিক উষ্ণতা চলতে থাকলে আগামী দশকে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ শতাংশ লোককে অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে।
পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিক রফিকুল মন্টু বাংলাদেশের ঝুঁকির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন:
Bangladesh is one of the ten countries in the world at risk due to rising sea levels. The coast of Bangladesh is at great risk. pic.twitter.com/yWcqn9rv0h
— Rafiqul Montu (@ri_montu) October 13, 2021
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বের দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশের উপকূল বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় স্বাদু পানির মজুদকে প্রভাবিত করেছে। এই অঞ্চলের তরুণী ও নারীরা তাদের ঋতুচক্রের জন্যে স্বাদু জল তো দূরের কথা পানের জন্যে বিশুদ্ধ জল পাচ্ছে না।
বাংলাদেশে ঋতুস্রাব ও সংশ্লিষ্ট সামাজিক কলঙ্ক
বিশ্বব্যাংকের হিসেব মতে সারা বিশ্বের ৫০ কোটি নারী ও তরুণী ঋতুস্রাবজনিত দারিদ্র্যের শিকার – তারা মাসিকের জন্যে স্বাস্থ্যসম্মত পণ্যের ব্যয়ভার বহন করতে পারে না – যা শুধু তরুণী এবং নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিপূর্ণ করে না বরং তাদের গড়ে ওঠা এবং জীবিকাকেও প্রভাবিত করে৷
বাংলাদেশে বাণিজ্যিক মাসিকের প্যাড ব্যবহারের কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। তবে রাজধানীতে কর্মজীবী নারীদের মধ্যে ব্যবহার বেশি হলেও অনেক আগে থেকেই গ্রামীণ এলাকাগুলোতে ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী প্যাডের পরিবর্তে পুরানো কাপড় ব্যবহার করে থাকে। বাণিজ্যিক স্বাস্থ্যসম্মত প্যাডগুলি গ্রামাঞ্চলে ক্রমবর্ধমানভাবে পাওয়া গেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীদের একটা বড় অংশ সেগুলির ব্যয়ভার বহন করতে পারে না। “জল সম্পদ এবং মানব স্বাস্থ্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব” নিয়ে ২০১৮ সালের সমীক্ষায় বাংলাদেশের দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলের তরুণী ও নারীদের মাসিকের কাপড় পুনরায় ব্যবহার করার জন্যে লবণাক্ত জলে ধুয়ে ফেলতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশে ঋতুস্রাব একটি সামাজিক কলঙ্ক হিসেবে ধরা হয় এবং তরুণীদের মধ্যে মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে শিক্ষার অভাব রয়েছে – অনেকে এটিকে একটি অসুস্থতা মনে করে গোপণ রাখে। নারীরা পুরুষদের সামনে ঋতুস্রাবের ন্যাকড়া পরিষ্কার করতে ভীষণ বিব্রত হয় এবং এমনকি যারা স্যানিটারি পণ্য কেনার সামর্থ্য রাখে তারাও খুব কমই নিয়মিত দোকানে সেটা কিনতে যায়।
Getting your first period in Bangladesh: ‘Many girls’ lives have been ruined because of unhealthy #menstrual management’. A guest blog by public health activist Sumit Banik #MHDay2020 #ItsTimeForAction #periodsinpandemics #MenstruationMatters https://t.co/aKlSo6iaXl pic.twitter.com/FoA6W3BAfz
— Period! (@PeriodMagazine) May 27, 2020
বাংলাদেশে আপনার প্রথম মাসিক: অস্বাস্থ্যকর #মাসিক ব্যবস্থাপনার কারণে অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। জনস্বাস্থ্য কর্মী সুমিত বনিকের একটি অতিথি ব্লগ #এমএইচদিবস২০২০ #পদক্ষেপেরএখনইসময় #মহামারীকালীনমাসিক #মাসিকমূল্যবান
মঙ্গাবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে (মাসিকের) পুরানো ন্যাকড়া অপরিষ্কার লবণাক্ত পানিতে ধোয়া এড়াতে কিছু কিছু তরুণী তাদের ঋতুচক্র সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার জন্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন করছে। তারা বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে তাদের প্রবীণদের ত্বক এবং যৌনাঙ্গের সংক্রমণে ভুগতে দেখেছে। তবে গর্ভনিরোধক বড়ি সেবন তাদের রক্ত জমাট বাঁধা এবং স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধিসহ স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্যবিধি বেসলাইন জরিপ (২০১৪) অনুসারে ৪০ ছাত্রী ঋতুস্রাবের কারণে গড়ে তিন দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। কারণ স্কুল বা প্রকাশ্য এলাকায় স্যানিটারি প্যাড সহজে পাওয়া যায় না বা নারীদের তাদের ঋতুস্রাব সম্পর্কে গোপনে থাকতে শেখানো হয়। স্থানীয় একটি স্যানিটারি প্যাড কোম্পানি সাতক্ষীরায় একটি কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রচারণা চালু করেছে যার মধ্যে নারী ও তরুণিদের জন্যে স্বাদু পানির ট্যাঙ্ক স্থাপন এবং তাদের মাসিক সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক প্রশিক্ষণ অন্তর্ভূক্ত। কিছু স্থানীয় বেসরকারি সংস্থাও সাশ্রয়ী মূল্যের মাসিকের স্বাস্থ্যবিধিসম্মত পণ্য তৈরির উদ্যোগ শুরু করেছে। তবে এসব সমাধান ৮ কোটি ৩০ লক্ষেরও বেশি নারীর দেশের জন্যে যথেষ্ট নয়।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন দাতব্য সংস্থা ইউনাইটেড পারপাস সাশ্রয়ী মূল্যের প্যাড তৈরির জন্যে একটি স্থানীয় উদ্যোগ সম্পর্কে টুইট করেছে:
In #Bangladesh a group of women have formed the Shopno Mini Garments & Sanitary Napkin Production Center at Cox’s Bazar.
They make period pads & clothes at the centre & ensure the women & girls in the community get period pads at affordable prices 🙌#menstrualhygiene #business pic.twitter.com/RHfUTWz2IQ
— United Purpose (@United_Purpose) September 10, 2021
#বাংলাদেশে একদল নারী কক্সবাজারে স্বপ্ন মিনি গার্মেন্টস ও স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করেছে।
সম্প্রদায়ের তরুণী ও নারীদের জন্যে সাশ্রয়ী মূল্যে মাসিকের প্যাড প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে তারা কেন্দ্রে মাসিকের প্যাড এবং জামাকাপড় তৈরি করে 🙌#মাসিকেরস্বাস্থ্যবিধি #ব্যবসা
বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজের অনেক মানুষ নিরাপদ মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে আলোচনা করতে রাজি নয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুলে প্রতি ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্যে ন্যূনতম একটি টয়লেট থাকা উচিত বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে নির্দেশনা জারি করে তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশে মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রয়োজনীয় গণসচেতনতার জন্যে এসব বাধা অতিক্রম করতে হবে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এমন একটি বাহ্যিক হুমকি যার সমাধান বাংলাদেশের একার হাতে নেই।
1 টি মন্তব্য
প্যাড ব্যবহারের সুযোগ না পাওয়া নারীদের জন্য কাজ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে মাত্র ১৫ শতাংশ নারী মাসিকের সময় প্যাড ব্যবহার করার সুযোগ পান। মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের দেশের নারীরা কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। বিষয়টি এড়িয়ে যান, লজ্জা পান, লুকিয়ে রাখেন। বিষয়টি খুবি কষ্টের। যেসব নারী প্যাড ব্যবহারের সুযোগ পান না, তাঁদের জন্য কিছু একটা করার জন্য চিন্তা করতে হবে সচেতন মহলের।